জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী : আমার কিছু ভাবনা
ড. আবু সাইয়িদ
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
আজ ৫০ বছরে এসে মহান জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আমাদের পেছনে ফিরে দেখার সময়-আমরা কী চেয়েছিলাম, কী পেয়েছি, আমাদের অর্জন কী, ব্যর্থতা কী।
২. ৫০ বছরের আগের কথাও রয়েছে, যা বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসের অঙ্গীভূত। ১৯৭১ সালে আমরা বাংলাদেশের জনগণ অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সেদিন শত্রু হননে আমাদের লক্ষ্য ছিল, আদর্শ ছিল। আদর্শ ও লক্ষ্য ছাড়া কোনো জাতি বিজয় অর্জন করতে পারে না। এগিয়ে যেতে পারে না। ১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল আমরা জনপ্রতিনিধিরা স্বাধীনতার সনদে অঙ্গীকার করেছিলাম, আমাদের রাষ্ট্রীয় দর্শন হবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার।’ স্বাধীনতা সনদের সেই অঙ্গীকার আজ কোথায়?
৩. ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার গঠিত হলো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নির্বাচিত করা হলো রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী। এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান সেই মন্ত্রিপরিষদের আলোকবর্তিকা। এর সঙ্গে চরম ঘৃণ্য খুনি মোশতাক আহমেদের নামও আছে এ মন্ত্রিসভায়। শেষোক্ত নামটি এ কারণে বললাম যে, ইতিহাসে আজও মীর জাফরের নাম আছে। মীর জাফরের বেইমানির কারণে বাংলা যেটুকু স্বাধীন ছিল তা অস্তমিত হয়। তেমনি স্মরণকালীন ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের সময় ও পরবর্তীকালে বিশ্বাসঘাতক খুনি মোশতাকের নাম ইতিহাসের একটি অপাঙ্ক্তেয় কালো অধ্যায়। ইতিহাস কাউকে মুছে ফেলে না। মূল্যায়ন করে। খুনি মোশতাক সেদিন মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে আঁতাত করেছিল, তা প্রমাণিত। খুনি মোশতাককে বাদ দিলে স্বাধীনতার সময় ভয়াবহ চক্রান্ত ও পরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি ও স্বাধীনতা নস্যাতের অধ্যায়টি অবলুপ্ত হয়ে যায়। সে কারণে ইতিহাস থেকে পাঠ নেওয়া আমাদের কালান্তরের দাবি।
৪. জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের এ সময়ে আমরা অবশ্যই ভুলে যাব না ৫-৬ জুলাই বাগডোরায় গণপরিষদের প্রথম যে অনানুষ্ঠানিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার তাৎপর্যের কথা। সেদিন মোশতাক গং মুজিবনগর সরকারের পদত্যাগ এবং ‘স্বাধীনতাকে চাও না মুজিবকে চাও’-এই স্লোগান তুলেছিল। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অবিস্মরণীয় কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ চাই।’ তিনি এও বলেছিলেন, ‘আমরা যদি আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে চাই, তাহলে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে আমরা এমনভাবে অবরুদ্ধ করব, যাতে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার হানাদার বাহিনীর একটিও পালিয়ে যেতে না পারে। তাহলেই আমরা প্রিয় নেতাকে আমাদের মাঝে ফিরে পাব।’ সেদিন আমরা শপথ নিয়েছিলাম নতুন চেতনায়, নতুন উদ্দীপনায়। সমগ্র বাংলাদেশে নবউদ্যমে গেরিলা বাহিনী এবং সামরিক বাহিনী একত্রে শত্রু হননে মরণপণ লড়াই করে। সেই লড়াইয়ের শেষ পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় মিত্রবাহিনী একযোগে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি দেখলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যদি স্বদেশে ফেরত পাঠানো না যায়, তাহলে বন্দি ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনার ভাগ্যে নির্মম পরিণতি হবে। ফলে পাকিস্তানের সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক ক্ষেত্রে যে দুঃসহ ও দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠবে, তার ফলে তার গদি থাকবে না এবং পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে। বাধ্য হয়ে নানা টালবাহানা করে তিনি বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে দেন।
