Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন

আমাদের সমাজে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা হয় এমন প্রতিষ্ঠান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ব ও বিদ্যা যে আলোয় জড়াজড়ি করে ঠাঁই খুঁজে নেয়, এমন প্রতিষ্ঠান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। একটি সমাজে বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সব বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করতে পারে না।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা কত উঁচু তা নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কী পরিমাণে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয় এবং কত চমৎকারভাবে জ্ঞানের বিতরণ নিশ্চিত হয় তার ওপর। ছোটবেলায় বাবা ও মায়ের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে শুনেছি। আমার বাবা বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করা শিক্ষকদের সম্পর্কে বলতেন।

আমার মা যদিও হাই স্কুলের গণ্ডি পার হননি, তা সত্ত্বেও চমৎকারভাবে আমাকে চিঠি লিখতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিনি চিঠি লিখতেন পোস্ট কার্ডে, লেফাফা ব্যবহার করে তিনি খুব কমই চিঠি লিখেছেন। একদিকে খরচ কম এবং অন্যদিকে মাতা ও পুত্রের মধ্যে প্রাইভেসির প্রয়োজন না থাকায় তিনি তার সন্তানদের পোস্ট কার্ডে চিঠি লিখতেন।

প্রাপকের ঠিকানা লিখতেন ইংরেজিতে। আমার মায়ের তিন ভাই ছিলেন। অর্থাৎ আমাদের মামা ছিলেন তিনজন। তাদের মধ্যে বড় ও ছোটজন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। মেজোজন ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করা সত্ত্বেও উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে পারেননি। তার চিন্তাভাবনায় একধরনের নৈরাজ্য ছিল। এ কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি কোন লাইনে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবেন। আমার মা ও বাবা দুজনের কাছেই শুনেছি আমার বড় মামা অধ্যাপক আব্দুল মোক্তাদির ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র। রসায়নে তিনিই ছিলেন প্রথম মুসলমান ছাত্র, যিনি এমএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন। আমার ছোট মামা ড. তরিকুল আলম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছিলেন। তিনি জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছিলেন। তৎকালে একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে এ রকম উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যোগসূত্র খুব বিরল ছিল। এ অর্থে আমি এবং আমার ভাই-বোনরা ভাগ্যবান এ কারণে যে, আমার দুই মামা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং এ পড়াশোনাকে পুঁজি করে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে অতিরিক্ত জ্ঞান আহরণ করেছেন।

আমি যখন কুমিল্লা জিলা স্কুলে পড়তাম, তখন স্কুলের হেড মাস্টার সাহেব আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন পরদিন একজন নামকরা মানুষ কুমিল্লা জিলা স্কুল দেখতে আসবেন। কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রতি তার এ আগ্রহের কারণ জানতাম না। যেটুকু অনুমান করা যায় তা হলো, তিনি নিজে এ স্কুলের ছাত্র ছিলেন অথবা কুমিল্লা জিলা স্কুলের সুনাম শুনে তিনি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। এ নামকরা মানুষটি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মুশফিকুর রহমান। ড. মুশফিকুর রহমানের গণিত শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তির কথা দলমতনির্বেশেষে সবাই মানতেন।

ড. মুশফিকুর রহমান আমাদের জিলা স্কুলের প্রতিটি ক্লাস পরিদর্শন করেন। প্রতিটি ক্লাসের কর্মরত শিক্ষকরা ড. মুশফিকুর রহমানের লেখাপড়া এবং জ্ঞানগম্যি সম্পর্কে ছাত্রদের অবহিত করেন। ড. মুশফিকুর রহমান আমাদের উপদেশ বর্ষণ করেননি। তার মুখে ছিল স্মিত হাসি। আমরা যারা কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র, তাদের জন্য এটি ছিল একটি অভিনব অভিজ্ঞতা। আমরা স্বচক্ষে দেখতে পেলাম একজন গণিতবিশারদকে, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর জ্ঞান বিতরণে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেন। সেখানে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। তিনি এখনো বেঁচে আছেন কি না, জানি না। তবে তার মতো একজন নামকরা গণিতজ্ঞকে স্বচক্ষে দেখে আমাদের মনপ্রাণ নিশ্চয়ই প্রণোদিত হয়েছিল। এভাবেই জ্ঞানগম্য মানুষরা আলোর বিচ্ছুরণ ঘটান। সেই আলোতে স্নাত হয়ে সমাজের বিশিষ্ট মানুষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি।

