গণহত্যার দায় এড়াতে পারে না পাকিস্তান
ডা. এম এ হাসান
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একাত্তরে সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধকে পাকিস্তানি বাহিনী অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে দেশরক্ষা বাহিনীর শক্তি প্রয়োগ হিসাবে দেখাতে চেয়েছে। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো, প্রাথমিক অবস্থায় জনগণের স্বাভাবিক প্রতিরোধের পর একটি ভোটে নির্বাচিত কর্তৃপক্ষের প্রধান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, যা সব সংজ্ঞায় মুক্তিযুদ্ধ হিসাবেই অভিহিত হয়।
এ প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের দিক থেকেও কোনো অবস্থাতেই একাত্তরের যুদ্ধকে একটি ‘অভ্যন্তরীণ সংঘাত’ হিসাবে অভিহিত করে ব্যাপক গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের কলঙ্কজনক অধ্যায়কে ইতিহাসের কৃষ্ণগহ্বরে নিমজ্জিত করা যাবে না।
প্রকৃত সত্য হলো, পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ’৭১-এর নয় মাসে এক কোটিরও বেশি বাঙালিকে ঘরছাড়া করে Forced migration-এ বাধ্য করে। এটাই তো একটা বড় যুদ্ধাপরাধ। প্রমাণ রয়েছে, প্রথম ৬ মাসে হত্যা ও ধর্ষণের পর সম্পদ লুট করে ভিটেমাটিতে আগুন দিয়ে ৬৯.৭১ লাখ হিন্দুকে দেশছাড়া করে তারা ethnic cleansing-এর কাজটি সমাধা করেছিল (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, পৃষ্ঠা-৪৪৬, ভারত সরকারের বৈদেশিক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত)। পাকিস্তানি বাহিনী দেশে প্রায় তিন হাজার হিন্দুকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতও করেছিল।
ওয়ার ক্রাইম্স ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা অনুযায়ী, এ যাবৎ গণকবর ও গণহত্যার স্পট আবিষ্কৃত হয়েছে প্রায় ৯৪৫টি। ৮৮টি নদী ৬৫টি ব্রিজের উপরে হত্যা-নির্যাতনের শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। চার লাখ ষাট হাজার নির্যাতিত নারীর পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনে পাকি দোসররা সহায়তা করলেও পাকিস্তানি বাহিনী নিজেরাই এসব ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও গণহত্যায় অংশ নেয়। ধর্ষণের শিকার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেক পাকিস্তানি অফিসার ও সেনার নাম উল্লেখ করেছেন।
এ প্রেক্ষাপটে ওয়ার ক্রাইম্স ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ২৮৭ জন যুদ্ধাপরাধীকে শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে ১৯১ জন বড় যুদ্ধাপরাধী। ৩০ থেকে ৪০ জন শীর্ষ অপরাধী। প্রায় ১ হাজার ৭৫৭ জন এদেশীয় দালাল তথা বদর সদস্য ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।
বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিদের আগ্রাসন ও গণহত্যাযজ্ঞ কতটা পরিকল্পিত ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ওই সময়ে চট্টগ্রামের রেজিমেন্ট কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম আর মজুমদারের বক্তব্যে। তিনি ১৬ জুন ২০০৩ তারিখে ওয়ার ক্রাইম্স ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, ১৯৭০-এর ডিসেম্বরের শেষে বা ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন। ওই চিঠিতে কর্তৃপক্ষ জানায়, শেখ মুজিবের ছয় দফা বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তান আর্মিতে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য ক্ষুণ্ন হবে এবং তাদের সামরিক স্বার্থ ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হবে।
চিঠির শেষ অংশে লেখা ছিল-‘Therefore the Army cannot allow Sheikh Mujib to become the Prime Minister of Pakistan. ওই চিঠিতে সম্ভবত Director Military Operations (DMO) অথবা Director Military Intelligence-এর স্বাক্ষর ছিল। এ চিঠিটার প্রসঙ্গ সিদ্দিক সালিকের বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সিদ্দিক সালিক সেখানে বলেছেন, ওই সময় একজন জেনারেল এখানে এসেছিল এবং সে গভর্নর হাউসে বলেছিল, ‘Don't worry, we will not allow these black bustards to rule over us.’