৫. ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জিন্দানখানা থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে এলেন। তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিলেন। সৌভাগ্যক্রমে ওই মঞ্চে আমি উপস্থিত ছিলাম। এখনো কানে বাজে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হবে একটি আদর্শ রাষ্ট্র, তার ভিত্তি কোনো ধর্মীয় ভিত্তি হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’
৬. ১৯৭২ সাল। ১০ এপ্রিল। নাখালপাড়া সংসদ ভবন। গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন। সভাপতিত্ব করলেন মওলানা আব্দুল রশিদ তর্কবাগীশ। আমরা সবাই শপথ নিলাম। ১১ এপ্রিল মাননীয় স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাটোর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আশরাফুল ইসলাম মিয়া বললেন, ‘আমাদের জাতির পিতার ছবি না দেওয়া পর্যন্ত হাউজ মুলতবি রাখার জন্য রুলিং দাবি করছি। এবং জাতির পিতার ছবি না দেওয়া পর্যন্ত হাউজ মুলতবি রাখা হোক।’ উল্লেখ্য, নাখালপাড়ার এ পার্লামেন্ট ভবনে পাকিস্তানের জাতির পিতার ছবি ছিল। সেহেতু আশরাফ ভাইয়ের দাবির প্রতি আমরা সমস্বরে করতালি দিয়ে সমর্থন করি। পরদিন স্পিকারের পেছনের দেওয়ালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত এবং বিখ্যাত পাইপ হাতে একটি ছবি টাঙানো হয়। আজ আমার প্রশ্ন, নাখালপাড়ার সেই ঐতিহ্যবাহী পার্লামেন্ট ভবন এবং যে কামরায় বসে আমরা সংবিধান রচনা করেছিলাম, তা কি সংরক্ষিত আছে? শুনেছি, সামরিক শাসন সময়ে এ গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যবাহী পার্লামেন্ট ভবনকে নির্বাহী কার্যালয় করা হলো। আমরা এমন জাতি, যারা সংরক্ষণ করি না, ধ্বংস করি। ঐতিহ্যকে ধারণ করি না। তার জন্য গর্ববোধ করি না। কী দুঃসহ অবস্থায় আমরা সেদিন সংসদের দায়িত্ব পালন করেছি, সংবিধান প্রণয়ন করেছি, রাষ্ট্রকে সুসংহত করার জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছি এবং জাতির পিতা ওই পার্লামেন্টে যে অবিস্মরণীয় ভাষণ দিয়েছিলেন তার লেশমাত্র আছে কিনা সন্দেহ। নতুন প্রজন্ম কীভাবে এসব জানবে? এগুলো যারা করেছে, তারা জাতীয় অপরাধে অপরাধী। এ ঐতিহ্যের দিক থেকে লুইক্যানের বর্তমান যে সংসদ ভবন, আমি মনে করি, নাখালপাড়ার পার্লামেন্ট ভবন তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
৭. ১৯৭৩ সালে নতুন সংবিধান অনুযায়ী সংসদীয় নির্বাচন হলো। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে আমরা বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী হতে অনুরোধ করি। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি। তিনি বললেন, ‘আমাদের দলের ট্রেডিশন এই যে, যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন-তিনি দলের প্রধান হতে পারেন না।’ দল ও সরকার পৃথক। একই ব্যক্তি দুই পদে থাকলে সরকার ও দল একাকার হয়ে যায়। দলের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা থাকে না। দলের লোক সরকারে হস্তক্ষেপ করে আর সরকারি কর্মকর্তা দলের কেউকেটা হয়ে ওঠে। এতে সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালিত হতে পারে না। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ছেড়ে দিলেন। সভাপতি হলেন এএইচএম কামারুজ্জামান।
৮. ইতোমধ্যেই স্বাধীনতাবিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করতে মরিয়া। নাশকতামূলক কাজ, বিদেশি মদদ ও অর্থ-অস্ত্র পেয়ে স্বাধীনতা ধ্বংস করার জন্য জাসদ-গণবাহিনীর একাংশ, চীনপন্থি, আন্ডারগ্রাউন্ড সশস্ত্র গ্রুপ মরিয়া হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রত্যক্ষ মদদে ও সহযোগিতায় ‘মুসলিম বাংলার’ স্লোগান দিয়ে গোপনে বেতারে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। খাদ্য সংকটের এ সময়ে মার্কিন যুক্তরাজ্য পিএল ৪৮০ খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। জনগণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