একসময় পূর্ববঙ্গে একটি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সেটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২১ সালে। ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে এমনটি যারা পছন্দ করেননি, তাদের অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। তারা সবাই ছিলেন উঁচু মাপের পণ্ডিত। এদের ক্লাসে যারা ক্লাস করতে পেরেছে, তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এর প্রতিষ্ঠাকালে কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দিয়েছিলেন মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের ধারণা ছিল, বাংলার মুসলিমপ্রধান অংশে যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, তাতে ইসলামি ভাবধারার চর্চা হবে। পাশ্চাত্যের সেকুলার ও যুক্তিবাদী জ্ঞানচর্চা সেখানে হবে না। তাই ব্যঙ্গ করে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মক্কা’ বিশ্ববিদ্যালয় বলে অভিহিত করা হতো। যতই দিন যেতে লাগল, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি হতে থাকল। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব অধ্যাপক পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছিলেন, তারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবতে শুরু করলেন এবং প্রায় সবাই ধীরে ধীরে চলে গেলেন। এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিহিত করা হলো ‘ধাক্কা’ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থাৎ এদের কেউ ধাক্কা মেরে বের করে দিচ্ছে। সামগ্রিকভাবে তখনকার সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়লেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে সাম্প্রদায়িকতা কোনোভাবেই জায়গা করে নিতে পারেনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় যত এগিয়ে আসতে থাকল, ততই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানী-গুণী হিন্দু শিক্ষকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদ্রুপ করে ওই একই গোষ্ঠী বলত ‘ফক্কা’ বিশ্ববিদ্যালয়।

আমাদের মতো দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গড়ে উঠছে না। বৈরী সামাজিক অবস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে শিক্ষকরা জ্ঞান বিতরণের কাজে নিয়োজিত থাকবেন, তাদের মানসিক ভেদবুদ্ধি একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গড়ে উঠতে দেয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়াও আছে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভিন্ন হওয়ার ফলে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার ভিন্নতা রয়েছে। তবে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সমস্যার মূল একই জায়গায় রয়েছে। আমরা বলতে পারি, যথেষ্ট পরিমাণে ইতিবাচক প্রণোদনা না থাকায় এবং নেতিবাচক প্রণোদনা কার্যকর থাকার ফলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাম্য মাত্রায় এক্সিলেন্স অর্জন করতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক রিক্রুট করা হচ্ছে নৈরাজ্যকরভাবে। অনেকেই বলেছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক রিক্রুটের পরিবর্তে ভোটার রিক্রুট হচ্ছে। যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় আইন বলবৎ হয়েছে, সেগুলোয় ভোটার রিক্রুটের মতো বিকৃত প্রণোদনা লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় আইন বলবৎ হয়নি সেগুলোয় শাসক দলের ধামাধরা একটি পরিমণ্ডল তৈরির প্রণোদনা লক্ষ করা যায়।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা অনেক। তবে এক নম্বর সমস্যাটি হলো নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে, যাচ্ছেতাই করে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ। দৈনিক প্রথম আলোর ১৪ মার্চ ২০২৩ সংখ্যায় প্রথম পাতায় একটি সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, তার শিরোনাম হলো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : দুই বছরে ১৮৭ জন নিয়োগ, প্রতিবারই ছিল ‘বিতর্ক’। সংবাদটির ইন্ট্রোতে লেখা হয়েছে, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান উপাচার্যের সময়ে প্রায় দুই বছরে শিক্ষক ও কর্মচারী পদে ১৮৭ জনের নিয়োগ হয়েছে। এসব নিয়োগে প্রতিবারই ‘বিতর্কের’ সৃষ্টি হয়। কারণ, বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে দেওয়া হয়েছে একাধিক নিয়োগ। বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়াও নিয়োগ পেয়েছেন ২৭ জন। এমনকি নিয়োগ বাণিজ্যের ফোনালাপও ফাঁস হয়েছে। এবার নিয়োগ নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে প্রশাসনিক পদে থাকা শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এলো। গত রোববার ও সোমবার একদিনের ব্যবধানে প্রশাসনিক পদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করলেন ১৯ শিক্ষক। ২০১৯ সালের ১৩ জুন উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব নেন বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক শিরীণ আখতার। তার সময়ে নিয়োগে বিতর্কের শুরু ২০২১ সালের জুনে। ওই সময়ে বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে খণ্ডকালীন হিসাবে ১২ শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ১৫ জনকে। এরপর থেকে বিতর্ক পিছু ছাড়েনি উপাচার্যের।’

বিজ্ঞাপিত পদ অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগেও মেধাক্রম মানা হয় না। কোনো প্রার্থী যদি সরকারি দলের সমর্থক হন, তাহলে বিজ্ঞাপিত পদে সরকারি দলের বাইরে থেকে কেউ নিয়োগপ্রার্থী হলে দেখা যায় উচ্চ মেধাক্রমে থাকা সত্ত্বেও সে প্রার্থী চাকরি পায় না। এ প্রবণতা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কুরে কুরে খাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধা-দারিদ্র্যে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। সর্বনাশ হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজšে§র। সর্বনাশ হচ্ছে দেশের।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম