আমরা কি গণউৎপাতের রাজ্যে বসবাস করছি?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
আমাদের দেশে উৎপাতের অন্ত নেই। চারদিকে উৎপাত। নানা ধরনের উৎপাত। পথে-ঘাটে-মাঠে সর্বত্র উৎপাত আর উৎপাত। এ যেন উৎপাতের স্বর্গপুরী। অনেক সময় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করেও উৎপাত থেকে রেহাই মেলে না। সবকিছু দেখে মনে হয়, আমরা যেন উৎপাতের রাজ্যে বাস করছি।
উৎপাত যেন জীবনেরই অনুষঙ্গ; তাই উৎপাতে এখন আমরা আর বিরক্ত হই না। আবার অনেকেই মনে করতে পারেন, দেশে বুঝি উৎপাত নিরোধক কোনো আইন নেই। আবার অনেকেই হয়তো জানি না, উৎপাত কী। আভিধানিক অর্থে, উৎপাত শব্দের অর্থ হচ্ছে উপদ্রব, দৌরাত্ম্য, অত্যাচার। উন্নত দেশগুলোতে উৎপাত করা একটি মারাত্মক অপরাধ; ভয়ানক দেওয়ানি অপরাধ ও শাস্তিযোগ্য। সেখানে শান্তিভঙ্গ করা বা উৎপাত করা ফৌজদারি অপরাধের মতোই দণ্ডযোগ্য একটি অপরাধ। সাধারণ অর্থে, অন্যের ভোগে বা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাঘাত ঘটানোর নামই উৎপাত।
এটি এমন এক ধরনের অপরাধমূলক কাজ, যা জনগণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। একজন ব্যক্তি আইন মেনে আরেকজনকে বিরক্ত না করে যদি তার ন্যায়সংগত অধিকার ভোগ করে, তাতে কারও ব্যাঘাত ঘটানোর অধিকার নেই। এ ব্যাঘাত ঘটানোই হলো উৎপাত। উৎপাতের দায়দায়িত্ব সৃষ্টি হয় এমন কোনো অবস্থার সৃষ্টি করলে অন্যের ভোগে বা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। গণউৎপাত সম্পর্কে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির (১৮৬০) ২৬৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি কর্তৃক জনসম্মুখে এমন কোনো কাজ করা যার দ্বারা জনগণের বিরক্তি সৃষ্টি হয় এমন কার্য করাকে গণউৎপাত বলে।’ আর দণ্ডবিধির ২৯০ ধারায় এর শাস্তি সম্পর্কে দুইশ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার কথা বলা হয়েছে। ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধির শাস্তি হিসাবে দুইশত টাকা যদিও বর্তমান বাস্তবতায় খুবই সামান্য, তবুও শাস্তি হিসাবেই গণ্য হয়। দণ্ডবিধির সংজ্ঞা অনুযায়ী, যে কোনো ব্যক্তি তার অবৈধ কাজ, যা জনসাধারণের উপদ্রব সৃষ্টির জন্য দায়ী, যা জনসাধারণের শারীরিক বা মানসিক আঘাত, বিপদ বা বিরক্তি সৃষ্টি করে। অতএব, কোনো ব্যক্তির উচ্চশব্দের সংগীতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা বৈধ অধিকার, যা শব্দের তীব্রতার কারণে একটি অপরাধকে গঠন করে।
এ প্রসঙ্গে বছর কয়েক আগের পুরান ঢাকার একটি মর্মান্তিক ঘটনার পুনরুল্লেখ করছি। সেখানে একটি ভবনের ছাদে একদল লোক অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে উচ্চশব্দে সংগীত বাজাচ্ছিল। ৬৫ বছর বয়সি নাজমুল হক নামক এক ব্যক্তি ওই একই ভবনের একজন বাসিন্দা ছিলেন। তিনি ওই উচ্চশব্দের সংগীতের কারণে অসুস্থবোধ করেছিলেন। তিনি সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করলেন সংগীতে শব্দের তীব্রতা কমাতে। কিন্তু তারা তা না করলে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি মর্মান্তিক ঘটনায় রূপ নেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করে।
আমাদের দেশে মশা-মাছির উৎপাত থেকে শুরু করে ভিক্ষুকের উৎপাত, হিজড়াদের উৎপাত, মাদকসেবীদের উৎপাত, যানবাহনে উচ্চমাত্রার হর্ন ব্যবহার করে শব্দদূষণের উৎপাত, বায়ুদূষণের উৎপাতসহ পরিবেশ দূষণজনিত উৎপাত, ভাসমান পতিততাদের উৎপাত, ময়লা-আবর্জনা-ধোঁয়া-দুর্গন্ধজনিত উৎপাত, হৈ-হুল্লোড়জনিত উৎপাত, চলাচলজনিত উৎপাত, উচ্চস্বরে মাইকে বা ঢাকঢোল বাজিয়ে বা সাউন্ডবক্সে গান-বাজনা বাজিয়ে বা রাতের বেলায় বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহার করে উৎপাত সৃষ্টি করাপূর্বক লেখাপড়া ও ঘুমে বিঘ্ন ঘটানোর উৎপাত, স্কুল-কলেজ আর রাস্তার মোড়সহ যেখানে-সেখানে বখাটেদের উৎপাত, আড্ডাবাজদের উৎপাত, হকারদের উৎপাত, পথেঘাটে চলাচলের সময় উৎপাতসহ নানা ধরনের উৎপাত পরিলক্ষিত হয়। আবার অনেক সময় বখাটের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে অনেক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করেন, যা সত্যিকার অর্থেই দুঃখজনক।
আমরা অনেক সময় উৎপাত আর দায়িত্বে অবহেলাকে এক বিষয় হিসাবে মনে করি বা মনে হতে পারে। কিন্তু উৎপাত আর দায়িত্বে অবহেলা এক বিষয় নয়। অবহেলার ক্ষেত্রে প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে, বিবাদীর সাবধানতা অবলম্বন করা দায়িত্ব ছিল কিনা এবং বিবাদী সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে কিনা। আর উৎপাতের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বনের প্রশ্ন ওঠে না। বিবাদীর আচরণই মুখ্য বিষয়। যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করার পরও যদি উৎপাতের সৃষ্টি হয়, তারপরও বিবাদী দায়ী। কিন্তু কারও জমিতে কোনো আগন্তুক যদি উৎপাতের কারণ সৃষ্টি করে তবে জমির মালিক অসতর্কতার জন্য অবহেলার দায়ে দায়ী।
কারণ, তার জমিতে এসে কেউ উৎপাত সৃষ্টি করলে তার দায়দায়িত্ব মালিককেও নিতে হবে। অবহেলার ক্ষেত্রে বাদীর অবদান বিবাদীর দায়দায়িত্ব আনুপাতিক হারে হ্রাস করে। উৎপাতের স্থলে বাদী নিজেই এসেছিল-এরকম আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। পরিস্থিতি, স্থান, পদ্ধতি, ফলাফল, সংবেদনশীলতা ইত্যাদির আলোকে বিচার করতে হবে, সেখানে উৎপাতের প্রতিকার পাওয়া যাবে কিনা। আইনে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে উৎপাত বৈধ হয়ে যায়; কিন্তু অবহেলার জন্য আইন ক্ষমতা প্রদান করে না। উৎপাতের প্রতিকারের জন্য বাদীকে দখল বা মালিকানা প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু অবহেলার ক্ষেত্রে কোনো স্বত্ব প্রমাণের প্রয়োজন নেই, বাদীর প্রতি ক্ষতি অনুমেয় কিনা তা-ই এখানে বিবেচ্য বিষয়। যেমন-মেরামতের অভাবে কোনো একটি বাড়ির সিমেন্ট প্লাস্টার খসে পড়ে পথচারীকে আঘাত করলে উৎপাতের দায়িত্ব সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাড়ির আঙ্গিনায়ই এভাবে কাউকে আঘাত করলে তা অবহেলার কারণ ঘটায়। ও’গরম্যান বনাম ও’গরম্যান মামলার ঘটনাটি এরকম-অনেক মৌমাছি বিবাদীর অঙ্গনে রাখা হয়েছিল; কিন্তু স্থানটি মৌমাছি রাখার জন্য উপযুক্ত ছিল না। ফলে মৌমাছি সে স্থান থেকে বের হয়ে এসে বাদীকে আক্রমণ করে।
বিবাদীকে উৎপাতের দায়ে একজন বিচারক দায়ী করেন; কিন্তু অপর একজন বিচারক তাকে অবহেলার জন্য দায়ী করেন। কারণ, সেখানে সতর্কতা অবলম্ব করা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ঠিক তেমনিভাবে অসতর্কভাবে অস্ত্রোপচার অবহেলার সমান, এটি উৎপাত নয়। তবে অবহেলার পরিধি উৎপাতের পরিধির চেয়েও ব্যাপক। কেউ ক্রমাগত উৎপাত করলেও বিষয়টিকে আমরা অবহেলা বা অজ্ঞতা বলে ক্ষমার চোখে দেখি। ফলে উৎপাতের পরিমাণ বাড়ে বৈ কমে না। সম্ভাব্য ও অনুমেয় ক্ষতির জন্য সাবধানতা অবলম্বনে কেউ ব্যর্থ হলে বিষয়টিকে আমরা অবহেলা বলে গণ্য করতে পারি; কিন্তু উৎপাত নয়। কেউ তার এ কাজের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে আমরা অবহেলার দায়ে দায়ী করতে পারি। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই কাজের জন্য অবহেলা অথবা উৎপাতের প্রতিকার পাওয়া যায়, কিন্তু এ দুটি বিষয় এক নয়। যদিও আইনের ভাষায় দুটি বিষয়ই টর্ট আইনের অন্তর্গত। বর্তমানে অবহেলা স্বতন্ত্র টর্ট হিসাবে আত্মপ্রকাশের আগে অনেক ক্ষেত্রে উৎপাতের সঙ্গে জড়িত ছিল। আমাদের দেশে টর্টের যে দু-চারটি মামলা হয়ে থাকে, তা মূলত মানহানিকেন্দ্রিক। টর্টের অন্যান্য বিষয় যেমন-উৎপাত, গণউৎপাত, দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অনধিকার প্রবেশ ইত্যাদিবিষয়ক মামলা আদালতে যেন অজ্ঞাত কারণে দায়ের হতে দেখা যায় না। ফলে আইনের এ গুরুত্বপূর্ণ শাখাটি দেশের আইন অঙ্গনে উপেক্ষিত থাকায় এর প্রয়োগ ও প্রতিকার সম্পর্কে অনেকেরই অজানা। অথচ, টর্ট আইনে মামলা করে সহজেই উৎপাত বা গণউৎপাতের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা প্রতিনিয়ত যে ধরনের উৎপাতের সৃষ্টি করে চলেছি এবং অন্যের উপভোগের ওপর হস্তক্ষেপ ঘটাচ্ছি, সে সম্পর্কে আমরা সবাই কি সচেতন? নিশ্চয় না। এ দেশে উপদ্রব বা উৎপাত এখন যেন একটি সাধারণ নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দেশের লোকজন প্রতিনিয়ত বড় বড় অন্যায়-অপরাধ, দুর্নীতি দেখতে দেখতে উৎপাতের মতো বিষয়টি যেন তাদের মাথাতেই আসে না। এর অন্যতম কারণ, এ সংক্রান্ত কোনো কার্যকর আইন নেই আমাদের দেশে। তাছাড়া যেহেতু উৎপাত হত্যা, ধর্ষণ এবং অন্যান্য বড় অপরাধের মতো গুরুতর নয়, তাই জনগণ এ অপরাধ সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন নন; কিন্তু সবার স্মরণ রাখা প্রয়োজন, উৎপাত বা উপদ্রবের মতো ক্ষুদ্র অপরাধ হত্যাকাণ্ডে পর্যন্ত রূপান্তরিত হতে পারে বা হয়ে থাকে। এ ধরনের অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের আইনি শিক্ষার অভাব, সচেতনতার অভাব। দিনে দিনে আমরা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছি বটে; কিন্তু সভ্য আচরণ শেখার ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছি। মূলত এ কারণেই চারদিকে এতসব উৎপাত, উপদ্রব। এ অবস্থা থেকে আমাদের কি দ্রুত বেরিয়ে আসা উচিত নয়?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
kekbabu@yahoo.com