৯. জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কঠোর হলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের ফ্রিস্টাইল স্বাধীনতা নস্যাতের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হলো। সর্বত্র বিশৃঙ্খল অবস্থা। বাধ্য হয়ে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও দেশের বুভুক্ষ মানুষকে বাঁচানোর জন্য তিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেন। তিনি বললেন, আজ প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য, দুর্নীতি উচ্ছেদ, খেতে খামারে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জন্ম-শাসন। এ লক্ষ্য অর্জনে সব দলের সব মানুষকে নিয়ে তিনি নব দর্শনে গঠন করলেন জাতীয় প্ল্যাটফর্ম, যা ছিল গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রূপ। আমলাদের বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আপনারা ঘুস খাবেন না, ফাইল আটকে রাখবেন না, সরাসরি প্রশাসন চলবে, আমলাতন্ত্র বাংলাদেশে হবে না।’ তিনি বললেন, ‘কালোবাজারি, ঘুসখোর, দুর্নীতিবাজ, মুনাফাখোর ও লুটেরাদের ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের বিচার হবে, শাস্তি হবে, এমনকি প্রয়োজনে ফায়ারিং স্কোয়াডে তাদের রায় কার্যকর করা হবে।’ নাখালপাড়ার পার্লামেন্ট পার্টির বৈঠকে এবং সংসদ ভবনে তিনি এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে সময় দেওয়া হয়নি। তাকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
১০. আজ মহান জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তীর সময়। মুক্তিযুদ্ধের কোন আদর্শের ভিত্তিতে আমরা জাতীয় সংসদকে আলোকিত করছি? আজ জাতীয় সংসদের সদস্য যারা, জনগণের ভোটে তাদের নির্বাচিত হওয়া নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সংবিধানে আছে জনগণ মালিক। তাদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনা করবেন। বুকে হাত দিয়ে বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছে, সেখানে জনগণের কত শতাংশ ভোট দিয়েছে? নিশি রাতে ভোট কেটে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ? ধান্দাবাজ-দলকানা সুবিধাভোগী শৃঙ্খলা বাহিনী ও আমলারা। এবং ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসী বাহিনী। সংবিধানে আছে আমলারা কোনো দলের নয়, এমনকি সরকারের নয়, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাদের নীতিমালা আছে, আইন আছে, বিধি আছে। সেগুলো পদদলিত করে যেসব আমলা জনগণের অধিকার ছিনতাইয়ে তৎপর ছিলেন, আজ হোক কাল হোক ইতিহাস তাদের বিচার করবে।
১১. মাননীয় স্পিকার মহোদয়কে তার সামনে বসা মাননীয় সংসদ-সদস্যদের ঠিকুজি অনুধাবন করতে বলি। আপনি বলুন, আপনার বিবেকের কাছে প্রশ্ন করুন, যে প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ বহাল আছে, সেক্ষেত্রে সুবর্ণজয়ন্তী ঘটা করে উৎসব করা দেশের জন্য, মানুষের জন্য অপমানজনক কিনা। এ সংসদের মূল ভিত্তি হলো জনগণ। এ সুবর্ণজয়ন্তীতে সেই জনগণ কোথায়? তাদের পাত্তাও নেই। তারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে, চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে, কর্মসংস্থানের অভাবে তরুণ-যুবক উন্মাদ হয়ে ফিরছে। সংসদের অভিভাবককেই জিজ্ঞাসা করি, কিছু ব্যতিক্রম বাদে এ সংসদে যারা উপবিষ্ট আছেন, তাদের কয়জন মানবসেবার মহতী আদর্শ নিয়ে এসেছেন? পরিসংখ্যানে বলে সংসদে ৬৭ ভাগ অরাজনৈতিক ব্যবসায়ী। তারা টাকার বস্তা নিয়ে সংসদ-সদস্য হয়েছেন। তাদের লক্ষ্য সংসদকে ব্যবহার করে, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে, সিন্ডিকেট তৈরি করে, নিজস্ব সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি করে জনগণের ওপর চড়াও হওয়া। তারা কি জনগণের কল্যাণের জন্য এসেছেন? মানবসেবার জন্য এসেছেন? বরং ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি নিয়ে অর্থের জন্য জাল বিস্তার করেছেন রাষ্ট্রের সর্বত্র। মেরে কেটে লুট করে যেমন করে হোক অর্থ চাই। তারা অর্থ ছাড়া কোনো কাজ করেন না। হাট-ঘাট দখল করেন। গাছ খান, মাটি খান, চান শুধু অর্থ। তাদের মানবতা নেই। মানবকল্যাণে ব্রত নেই। অথচ সংবিধানে বলা আছে, ‘মানব সত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকবে।’ বলা আছে, ‘মেহনতি মানুষকে, কৃষক শ্রমিককে, জনগণের অনগ্রসর অংশগুলোকে সব ধরনের শোষণ হতে মুক্ত করবে।’ কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, অধিকাংশ সংসদ-সদস্যই জনগণকে নানাভাবে শোষণ করে চলেছেন। কয়েক লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায় কেন? কারা করে? সংবিধানে আছে, কালো টাকা নিরুৎসাহিত হবে। সংসদে কালো মানুষ আছে বলেই কালো টাকা পাচার বন্ধ হয় না। এ সম্পর্কে আইনও হয় না। যেটুকু হয় তাদের সুবিধার জন্য।
১২. দেশ আজ মহাসংকটে। কোনো দলের পক্ষেই আজ এককভাবে রাষ্ট্রপরিচালনা সম্ভব নয়। আজ প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। এ জাতীয় ঐক্যের প্রাথমিক সুযোগ হিসাবে, দীর্ঘ ৫০ বছরে যারা পার্লামেন্টে সদস্য ছিলেন বা আছেন, তাদের নিয়ে জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবকে মিলনমেলায় পরিণত করা যেত। আলোচনা হতো। মতভেদ হতো। মতবিনিময় হতো। সমঝোতা হতো। সংকট নিরসনে জাতীয় ঐক্যের একটি ফর্মুলা বেরিয়ে আসত। এটা হতে পারত গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনফারেন্স।
১৩. আমাকে বলা হয় সংস্কারপন্থি। আমি অকপটে স্বীকার করি, আমি সংস্কারে ছিলাম, আছি এবং থাকব। সংস্কার সবসময় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার জন্ম দেয়। এ ভাবনা থেকেই নতুন সমাজ নির্মিত হয়। রাষ্ট্রীয় জীবনে, সমাজ জীবনে রাজনৈতিক সৃজনশীলতার গতিপথ নির্ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার। বদ্ধ দরজা ভেঙে নবতর আলোয় সমাজ ও রাষ্ট্র উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। নতুন প্রেরণায় চলার শক্তি সামর্থ্য অর্জিত হয়। সংস্কারে আমি বলেছিলাম, ‘‘প্রধানমন্ত্রী যদি একইসঙ্গে দল ও সরকারের প্রধান থাকেন, তাহলে রাষ্ট্র ও সরকার একনায়কতন্ত্রের দিকে ধাবিত হয়। একনায়কতন্ত্র সবসময় গণতন্ত্রবিরোধী। সেখানে কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। কে কার কাছে জবাবদিহি নেবে। স্বচ্ছতা থাকে না। যেমনটি মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ বলেছেন, ‘গণতন্ত্রহীন অবস্থায় উন্নয়ন সর্বজনীন হতে পারে না।’ বাস্তবে হয়নি। গণতন্ত্রহীন অবস্থায় চাটুকার, ধান্ধাবাজ, মতলববাজ, লুটেরাশ্রেণি, সিন্ডিকেট-চক্ররা প্রধানমন্ত্রীর চারপাশ ঘিরে থাকে। আমলাতন্ত্র প্রশাসনকে গ্রাস করে। এটা অবধারিত। পাকিস্তানের গোলাম মোহাম্মদ, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, ইস্কান্দার মীর্জা, এমনকি জিন্নাহ পর্যন্ত আমলাতন্ত্রের হাতে বন্দি ছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় সেই আমলাতন্ত্রের ছোবলে পাকিস্তান আজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আমাদের কী হবে? উপরে উল্লেখিত সব কালো ছায়ার সিম্পটম থাবা বিস্তার করে আছে। আমি জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দু’হাতে কাজ করেন। দিন-রাত কাজ করেন। কিন্তু সে কাজের ফলাফল জনগণের হাতে কতটুকু পৌঁছে? মধ্যখানে মতলববাজ আমলা, লুটেরা, ধনিকশ্রেণি জনগণের অর্থ, সুযোগ-সুবিধা লুটে খাচ্ছে। লাখ টাকার প্রজেক্ট বাড়তে বাড়তে কোটি টাকা হয়। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন ও সাধনা বাস্তবায়নের পথে এরাই বাধা। প্রয়োজন অবিলম্বে যৌথ নেতৃত্ব। যেমনটি বঙ্গবন্ধু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বন্দি হয়ে পাকিস্তান কারাগারে গেলেও জাতীয় চার নেতা ছিলেন তার যৌথ নেতৃত্বের সারথি। আপনার কে বা কারা আছে? ভুল পথে সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে, মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে যারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আজকে ভীতির রাজনীতি সৃষ্টি করেছে, দুঃসময়ে তারা থাকবে না। সত্য এই যে, ভয়ের পরেই জয়।
অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ : ১৯৭২ সালের খসড়া সংবিধান প্রণেতাদের একজন; সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী