শতফুল ফুটতে দাও
বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিসর ও সীমাবদ্ধতা
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় আদর্শের অন্যতম স্তম্ভ হলো গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের জন্য এদেশের মানুষ অকাতরে জীবন দিয়েছে।
লক্ষ্য ছিল একটাই, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যদি গণতন্ত্র নামক স্তম্ভের ওপর বহাল হয়, তাহলে এদেশের নাগরিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতে পারবে, সরকারের সমালোচনা করতে পারবে, ভিন্নমত পোষণ করতে পারবে, মনের মধ্যে যে ভাবধারা আঁকুপাঁকু করতে থাকে, তা প্রকাশ করতে কোনোরূপ বাধাগ্রস্ত হবে না। মানুষ বিবেকসম্পন্ন সচেতন প্রাণী।
নিজের মনের কথা, প্রাণের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে যদি কেউ কথা হারিয়ে ফেলে, তাহলে বুঝতে হবে শক্তিধররা দৈত্যের মতো তার বুক চেপে ধরে বসে আছে।
বাংলাদেশে অনেক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল চালু হয়েছে। প্রতিযোগিতার বাজারে এর মধ্যে কয়টি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ার আগে ভাবতে হবে টেলিভিশন চ্যানেল বিশেষের দর্শক-শ্রোতা কারা হবেন এবং তারা কী শুনতে বা দেখতে পছন্দ করেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, শুধু শিশুদের জন্য অথবা নারীদের জন্য অথবা খেলাধুলার জন্য, ধর্মীয় বিষয়াদি বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য, শুধু সংগীত অথবা শুধু নাটকের জন্য একটি টেলিভিশন চ্যানেল বিবেচিত হতে পারে। সমস্যা হলো, বাংলাদেশের টেলিভিশনের দর্শক-শ্রোতা ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে রাজনীতি নিয়ে অনুষ্ঠান দেখতে চায়। বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো টকশো’র মাধ্যমে রাজনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য একটি অনুষ্ঠান চালু করেছে। সমস্যা হলো, দেশ শাসন করছে একটি দলীয় সরকার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দলীয় সরকার এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে দলীয় সরকারকে অবশ্যই গণতান্ত্রিকতার নীতি ও নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। কোনো একটি দল যখন একটি দেশে সরকার গঠন করে, তখন সরকার যদি নিজ দলের লোকজন ছাড়া অন্য মতের মানুষদের এ সিস্টেমে প্রবেশাধিকার না দেয়, তাহলে সেই সরকারের গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে অবশ্যই কথা উঠবে। এ অভিযোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দলীয় সরকার কমিটি সিস্টেমের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে সমালোচনার সুযোগ অনেকটাই হ্রাস পায়। বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের কমিটি গঠন করা যায়। তবে এ কমিটিতে বিরোধীদলীয় নেতার প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। সমাজের বিচিত্র ইন্টারেস্ট গ্রুপেরও প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে।
বাংলাদেশে যে বিপুলসংখ্যক টেলিভিশন চ্যানেল চালু হয়েছে, সেগুলোর মালিকদের রাজনৈতিক আনুগত্য নিয়ে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এগুলোর শতকরা ৯৫টিই একই রাজনৈতিক গোত্রের। সে কারণে এসব টিভি চ্যানেল দর্শকদের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। যে কোনো টেলিভিশন চ্যানেল অন করলে দেখা যাবে স্তুতির ছড়াছড়ি। অনেক সময় দর্শক নিরুৎসাহ বোধ করে টিভি দেখাই বন্ধ করে দেন। দু’চার মাস আগেও দেখেছি টকশো অনুষ্ঠানে সরকারি দল ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন এমনভাবেই টকশো’র কাঠামোটি নির্মাণ করা হয়। এসব ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানের অ্যাঙ্কর অবধারিতভাবে দলকানা কেউ একজন হবেন। সাধারণভাবে অ্যাঙ্করের দায়িত্ব হলো আলোচকদের সূত্র ধরিয়ে দেওয়া। এর বেশি কিছু নয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, অনুষ্ঠানে অ্যাঙ্কর এমন এক ব্যক্তি, যিনি অনুষ্ঠানের আলোচকদের চেয়েও দলীয় আনুগত্যে চরম নিষ্ঠাবান। এর ফলে টকশোগুলো শাসক দলের নীতি ও কার্যক্রমের স্তুতিবাক্যের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। গত কয়েক বছরে টেলিভিশনের টকশো’র অনুষ্ঠানগুলো আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে এবং যে উদ্দেশ্যে টকশো আয়োজন করা হয়, তার বাইট ভোঁতা হয়ে গেছে।
কাজী আবদুল ওদুদ তার ‘ব্যক্তির স্বাধীনতা’ প্রবন্ধের শুরুতে লিখেছেন, সেদিন একজন মনোস্বিনী ইউরোপীয় মহিলার সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তিনি একটি ভালো মন্তব্য করেছিলেন; ‘ব্যক্তি আজ একান্ত অসহায়, তার বিদ্যা, সাধুতা, দক্ষতা সবই অর্থশূন্য, যতক্ষণ না সে কোনো শক্তিশালী সংঘে যোগ দিচ্ছে। কথাটা আজ খুবই সত্য, আর সেজন্য কিছু চমকপ্রদও। সামগ্রিকতা আজ আকাশে-বাতাসে। গঠন ও ধ্বংস দুয়েরই বিপুল আয়োজন আজ মানুষের সামনে। সেসব বিরাট আয়োজনের সামনে ব্যক্তি তার নগণ্য দেহ আর পরিমিত ক্ষমতা নিয়ে বাস্তবিকই অসহায়।’ একথা সত্য যে, ব্যক্তি যখন তার চিন্তা গঠনে সংঘবদ্ধ শক্তির মধ্যে বিলীন হয়ে যায় না, তখন তার পক্ষে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন অথবা জনপ্রিয়তা লাভ সম্ভব হয় না। এ ব্যাপারটি খুব সহজেই আমরা বুঝতে পারি। যদি কোনো ব্যক্তি সংঘ শক্তিতে অংশীদার হন, তখন তার পক্ষে ওই সংঘ প্রচারণা চালিয়ে তাকে এক মহান ব্যক্তিতে পরিণত হতে সাহায্য করে। গণতন্ত্রে দল গঠন ও সম্প্রসারণ আমরা অস্বীকার করতে পারি না; কিন্তু গণতন্ত্র যখন বল্গাহীন দলতন্ত্রে পরিণত হয়, তখন অনেক সময় দেখা যায়, নাগরিক সমাজের কোনো একজন ব্যক্তির বক্তব্য যদি শুধু যুক্তিসংগত নয়, দেশের জন্যও মঙ্গলজনক, তখন তার মতের প্রতি অবহেলা চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
দেশে বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার ঘাটতি রয়েছে। এ কথা শাসক দলের সমর্থকরা খোলামেলাভাবে স্বীকার না করলেও একান্ত আলোচনায় তা মেনে নেন। সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতি তারা চোখবুজে যে সমর্থন দেন, সেই সমর্থন যে যুক্তিসংগত নয়, তা তারা একান্তে মেনে নেন। দেখা যাচ্ছে, এখনো আমাদের দেশে ব্যক্তিবিশেষের বাহ্যিক অবস্থান তার মস্তিষ্ক অনুমোদিত শেষ কথা নয়। তিনি বা তারা তাদের চিন্তার ব্যাপারে ‘ব্ল্যাকহোলে’ এখনো ডুবে যাননি। যে সমাজের মানসরাজ্যে বিবেকের শেষ দংশনটি বজায় থাকে, সে সমাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে ফ্যাসিবাদকে অবশ্যই পরিহার করবে এবং যুক্তি ও বুদ্ধির কাছে মস্তক অবনত করবে। এ রকম একটি সমাজে