পাকিস্তানি শ্বেতপত্রে বাঙালি কর্তৃক বিহারি নির্যাতনের বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন, মার্চের শুরুতে রেলওয়ে কলোনিতে একটি দাঙ্গা হয়েছিল। ওই দাঙ্গাটি পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের কমান্ডো দ্বারা সৃষ্ট ছিল। এ দাঙ্গায় রেলওয়ে কলোনি এলাকায় নিহতদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যাই ছিল বেশি এবং তাদের ঘরবাড়িই বেশি পোড়ানো হয়েছিল। এ সময়ে রেলওয়ে কলোনিতে কর্মরত ক্যাপ্টেন ফাতেমির অধীনে ছিল একজন পাঞ্জাবি অফিসার।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক রচনায় প্রয়াত জেনারেল জিয়াউর রহমান উল্লেখ করেছেন-‘ফেব্রুয়ারির শেষদিকে বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠছিল, তখন আমি একদিন খবর পেলাম তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের সৈনিক চট্টগ্রামে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিহারিদের বাড়িতে বাস করতে শুরু করেছে।
খবর নিয়ে আমি আরও জানলাম, কমান্ডোরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে বিহারি বাড়িগুলোতে জমা করেছে এবং রাতের অন্ধকারে বিপুলসংখ্যক তরুণ বিহারিদের সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে। ওই সময়ে আমার ব্যাটেলিয়নের নিরাপত্তা এনসিওরা আমাকে জানাল, প্রতিদিন সন্ধ্যায় ২০ বালুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা বেসামরিক পোশাক পরে বেসামরিক ট্রাকে কোথায় যেন যায়। তারা ফিরে আসে আবার শেষরাতের দিকে। আমি উৎসুক হলাম। লোক লাগালাম খবর নিতে। খবর নিয়ে জানলাম প্রতিরাতেই তারা যায় কতগুলো নির্দিষ্ট বাঙালি পাড়ায়। নির্বিচারে হত্যা করে সেখানে বাঙালিদের। এ সময় প্রতিদিনই ছুরিকাহত বাঙালিকে হাসপাতালে ভর্তি হতে শোনা যায়।’
জেনারেল টিক্কা ও তার সহকর্মীদের এই বীভৎস গণহত্যাযজ্ঞে শুধু ২৫ মার্চের মধ্যরাতেই ঢাকা নগরীতে ঘুমন্ত ও হঠাৎ ঘুমভাঙা প্রায় ৭ হাজার নিরীহ বাঙালি নিহত হন। ২৭ মার্চ দুপুর পর্যন্ত মাত্র আড়াই দিনেই নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৩ হাজারে। ২৫ মার্চ থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা জেলায় নিহতদের সংখ্যা ৩০ হাজার পেরিয়ে যায় এবং যুদ্ধের নয় মাসে এ গণহত্যা কখনো থেমে থাকেনি। এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ দেশের সেরা সব বুদ্ধিজীবীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে পাকিস্তানি আর্মি।
ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ শত শত বুদ্ধিজীবী হত্যায় যারা ঘৃণ্য ভূমিকা রাখে, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল-যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি অফিসার জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল নিয়াজি, জেনারেল রাও ফরমান আলী, জেনারেল রহিম, জেনারেল জামশেদ, জেনারেল গুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার ফাতেমি, ব্রিগেডিয়ার রাজা, ব্রিগেডিয়ার আসলাম, ব্রিগেডিয়ার বশির, ব্রিগেডিয়ার শরীফ, ব্রিগেডিয়ার শফি, ব্রিগেডিয়ার ইয়াকুব মালিক, লে. কর্নেল তাজ, লে. কর্নেল আতিক মালিক, মেজর রিয়াজ, মেজর ইফতেখার, মেজর সরফরাজ, মেজর নাদের পারভেজ, ক্যাপ্টেন ইয়াসিন, ক্যাপ্টেন তাহির, কমান্ডার আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীন প্রমুখ। এদের নেতৃত্ব দেন জেনারেল রাও ফরমান আলী, জেনারেল জামশেদ ও জেনারেল রহিম। তাদের সহযোগিতা করেন জেনারেল হামিদ, জেনারেল টিক্কা, জেনারেল নিয়াজি প্রমুখ।
এ কাজে প্রণোদনা জোগান জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা এবং ‘লারকানা ষড়যন্ত্র’ খ্যাত ভুট্টো। পেছন থাকে সাম্রাজ্যবাদী গুরু যারা কমিউনিস্ট ফোবিয়ায় ভুগছিল এবং তাদের প্রতিনিধিরা, যারা ’৬৯ ও ’৭১-এর শুরুতে দৌড়ঝাঁপ করছিল। এদের দুই প্রতিনিধি ছিলেন মি. হেইট ও মি. ডুসপিক। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ডিরেক্টর জেনারেল অব ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস বা ইনটেলিজেন্স সার্ভিসকে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন এবং ’৭১-এর আগস্টে বাংলার মাটিতে পরামর্শ ও দূতিয়ালির মাধ্যমে জেনারেল রাও ফরমান ও রহিম গংয়ের সঙ্গে সংযোগ চলমান রাখছিলেন। পরে তারা আগস্টের শেষ নাগাদ থাইল্যান্ডে চলে যান। আর ঘাতকদের দলিল সুরক্ষা করছিলেন যে জেনারেল রহিম, তিনি আত্মসমর্পণের একদিন আগে দলিল দস্তাবেজ এবং ঘনিষ্ঠ অনুচরদের নিয়ে কৌশলে একটি বিমানে করে বার্মায় (মিয়ানমার) চলে যান আন্তর্জাতিক সহায়তায়।
