স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট পুলিশিং
মো. হারুন অর রশিদ
প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে উন্নত বাংলাদেশ এবং সেটি হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা জনসাধারণ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
নাগরিকদের কৌতূহল জেগেছে জানার-স্মার্ট বাংলাদেশ কী? এবং দেখতে কিরকম হবে। যেমনটি হয়েছিল ২০০৮ সালে, যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প-২০২১-এর ঘোষণা দিয়েছিলেন।
স্মার্ট বাংলাদেশে নাগরিক সেবা থেকে শুরু করে সব আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার হবে।
উদ্দেশ্য, প্রান্তিক পর্যায়ে সর্বস্তরের মানুষকে এ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা। উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি করা, দ্রুত সেবা প্রদান নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক উন্নয়নে গতিশীলতা আনা। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ দেখতে কেমন হবে তার কিছুটা ধারণা দেওয়াই আজকের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
হাজারো বছরের শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চনার শিকার পরাধীন বাঙালি জনগোষ্ঠীকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশাত্মবোধ আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার মুক্তিকামী ছাত্র, শ্রমিক, আর জনতা। দীর্ঘ ন’মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখো শহিদের ত্যাগ আর মা-বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে মহান স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ২০০৮ সালে নির্বাচনি ইশতেহারে ঘোষণা করেছিলেন Vision-2021 ডিজিটাল বাংলাদেশ। ওই সময় দেশের অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে এনালগ পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তখনো Internet Network গড়ে ওঠেনি। যতদূর মনে পড়ে, গুটিকতক ধনাঢ্য ব্যক্তি হ্যান্ডসেট/মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন।
২০০৮ সালে ইন্টারনেট ইউজার ২৫ শতাংশ (৩.৭ মি.) এবং মোবাইল ফোন ইউজারের সংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশ। কোন Mobile Internet ছিল না বললেই চলে। ইন্টারনেটের কোনো Backbone তৈরি হয়নি।
ছিল না কোনো স্বয়ংক্রিয় ডিভাইস। তদুপরি মোবাইল কলের রেট প্রতি মিনিটে এবং মডেম বেইজ্ড অত্যন্ত সীমিত, ইন্টারনেটের প্রতি ব্যান্ডউইথ খুব ব্যয়বহুল ছিল।
এরূপ অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশের যে রূপকল্প, তা তারই দূরদর্শিতা, প্রাজ্ঞতা ও বিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তারই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ জাতিকে আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ নিরেট বাস্তবতা। অনলাইনভিত্তিক লাইব্রেরি Data Reportal-এর তথ্যমতে ২০২৩-এর শুরুতে দেশে ইন্টারনেট ইউজারের সংখ্যা ৬৬.৯৪ মিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৪.৭০ মিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ। সেলুলার মোবাইল সংযোগ সংখ্যা ১৭৯.৯ মিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার ১০৪.৬ শতাংশ। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা ভোগ করছেন জনগণ। ইন্টারনেট ও মোবাইল কল রেটের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে সর্বজনীন করা হয়েছে। ব্যাষ্টিক থেকে শুরু করে সামষ্টিক পর্যায়ে এর ব্যাপ্তি ঘটেছে। যোগাযোগ, কথোপকথন, সেবাগ্রহণ, পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, সভা-সেমিনার ইত্যাদি ক্ষেত্রে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার উল্নেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডিজিটাল যোগাযোগমাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ ঘরে বসে তাদের কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি সেবা উল্লেখ না করলেই নয়। আমরা সবাই জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর সুবিধাভোগী। বিপদ-আপদ, অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা বা যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সেবার জন্য ৯৯৯-এ কল করে থাকি। এটা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং স্বাস্থ্য সমন্বয়ে একটি সমন্বিত সেবা। সেবাটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগবিষয়ক