আজ হোক কিংবা কাল হোক, ফ্যাসিবাদী প্রবণতার মৃত্যু ঘটতে বাধ্য। টেলিভিশনের টকশোতে আজকাল দেখা যায়, সরকার-সমর্থক আলোচক ব্যক্তি তার প্রতিপক্ষ সম্পর্কে বলেন, কে বলে দেশে বাক স্বাধীনতা নেই! আপনি তো সরকার সম্পর্কে হেন সমালোচনা নেই যা করেননি। দৃশ্যত এমনটি মনে হতে পারে। তবে যে মানুষটি অনুযোগ করল, দেশে বাক-স্বাধীনতা নেই, তার এ অনুযোগটি মামুলি মনে করার কোনো কারণ নেই। মানুষ অনেক কথা বলতে চায়। তার কষ্টের কথা, তার আনন্দের কথা, তার প্রাপ্তির কথা, তার অপ্রাপ্তির কথা, তার তৃপ্তি ও অতৃপ্তির কথা। মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন, মানুষ মনের ভাব প্রকাশে পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন না থাকলে তার অনুভূতি অবদমিত অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। মানুষ অনেক কারণেই তার মনটাকে ছিপি দিয়ে অবরুদ্ধ করে। মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব, তার ফলে তাকে সমাজের বিধিনিষেধগুলো মেনে নিতে হয়। মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া যে এক কথা নয়, তা তো আমরা জেনেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ থেকে। রাষ্ট্রের স্বৈরতন্ত্র এবং সামাজিক বিধিনিষেধ এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করে, যার ফলে কথা বলার চাইতে না বলাতেই মানুষ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় আমাদের সমাজ অনেকটা মৃত সমাজে পরিণত হয়। আমরা অবশ্যই একটি রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তের মধ্যে বাস করতে চাই। আমাদের নিরাপত্তার জন্য। আমি এমন কোনো সামাজিক চুক্তিতে (Social contract) অংশীদার হব না, আমার ব্যক্তিত্ব খর্ব করে আমাকে জোয়ালবাঁধা পশুতে পরিণত করবে।
কাজী আবদুল ওদুদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘কিন্তু এ সমস্যা কি বিশেষভাবে আজকার? অসভ্য যুগ, অর্ধ সভ্য যুগ, ধর্মতান্ত্রিক যুগ, সামন্ততান্ত্রিক যুগ, কোন যুগে ব্যক্তি নগণ্য ছিল না? অবশ্য বহু অতিমানব এসব যুগে জন্মেছিলেন। বিস্ময়কর হয়েছিল তাদের প্রভাব। কিন্তু সে প্রভাবও প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তির প্রভাব নয়, বিশেষ বিশেষ ভাবের বা ভাবধারার প্রভাব-অতিমানবে তা হয়েছিল মূর্ত। অতিমানবদের সাধারণত মানুষই ভাবা হয়নি। তাদের মানুষ ভাবা হয়েছে তখন, যখন তাদের বহু ত্রুটি অনেকের বুদ্ধিতে ও বিচারে ধরা পড়েছে। তখন অতিমানবের পদ তারা হারিয়েছে-অন্তত এসব বিচারক ও তাদের অনুবর্তীদের চোখে। অতিমানবরা যে যুগে অতি মানবত্ব হারালেন, সেই অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দীই এক হিসাবে ব্যক্তি স্বাধীনতার যুগ। কিন্তু সেই ব্যক্তি স্বাধীনতাও অচিরে কলুষিত হলো কাঞ্চনকৌলীন্যে ও স্বেচ্ছাচারে। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির বা শ্রেণির সেই কাঞ্চনকৌলীন্য আর স্বেচ্ছাচারের প্রতিক্রিয়াই তো জন্ম হয়েছে এ কালের নির্ধনদের সামগ্রিকতার আর জাতীয় সামগ্রিকতা।’
দার্শনিক রুশো বলেছিলেন, মানুষের জন্ম হয় স্বাধীনভাবে, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলে আবদ্ধ। আজকের দ্বন্দ্ব সভ্যতার সঙ্গে সভ্যতার নয়, এ দ্বন্দ্ব স্বাধীনতার সঙ্গে পরাধীনতার।
ডা. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