এভাবে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যার বিষয়টি Crime Against Humanity of Murder এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে আচরণ Crime Against Humanity of Inhumane Acts and Degradation-এর আওতায় পড়ে। এছাড়া রয়েছে অসংখ্য মানুষের গুম ও Enforced Disappearance হওয়ার তথ্য।
বাঙালি জাতিকে চিরতরে নির্মূল করার লক্ষ্যে ঊর্ধ্বতন পাকিস্তানি সমরনায়করা এবং তাদের অধস্তন সেনারা মানবতাবিরোধী যে অপরাধগুলো করেছে তা হলো-১. ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা শহরসহ দেশের সর্বত্র নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, লুট, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা সাধন। ২. সামরিক পদক্ষেপ শুরুর পর গ্রামাঞ্চলগুলোতে তথাকথিত দুষ্কৃতকারী দমনের নামে নির্বিচার হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও সাধারণের সম্পত্তির ধ্বংস সাধন; ৩. শুধু সামরিক অভিযানের প্রথমদিকেই নয়, একাত্তরের ডিসেম্বরে যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী ইত্যাদি পেশাজীবীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা; ৪. ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও সৈন্যদের এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিরস্ত্র করার সময় বা বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে তাদের শঠতামূলকভাবে হত্যা করা এবং তাদেরকে Fair Trial-এর সুযোগ না দেওয়া; ৫. পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ও সৈন্যদের দ্বারা প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এবং জাতির অহংকারকে ধ্বংস করার জন্য সাড়ে চার লাখের বেশি বাঙালি নারীকে নির্যাতন ও ধর্ষণ এবং বহু নারীকে হত্যা করা; ৬. যুদ্ধ চলাকালীন ও যুদ্ধ শেষে অন্তত সাড়ে সাতশ বাঙালি নারীকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া এবং পতিতালয়ে আটকে রাখা; ৭. নির্দোষ বেসামরিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা এবং ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত করা; ৮. অনেক নিরপরাধ নারী-পুরুষকে আইনবহির্ভূতভাবে বন্দি করে নির্যাতন ও গুম করে ফেলা; ৯. সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর পরিকল্পিতভাবে হত্যা, নির্যাতন, জাতিগত নিধন ও শুদ্ধি অভিযান চালানো।
উল্লিখিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও নারী নির্যাতন সংঘটনের দায়িত্ব একাত্তরে বাংলাদেশে যুদ্ধরত পাকিস্তানি সেনারা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারে না। হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট ছাড়াও পাকিস্তান ডিফেন্স জার্নালে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি জেনারেল তাজাম্মাল হোসেন মালিকের বক্তব্যেও এসব যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ মেলে।
একাত্তরের গণহত্যাযজ্ঞ কতটা ব্যাপক, ভয়ংকর ও পরিকল্পিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যাবে পাকিবাহিনীর অসংখ্য গণহত্যা স্পটের কয়েকটি চিত্র দেখলেই। কিশোরগঞ্জের বরইতলা গণহত্যার নির্মম শিকার হন ৩৬৬ জন গ্রামবাসী, মারাত্মক আহত হন আরও ১৩৪ জন। এক সকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী দালালরা প্রায় পনেরশ পুরুষকে বরইতলা গ্রামের রেললাইনের পাশে জড়ো করে মিটিংয়ের নাম করে।
এসব লোকের প্রায় অর্ধেককে উপস্থিত দালালরা আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত ইত্যাদি বলে পাকিস্তানি আর্মির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অবশিষ্ট লোকদের একজনের বাহু অন্যের সঙ্গে বেঁধে রেললাইনের উপর বসিয়ে দেওয়া হয় এবং ত্রিশ কেজি ওজনের বিশেষ ধরনের শাবলের আঘাতে একে একে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলা হয় প্রত্যেকের মাথা। এরপর মৃতদের ওপর ব্রাশফায়ার করা হয়। এত কিছুর পরও যাদের দেহ একটুআধটু নড়াচড়া করছিল, তাদের ওপর বেয়নেট চার্জ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা সবচেয়ে বর্বরোচিত ও নৃশংস গণহত্যা চালায় সৈয়দপুর শহরের কাছে গোলাহাটে। ১৩ জুন পাকিস্তানি আর্মি সৈয়দপুরের ১৫০ জন লোককে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাদের ভারতে পৌঁছে দেওয়ার নাম করে স্থানীয় রেলওয়ে স্টেশনে নেওয়া হয়। কৌশলে বন্দিদের পরিবারের বাকি সদস্যদেরও স্টেশনে আনা হয়। এই ফাঁকে চালানো হয় নির্বিচার লুটপাট।
ট্রেনের চারটি বগির পেছনের দুটিতে উঠানো হয় নারী ও শিশুদের এবং বাকি দুটিতে পুরুষদের। দুই কিলোমিটার যাওয়ার পর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের একটি কালভার্টে এসে ট্রেনটি থেমে যায়। তারপরই শুরু হয় বীভৎস হত্যাযজ্ঞ। একজন একজন করে নামানো হয় আর খোলা তলোয়ারের কোপে দু’খণ্ড করে ফেলা হয় তাদের দেহ। জানালা ভেঙে যারা পালাতে চেষ্টা করেছিলেন, তাদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। গোলাহাটে পাকিস্তানিদের এই হত্যাকাণ্ড থেকে সেদিন ২৩ জন পুরুষ পালাতে সক্ষম হলেও নারী ও শিশুদের কেউ পালাতে পারেনি। উপর্যুপরি ধর্ষণ শেষে নারীদের হত্যা করা হয়। ওইদিন গোলাহাটে পাকিবাহিনী ৪১৩ জনকে হত্যা করে।
২৬ মে বালাগঞ্জের বুরুঙ্গাতে সংঘটিত হয় আরও একটি নারকীয় গণহত্যা। শেরপুর থেকে ক্যাপ্টেন দাউদ খানের নেতৃত্বে পাকি আর্মি এখানে আসে। তারা মিটিংয়ের নাম করে প্রায় এক হাজার গ্রামবাসীকে স্থানীয় স্কুলমাঠে জড়ো করে। তাদের মধ্যে বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শ্রীনিবাস চক্রবর্তী, তার ছোট ভাই এবং তার বাবা ছিলেন। শ্রীনিবাস চক্রবর্তী জানান, এদের মধ্য থেকে বেছে নেওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় একশ নিরীহ লোককে লাইনে দাঁড় করিয়ে প্রথমে ব্রাশফায়ার করে পাকিসেনারা। চোখের পলকেই মানুষের মাথা, দেহ, হাত-পা সব ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। শ্রীনিবাস চক্রবর্তীর হাতে গুলি লাগে। এ সময় একটা একটা করে গুলি করছিল আর্মিরা।
এর মধ্যে মরার মতো পড়ে থেকে শ্রীনিবাস চক্রবর্তী অলৌকিকভাবে রক্ষা পান। এরপর কেরোসিন ঢেলে মৃতবৎ সবার শরীরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলে যারা তখনো বেঁচে ছিল তারা আগুনের তাপে চিৎকার করে ওঠে। আর্মি তখনো মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে পারেনি। চিৎকারের শব্দ শুনে তারা ফিরে আসে এবং গুলি চালায়। এতসব কিছুর পর আর্মি কিছুদূর চলে গেলে মানুষ পানি পানি বলে চিৎকার করে ওঠে। তাতে আর্মিরা ফিরে এসে আবার গুলি চালায়। ওই সময় একটা গুলি এসে লাগে শ্রীনিবাস চক্রবর্তীর পিঠে। তারপরও ঈশ্বরের ইচ্ছায় শ্রীনিবাস গণহত্যা স্পট থেকে সরে যেতে সক্ষম হন।
ক্যাম্পে আটক নিরীহ নারীদের ওপর পাকিদের বর্বরতার বিবরণ পাওয়া যায় ঝিনাইদহের রিজিয়া খাতুনের জবানবন্দি থেকে। যুদ্ধের শুরুতে পাকিবাহিনীর আক্রমণ থেকে জীবন বাঁচাতে পরিবার নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়েন রিজিয়া খাতুন। শৈলকুপার রানীনগরের কাছে পাকিদের এক ক্যাম্পে তিনি বন্দি হন। দুর্বিষহ ও ভয়ংকর ছিল সেই বন্দিজীবন। আলো-বাতাসহীন ছোট একটা কক্ষের মধ্যে আরও মেয়েদের সঙ্গে তাকে থাকতে হতো। কিল, ঘুসি, লাথি ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার। এর পাশাপাশি চলত পাকিদের উন্মুক্ত পাশবিক নির্যাতন। এ দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে রিজিয়াসহ অনেকেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গলায় দেওয়ার দড়ি তো দূরে থাক, কাপড়টুকু পর্যন্ত তিনি পাননি। পাকিরা তাদের কাপড় পরতে দিত না। ব্লাউজ, কামিজ এসব পরে থাকতে হতো। ক্যাম্পে এভাবে নির্যাতনে নির্যাতনে তিনি একসময় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। দুঃখের বিষয়, আমরা পাকিস্তানিদের এ বিচারের আওতায় আনতে পারছি না।
ডা. এম এ হাসান : চেয়ারপারসন, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, বাংলাদেশ