মাননীয় উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ২০১৭ সালে ১২ ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন। এটি তারই মস্তিষ্কপ্রসূত বা উদ্ভাবন। ওই সেবার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বাস্তবায়নে আমার সরাসরি কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ থেকে বিভিন্ন সেবা গ্রহণের জন্য এ পর্যন্ত মোট ৪,৪৭,৪৯,৩৭৬ জন কল করেছেন। এর মধ্যে পুলিশের সেবা নিয়েছেন ৯,৫৩,৫০৭ জন, ফায়ার সার্ভিসের সেবা নিয়েছেন ১,০১,৯৫৯ জন, অ্যাম্বুলেন্স সেবা নিয়েছেন ১,১৬,১৮৪ জন। কলপ্রতি সাড়া দেওয়ার কারণে অনেক জীবন ও সম্পদ রক্ষা পেয়েছে। এমনি আরেকটি সেবা অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের প্রবাসে চাকরি বা অভিবাসন প্রক্রিয়ায় এ ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন হয়। এ সেবাটি চালু হয় ২০১৭ সালে। অদ্যাবধি ৩৪,৩৭,৯৬৯ জন এ সেবা থেকে সুবিধা ভোগ করেছেন। এ ধরনের আরও বহুবিদ অনলাইন সেবা রয়েছে। ডিজিটাল হওয়ার কারণে সেবা দ্রুত মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। এতে সময় ও খরচ দুই-ই কম লাগছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে অতিমারি করোনাকালে Social Distancing-এর কারণে সশরীরে উপস্থিতিকে নিরুৎসাহিত করা হয়, ক্ষেত্রবিশেষে নিষেধও ছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা থাকায় অনলাইন সভা, কনফারেন্সের মাধ্যমে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা সম্ভব হয়েছিল।
শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে সারা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ অক্ষুণ্ন রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছিল। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশের উত্তরণে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিশেষ ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সাধারণ মানুষকে ডিজিটাল সেবার আওতায় আনার জন্য দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে তথ্য বাতায়ন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সেবা প্রত্যাশীরা UDC-এর মাধ্যমে যে কোনো অনলাইন সেবা গ্রহণ করতে পারে।
তদুপরি মোবাইল ইন্টারনেট Availability-এর কারণে ঘরে বসে বিভিন্ন তথ্য জানা এবং সেবা প্রাপ্তির সহজলভ্যতার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সেবা ও পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অনলাইন প্লাটফর্ম ই-কমার্স বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
রূপকল্প ২০৪১ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির বিস্তার সম্ভাবনার দ্বারকে উন্মোচিত করবে। সারা বিশ্বে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মেশিন লারনিং বিগ ডেটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ বিষয়গুলো জনসাধারণের দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। তাই এর সহজবোধ্য ব্যাখ্যা প্রয়োজন। তার আগে যে বিষয়টি আমি উল্লেখ করতে চাই তা হলো, অতিসম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি প্রধান স্তম্ভ স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট ইকোনমি এবং স্মার্ট সোসাইটি, যা তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন।
এবার আসা যাক স্মার্ট বলতে আমরা কী বুঝব। স্মার্টলি চলা, স্মার্টলি কথা বলা, নাকি স্মার্ট পোশাক-পরিচ্ছদ পরা-না এর কোনোটিই নয়। SMART-এর বিস্তারিত করলে দাঁড়ায় Self-Monitored Analysis Reporting Technology. এটা একটি প্রযুক্তি যা একজন মানুষের মতোই আচরণ করবে, জ্ঞান অর্জন করবে, স্মৃতি ধারণ করবে এবং সিদ্ধান্ত দিতে পারবে। শুনে অনেকেই হয়তো অবাক হচ্ছেন। তাহলে চলুন দেখা যাক এটা কী। রোবট সম্পর্কে আমরা চমকপ্রদ অনেক কিছু শুনি। রোবট নিজে নিজে কথা বলে, শুনে, কাজ করে ইত্যাদি। রোবট কোনো মানুষ নয় বরং আত্মনিয়ন্ত্রিত বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। আরও সহজ করে বলা যায়, সাধারণত কোনো মেশিন বা যন্ত্র মানুষ পরিচালনা করে, কিন্তু Robot নিজেই নিজেকে পরিচালনা করে। কীভাবে করে আমরা শুনি। Machine Learnings এখন বহুল আলোচিত একটি বিষয়। এটি কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি শাখা যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য ভান্ডারে রক্ষিত তথ্যটি বিশ্লেষণ করে।
এটি তথ্য ও তথ্যভিত্তিক-তথ্যনির্ভর একটি সমাধান পদ্ধতি, যাকে Algorithm বলা হয়ে থাকে কম্পিউটারের ভাষায়। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯। যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে নাগরিকদের সেবা প্রদান করার জন্যই এ সেবাটি প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে ৯৯৯ ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করছে। কেউ ৯৯৯-এ কল করলে কল সেন্টারে একজন অপারেটর (Call Taker) কলটি গ্রহণ করে এবং কলারের চাহিদামতো কল সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ইউনিট অর্থাৎ থানায় ডেসপাচ্ করে অথবা কনফারেন্সিংয়ের জন্য থানাকে সংযুক্ত করে দেয়। এ ব্যবস্থায় কলারের লোকেশনও জানা যায় (GPS Location)। অতঃপর থানা থেকে সেবা প্রত্যাশীকে সাড়া প্রদান করা হচ্ছে। সাড়া প্রদানের সময় (Response Time) আরও সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত করার লক্ষ্যে পুলিশের মোবাইল প্যাট্রোল গাড়িগুলোতে মোবাইল ডাটা টার্মিনাল (এমডিটি) বসানোর কার্যক্রমও সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে। ফলে ৯৯৯ কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার থেকে থানায় ডেসপাচের পরিবর্তে সরাসরি ঘটনাস্থল বা সেবাপ্রত্যাশীর নিকটবর্তী কোনো এমডিটিতে কল ডেসপাচ করলে খুব দ্রুত সাড়া প্রদান করা সম্ভব হবে।
এবার আসি এ স্মার্ট ৯৯৯, যা ‘স্মার্ট বাংলাদেশের তথা স্মার্ট গভর্নমেন্ট’রই অংশ, তা আসলে কী রকম হবে? ডিজিটাল ৯৯৯ যখন স্মার্ট ৯৯৯ হবে তখন কোনো অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা, বা অপরাধ, যেমন-হাউজ ট্রেসপাসিং, যৌন হয়রানি ইত্যাদিসহ যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে মানুষকে আর কল করতে হবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) সমৃদ্ধ যে কোনো IOT (Internet of Things)-এর আশপাশে কোনো ঘটনা, দুর্ঘটনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় সেবার জন্য সংকেত বা কোনো অ্যালার্ম স্মার্ট ৯৯৯ কমান্ড সেন্টারে পাঠাতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোথাও সাপ্তাহিক ছুটি উদ্যাপন করতে গিয়েছেন বা আমরা যা সচরাচর করি-ঈদ, পূজার বড় ছুটি পেলে পরিবারের সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে যাই। বাসায় কেউ থাকে না। সেক্ষেত্রে আপনার বাসায় যদি IOT নামক ডিভাইসটি থাকে আর তার যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থাকে, তবে আপনার অনুপস্থিতিতে যে কেউ আপনার বাসা-বাড়িতে ঢুকলে বা বাসায় কোনো দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড ঘটলে স্মার্ট ৯৯৯ কমান্ড সেন্টারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কল বা অ্যালার্ম বা সিগন্যাল চলে আসবে। শুধু তাই নয়, স্মার্ট ৯৯৯ অবশ্যই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসমৃদ্ধ কলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করে অগ্নিকাণ্ড হলে নিকটবর্তী ফায়ার সার্ভিসকে অথবা কোনো অপরাধসংক্রান্ত হলে নিকটবর্তী ইউনিটকে কল, সংকেত, সিগন্যাল পাঠাবে। সাড়া বা সেবা প্রদান অথবা সাড়া প্রদানকারী ঘটনাস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে কলটি লাইভ থাকবে।
স্মার্ট গভর্নমেন্ট তথা স্মার্ট ল’ এনফোর্সমেন্টের আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবাদে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বেশকিছু ডিজিটাল ডাটা-ডিজিটাল তথ্যভান্ডার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন-জাতীয় পরিচয়পত্র, যানবাহনের তথ্য সংবলিত তথ্যভান্ডার। এ তথ্যভান্ডারের সঙ্গে যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমৃদ্ধ ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা যায় তবে মহাসড়ক-সড়কে ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট অনেকটা সহজ ও দ্রুত সম্ভব। চলুন দেখা যাক, এটা কীভাবে কাজ করবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা হয় ৮০ ভাগেরও বেশি। এ দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনার জন্য AI সংবলিত Automated Software Application ক্যামেরা এবং স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। মহাসড়কে ইতোমধ্যে সংঘটিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে। তদানুসারে স্মার্ট ক্যামেরা মহাসড়ক-সড়কে প্রকাশ্য-গোপনে বসানো যেতে পারে। এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত ক্যামেরা গতিসীমার অতিরিক্ত গতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করতে পারবে এবং সংশ্লিষ্ট গাড়ি এবং গাড়ির মালিকের তথ্যভান্ডার (Big Data) বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ণয় করতে পারবে। তদুপরি আইনানুসারে এ অপরাধের জন্য নির্ধারিত জরিমানা সরাসরি অভিযুক্ত গাড়ির মালিকের যোগাযোগের ঠিকানা, মোবাইল নম্বর বা ই-মেইলে পাঠিয়ে দিতে পারবে। পেমেন্ট সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এটা মুলতবি দেখাবে। তাছাড়া, ট্রাফিক সিগন্যাল যদি Automated করা যায়, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যানজট শনাক্ত করে তদানুসারে ট্রাফিক সিগন্যাল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে। ফলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা ট্রাফিক সিগন্যালে যানবাহনের জট অনেকাংশে কমে যাবে। কারণ পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থা তখন ডিজিটাল এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে।
স্মার্ট বাংলাদেশে কফি মেকার থেকে শুরু করে অটোমেটেড গাড়ি সবই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত যন্ত্রচালিত হবে। আপনার সকালের চা-কফি আপনার সামনে চলে আসবে। আপনার গাড়ি ড্রাইভারবিহীন হবে। রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে আপনি গাড়ি ডাকবেন, গাড়ি স্বয়ংক্রিয় পার্কিং থেকে বের হয়ে লিফ্টিং প্লেসে চলে আসবে। আপনি গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়ালে দরজা খুলে যাবে। এবার ভেতরে ঢুকে মনিটরে আপনার লোকেশন ইনপুট দিলে গাড়ি আপনাকে ওই লোকেশনে পৌঁছে দেবে। পুরো রাস্তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রাফিক নিয়ম মেনে গাড়িটি চলবে। রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে অটোসিগন্যাল-অ্যালার্ম জেনারেট হবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রাফিক কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে সিগন্যাল পাঠাবে।
স্মার্ট বাংলাদেশের পাশাপাশি স্মার্ট সিটি বিষয়টিও এখন বহুল আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। স্মার্ট সিটি নাগরিকদের দ্রুত সেবা প্রদান যেমন নিশ্চিত করবে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করবে। স্মার্ট সিটি ব্যবহার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত স্মার্ট পুলিশিং অপরাধী শনাক্ত-চিহ্নিতকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। অপরাধের ঘটনাস্থল এবং অপরাধী দ্রুত শনাক্ত করা যাবে। পৃথিবীর উন্নত দেশের শহরগুলোতে সিসি টিভি বসিয়ে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়। সন্দিগ্ধ বা কোনো অপরাধী অথবা অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে ইন্টেলিজেন্ট ক্যামেরার সাহায্যে সহজেই শনাক্ত করতে পারে। আর এর পেছনে কাজ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেটেড সফ্টওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন। ২৪/৭ মনিটরিংয়ের ফলে অপরাধীদের নির্বিঘ্ন চলাচল অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং অপরাধ সংঘটনের মাত্রা কমে যায়। এ নিরবচ্ছিন্ন মনিটরিং ব্যবস্থায় একটা প্রতিরোধমূলক প্রভাব থাকে। অপরাধী যখন জানে যে, অপরাধ করে পার পাবে না তখন এমনিতেই অপরাধের হার কমে যায়।
স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট পুলিশিং হবে একটি অনিবার্য বাস্তবতা। উৎপাদন, প্রস্তুতকরণ, বিপণন থেকে শুরু করে সেবা প্রদান সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে। পরিবর্তিত এ প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা, অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে স্মার্ট পুলিশিং হবে একমাত্র নিয়ামক। এ বাস্তবতাকে সামনে রেখে একটি আধুনিক, দক্ষ, প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট পুলিশ গঠনে বাংলাদেশ পুলিশ এগিয়ে যাচ্ছে। নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ, পদায়ন ও পদোন্নতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার ওপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তদুপরি আধুনিক প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং বাহিনীর সদস্যদের অধিকতর প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণের এখনই সময়। আমরা সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি।
ব্যারিস্টার মো. হারুন অর রশিদ, বিপিএম : অতিরিক্ত আইজি (এইচআরএম), বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা