নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
উৎসবের মাসে অর্থনীতিতে বিষাদের ছায়া
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![উৎসবের মাসে অর্থনীতিতে বিষাদের ছায়া](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2023/04/08/image-663247-1680902198.jpg)
দেশে-বিদেশে শুধুই অশান্তির খবর; আশঙ্কা, অস্বস্তি ও অস্থিতিশীলতার খবর। যেন কোথাও শান্তি নেই। এটা পবিত্র রমজান মাস। আকাশ মোটামুটি মেঘে ঢাকাই থাকে, কোথাও কোথাও বৃষ্টি হয়। বেশ কিছুদিন পর রোজাদাররা কিছুটা স্বস্তির মধ্যে পবিত্র রোজা পালন করছেন।
সামনে বড় উৎসব ঈদ। আবার রয়েছে বাঙালির বড় উৎসব পহেলা বৈশাখ। চারদিকে যেমন ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, তেমনি রয়েছে ঈদের প্রস্তুতি, পহেলা বৈশাখের প্রস্তুতি। ব্যবসায়ীরা, ছোট-বড় উভয়ই ব্যস্ত ব্যবসার জন্য। কেনা-বেচার প্রত্যাশায় সবাই। খুচরা দোকানিরা দোকানে দোকানে পণ্য তুলে স্টক করছেন ঈদের বাজার, পহেলা বৈশাখের বাজারের জন্য। কেউ বাকিতে পণ্য তুলছেন, তুলছেন ট্রেড-ক্রেডিটে। কেউ ঋণ নিয়েছেন ব্যাংক থেকে। কেউবা ঋণ নিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে। পণ্যের দাম বেশি, মূল্যস্ফীতির বাজার। পুঁজির প্রয়োজন বেশি।
এরই মধ্যে ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা দোকানে দোকানে জামা-কাপড়, প্যান্ট-শার্ট, শাড়ি, লুঙ্গি, পায়জামা-পাঞ্জাবির স্টক গড়ে তুলেছেন। সুপার মার্কেটগুলোরও একই প্রস্তুতি। তাঁতিরা ব্যস্ত প্রতিবছরের মতো। ফলওয়ালারা ব্যস্ত, সেমাইওয়ালারা ব্যস্ত। দর্জিদের ব্যস্ততাও বেড়েছে। ইফতারের বাজার বেশ কিছুটা রমরমা। এদিকে চলছে পহেলা বৈশাখের প্রস্তুতি। শিল্পীরা প্রস্তুত কালি-তুলি নিয়ে। নাটক নির্মাতারা ব্যস্ত নাটক তৈরি নিয়ে। পত্রিকাওয়ালারা ব্যস্ত ঈদ সংখ্যা তৈরিতে। বিশাল কর্মযজ্ঞ। চারদিকে একটা উৎসবের আমেজ। এরই মধ্যে ঘটে গেল বড় দুর্ঘটনা।
মনে হচ্ছে দেশ হয়ে উঠছে, বিশেষ করে ঢাকা শহর হয়ে উঠছে আগুনের লীলাভূমি। ঘন ঘন লাগছে আগুন। প্রাণ যাচ্ছে, মালামাল নষ্ট হচ্ছে। অর্থনীতি হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। এমনই এক ঘটনা, সর্বশেষ ঘটনা ঘটে গেল মঙ্গলবার। বঙ্গবাজার, যা আমাদের ঢাকা শহরে নিম্নবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্তের বড় একটা খুচরা ও পাইকারি বাজার, তাতে আচমকা আগুন লাগে। গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এটা-গুলিস্তানের কাছে। সহস্রাধিক দোকান পুড়ে ছাই।
আশপাশে কোনো জলাধার, খাল-পুকুর না থাকায় আগুন প্রশমিত করতে সময় লেগে যায় অনেক। ফলে জামা-কাপড়ে ভর্তি বাজার মুহূর্তেই ছাই হয়ে যায়। শত শত ব্যবসায়ী এখন রাস্তায়। তাদের নিজেদের পুঁজি গেছে। যারা ব্যাংক থেকে ঋণ করেছিলেন, তাদের ব্যাংকপুঁজি গেছে। অনেকেই আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করে স্টক গড়ে তুলেছিলেন সারা বছরের ব্যবসার আশায়। ছিল ট্রেড-ক্রেডিট, মহাজনদের ঋণ। সবই গেছে আগুনে। নিঃস্ব ব্যবসায়ীরা এখন সরকারের কাছে আকুল আবেদন করছেন সাহায্যের জন্য। কম করে হলেও হাজার কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়েছে। আবার কম করে হলেও ৫০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী পবিত্র ঈদের আগে পথে বসেছেন। চোখে-মুখে তাদের অন্ধকার।
বঙ্গবাজারের ঘটনা আচমকা অশান্তির খবর, অস্বস্তির খবর। খারাপ খবর, যা আমাদের মনকে বিষাদগ্রস্ত করে। আবার সারা দেশেই প্রতিদিন ঘটছে এমন সব ছোট ছোট খবর, যা কারও নজরে পড়ে না। আমরা ব্যস্ত বড় বড় খবর নিয়ে। এখন বড় খবর আগামী দিনের বাজেটের, নির্বাচনের। এরই নিচে চাপা পড়ে যাওয়া অনেক ছোট ছোট দুঃখ-বেদনার খবর আছে, যা আমাদের বিচলিত না করে পারে না।
এই যেমন সর্বসাম্প্রতিক খবর তরমুজের। এখন তরমুজের মৌসুম। পবিত্র রমজানে এর চাহিদা বেশ। কৃষকরাও তরমুজ ফলিয়েছেন জান দিয়ে। কিন্তু প্রকৃতি বিরূপ। গলাচিপার একটি খবরে দেখলাম সেখানকার কৃষকদের এখন মাথায় হাত। কেন? কয়েকদিনের বৃষ্টিতে তাদের তরমুজের খেত গেছে জলে তলিয়ে। শত শত তরমুজ কৃষকের এখন বড় দুর্দিন। তারা কীভাবে ঈদ করবেন? ছেলেমেয়েদের জামা-কাপড়ের জোগান কোত্থেকে আসবে-এসব চিন্তা তাদের। শুধু তরমুজ নয়, সারা দেশে মাঝেমাঝে বৃষ্টির ফলে রবিশস্যও নষ্ট হচ্ছে।
জমিতে এখন সারা দেশে বাদাম, কলাই, মুগডাল, আলু, সূর্যমুখী ইত্যাদি ফসল। এসবই মৌসুমি রবিশস্য। মাঝেমাঝে যে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে এসব ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার সামনে রয়েছে বোরোর ফসল। এ সময়ে অকাল বৃষ্টি হয়, ঝড়-বৃষ্টি হয়। বিপুলসংখ্যক কৃষক নানা আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। তারা ফসল ঘরে তুলতে পারবেন তো?
এদিকে বরিশালের লঞ্চ-ব্যবসার অবস্থা খারাপ। লঞ্চে যাত্রী কম। অনেকে লঞ্চ ব্যবসায় লোকসান দিচ্ছেন। যারা ব্যাংকের ঋণ নিয়েছেন, তারা ঋণের কিস্তি দিতে পারছেন না। তেলের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় লঞ্চ ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন। পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে বিপুলসংখ্যক যাত্রীর বিকল্প এখন সড়ক পরিবহণ। এ অবস্থায় পড়ে মালিকরা ধীরে ধীরে লঞ্চ ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন। বেকার হচ্ছে হাজার হাজার লোক।
এই যে একটি ছোট ঘটনা, তার খবর কয়জন আমরা জানি? কয়জন আমরা জানি যে, যশোরের গরুর খামারিরা খামার তুলে দিচ্ছেন? খামার বন্ধ হচ্ছে, খামারের আকার ছোট হচ্ছে। খামারিদের অভিযোগ-গরুর খাবারের মূল্য যেভাবে বেড়েছে, তাতে তারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। তাই খামারিরা গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন লোকসানে। ফলে খামারভিত্তিক ব্যবসাতেও নেমেছে মন্দা। এই দুঃখের কথা, অশান্তির কথা আমরা কয়জন জানি?
এদিকে গাজীপুরে অনেক পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করছেন। সামনে ঈদ। কীভাবে করবেন তারা ঈদ? বোঝা যায় পোশাক শিল্পের অনেক মালিক এখন ‘দোষ’ চাপাতে চাইছেন সরকারের ওপর। তারা ঈদের আগে বেতন-ভাতা শোধে সরকারের সাহায্য চান। জরুরি ভিত্তিতে রপ্তানি ভর্তুকি অথবা নগদ সহায়তার টাকা তাদের দিতে হবে-এই তাদের দাবি। অথচ সরকারের টাকার টানাটানি চলছে। ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’-এই অবস্থা সরকারের। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকেও ঋণ নিচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ অবস্থায় শ্রমিকরা রয়েছেন মানসিক অশান্তিতে। ঈদের আগে বেতন-ভাতা পাওয়া যাবে তো?
তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ শ্রমিক, তাঁতি। ঈদের বাজার ঘিরে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় নানা প্রত্যাশা। কিছুদিনের জন্য হয়তো তারা কাজ পাবেন, চলবে সংসার। শত হোক, বছরের একটা উৎসব। এক্ষেত্রেও সিরাজগঞ্জের খবর অস্বস্তির। ঈদ উপলক্ষ্যে সিরাজগঞ্জের তাঁতিরা শাড়ি-লুঙ্গি তৈরিতে কর্মব্যস্ত থাকলেও পাইকারি বাজার এখনো জমে ওঠেনি। খবরে প্রকাশ, এবারের বেচা-কেনা গেল বছরের চেয়ে কম হবে। গেল বছর ঈদ উপলক্ষ্যে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় সিরাজগঞ্জের তাঁত ব্যবসায়। এবার তাঁত ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ খাতে বেচা-কেনা হতে পারে বড়জোর সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার। ফলে সেখানকার ৫০ হাজার তাঁতি পরিবার দিন কাটাচ্ছেন আশঙ্কার মধ্যে। ছোট খবরই বটে!
চট্টগ্রামের জুতার ব্যবসায়ীদের একটা খবর দেখলাম। আজকাল ভৈরবসহ দেশের নানা জায়গায় হাতে জুতা তৈরির অনেক কারখানা হয়েছে। সেসবের ব্যবসার অবস্থাও ভালো যাচ্ছে না। তাদেরও আশঙ্কা এবার জুতার ব্যবসায় মন্দা যাবে। এদিকে অনেক কারখানা, ব্যবসায় লোকের চাকরি যাচ্ছে। অনলাইন ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। অর্ডারি ফুডের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। ‘ফুড পান্ডার’ অনেক কর্মচারী ছাঁটাই হয়েছে। খবরে দেখলাম, মোটরসাইকেলের ব্যবসাতেও মন্দা শুরু হয়েছে। লাইসেন্স ইত্যাদির কড়াকড়ি এর একটা কারণ। এছাড়া রয়েছে সাধারণ মন্দার প্রভাব।
পবিত্র রমজান মাসের প্রায় অর্ধেক এখন। বিভিন্ন বাজারের ওপর করা একটি প্রতিবেদনে দেখলাম এখনো বাজার জমে ওঠেনি। ঈদ পোশাকের দামও এবার বাড়তি। অথচ মানুষের আয় বাড়েনি। এমনকি উত্তরবঙ্গের ঢাকাস্থ রিকশা শ্রমিকদের দৈনিক রোজগারও আগের চেয়ে কম। যারা স্বাস্থ্যবান তাদের রোজগার আছে বেশি শ্রম দেওয়ার ক্ষমতাবলে। বাকিদের রোজগারে ভাটা পড়েছে। এসবই ছোট খবর। ছোট ছোট দুঃখের কথা। এসব খবর কে নেয়? তবে কি বড় খবরে কোনো আশাপ্রদ ঘটনা আছে? দেখা যাক তা।
না, বড় বড় খবরেও কোনো স্বস্তির বিষয় নেই। এখানেও মন্দা। সরকার যখন আগামী বছরের জন্য বিশাল টার্গেট নিয়ে বাজেট তৈরিতে ব্যস্ত, তখন বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) আমাদের সুখবর দিচ্ছে না। কাগজে দেখলাম, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সরকার ধরবে সাড়ে ৭ শতাংশ। এটা কীভাবে সম্ভব হবে তা-ই প্রশ্ন। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হতে পারে মাত্র ৫ দশমিক ২ শতাংশ। তারা অবশ্য আগে বলেছিল, প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি তারা কমিয়ে দেখছে এখন।
এদিকে আরেক দাতা প্রতিষ্ঠান এডিবিও বলছে প্রায় একই কথা। তারা আগে বলেছিল, আমাদের প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। সর্বশেষ প্রতিবেদনে তারা বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন থেকে সামান্য একটু বেশি। অবশ্য দুই প্রতিষ্ঠানই বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। সেটা পরের কথা। এ মুহূর্তের খবর হচ্ছে, মার্চ মাসে রপ্তানি গেল বছরের মার্চের তুলনায় কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। আবার ভালো খবর আছে রেমিট্যান্সে। রেমিট্যান্সের পরিমাণ মার্চ মাসে ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। অথচ ফেব্রুয়ারি মাসেও তা ছিল মাত্র ১ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার।
তবে এটা সাময়িক হতে পারে। কারণ মার্চ মাসে ঈদ সামনে রেখে রেমিট্যান্স বেশি এসেছে বলে ধারণা। কিন্তু অশান্তির খবর ব্যালেন্স অব পেমেন্টে (বিওপি)। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বিওপি ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৭২০ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে তা ছিল ৫৩০ কোটি ডলার। আমদানি-রপ্তানি ও নানাবিধ বৈদেশিক আয়-ব্যয়ের এই ঘাটতি বাড়তে থাকলে ডলারের দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অতএব সাবধান থাকাই বাঞ্ছনীয়।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়