Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

যুদ্ধ থামলেও পরিস্থিতি বদলাবে কি?

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যুদ্ধ থামলেও পরিস্থিতি বদলাবে কি?

যেখানেই বসি-গল্প করতে, সময় কাটাতে-সেখানেই শুধু নেতিবাচক বিষয় আলোচনায় আসে। শুধুই সমস্যার কথা। সম্ভাবনার কথা নেই বললেই চলে। ইদানীং এসব আলোচনায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা আসে। আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা, যারা আমাদের তৈরি পোশাকের বড় আমদানিকারক, এমনকি সম্প্রতি রেমিট্যান্সেরও সবচেয়ে বড় বাজার।

এসব আলোচনার ফাঁকে ফাঁকেই চলে আসে আরেকটা কথা-সেটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। কোন পণ্যের দাম কত, কত বাড়ল-তার হিসাব। মানুষের কষ্টের কথা আসে। দুঃখীজনের অবস্থার কথা আসে। সেদিন বাজারের অবস্থার কথা বলতে গিয়েই চলে এলো শবেবরাতের বাজারের কথা। প্রায় সবাই বললেন, এবারের শবেবরাতের বাজারও মন্দা। একথা বলতে বলতেই একজন বললেন, জিলাপির কেজি ৫০০ টাকা। উত্তরও সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া গেল। চিনির দাম কেজিপ্রতি ১১০-১১৫ টাকা। অন্যান্য উপকরণেরও দাম বেশি। অতএব জিলাপির দামও বেশি। রোজার মাসে বাজার কেমন হবে তা এখন স্পেকুলেশনের বিষয়।

ফাল্গুনের পূর্ণিমা গেছে। শবেবরাতের পাশাপাশি পালিত হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের দোলযাত্রা, কোথাও কোথাও হোলি, আবার কোথাও কোথাও বসন্তোৎসব। বসন্ত এসেছে। কোকিল ডাকছে। প্রকৃতি সেজেছে নতুন সাজে। বোরো ফসল খেতে। কৃষকরা ব্যস্ত পরিচর্যায়। এরই মধ্যে বাজারে উঠেছে সজনে। সজনে একটি সবজি। দাম কত? ‘মাত্র’ ২৫০ টাকা কেজি! হাত দেবেন এতে-এ সাহস কার? উঠেছে তরমুজ, আছে বেল। দামের কথা না বলাই ভালো। উচ্ছে ১০০ টাকা কেজি। চৈত্র মাস আসে আসে। বাজারে মাছের সরবরাহ কম। অজুহাত একটা হয়েছে মূল্যবৃদ্ধির এবং তা হচ্ছে।

উত্তরবঙ্গের রিকশাওয়ালারা ঢাকায় আসছে। ‘দেশে’ কাজের অভাব। ঢাকায় এসেই রিকশা ধরে তারা। এখানে দক্ষতার কোনো বালাই নেই। যাকেই জিজ্ঞেস করি, সে-ই বলে দেশে এখন কাজ নেই। কিছুদিন পর বোরো ফসল ওঠার সময় তারা আবার ‘দেশে’ যাবে। তখন কাজ করবে চুক্তিতে। আগে কাজ হতো গ্রামে রোজের ভিত্তিতে। দিনে মজুরি এত টাকা। এখন তা নেই। এখন প্রায় সব কাজ চুক্তিতে। এক বিঘা জমির ধান কাটা হবে, এত টাকা লাগবে। এভাবেই এখন চলে। অনেক বড় পরিবর্তন। এতে আয়-রোজগার বেশি।

কিন্তু কৃষকের বোঝা বাড়ে। কৃষক এই বোঝা টানতে না পেরে হয় ক্ষতিগ্রস্ত। উপায় নেই। এভাবেই গ্রামে নিরন্তর পরিবর্তন ঘটে চলেছে। মানুষের পেশা বদলাচ্ছে। অনেক পেশার মৃত্যু ঘটেছে/ঘটছে। যেমন জেলেদের পেশা। দেশের বৃহত্তর একটা অঞ্চলে নদী নেই, খাল নেই, বিল নেই। অতএব জেলেরা বেকার। তারা কৃষিবিষয়ক পেশায় যুক্ত হচ্ছে। যারা পারছে না, যারা কাজ পায় না, তারা ‘অতিবৃদ্ধ’ ঢাকা শহরে চলে আসে কাজের সন্ধানে। কিন্তু এখানে মজুরির হাল কী? হিসাব দিয়েই বলি। শান্তিনগর মোড় থেকে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকে যেতে দুবছর আগেও লাগত ৫০ টাকা, এখনো তা-ই।

মাঝে কিন্তু বিশাল মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রিকশাওয়ালারা তাদের ভাড়া বাড়াতে পারেনি। অনেক পেশার লোকেরা মজুরি বাড়িয়েছে, কিন্তু কাজের প্রাপ্তি কমেছে বা একই আছে। বাজারে টাকার অঙ্কে বেচাকেনা স্ফীত দেখায়, কিন্তু ওজনে বিক্রি কম। যে এক কেজি সবজি কিনত, সে কেনে আধা কেজি। যে মাছ কিনত আধা কেজি, সে কেনে আড়াইশ গ্রাম।

একটি খবরে দেখলাম, এক বড় অর্থ সরবরাহকারী সংস্থা একটা চুক্তি করেছে। তারা কিছু দোকানের ব্যবস্থা করেছে, যেখানে খুচরায় মাংস বিক্রি হয়। খুচরা বিক্রি মানে কী? বুঝিয়ে বলছি। আগে, ছোটবেলায় দেখেছি মাছ বিক্রি হতো ‘ভাগা’ দিয়ে-অবশ্যই ছোট মাছ। আর বড় মাছ কেটে বিক্রি হতো। মাথা, লেজ, পেটি, গাদা এভাবে কেটে ভাগ করে বিক্রি হতো। আস্ত মাছ না কিনলেও হতো। সবাই মাছ, বড় মাছ কিনতে পারত। কী জানি কী হলো, ঢাকা শহরে এখন কেটে মাছ বিক্রি হয় না। ইলিশ কেটে আলাদাভাবে ইলিশের ডিম বিক্রি হতো। এখন এসব হয় না।

এখন মাছের বাজার মানেই আস্ত মাছ বেচাকেনা, মাংসের দোকানেও তাই। অল্প পরিমাণের মাংস কেনা সম্ভব নয়। সবজির বাজারে দরদাম করলে দোকানিরা বলে কত কেজি নেবেন? অল্প পরিমাণের কোনো কথা নেই। এর অর্থ কী? মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। হ্যাঁ, বলতে হবে তা অনেকটা বেড়েছে। তবে তা কিছু লোকের, কিছু পেশার ক্ষেত্রে। সবার মজুরি, রোজগার সমানভাবে বাড়েনি। বিশাল বৈষম্য এখানে। মাছ-মাংসের বাজারে এর প্রতিফলন কী? এর উত্তর জানি না।

তবে বুঝি, সব মানুষ আস্ত মাছ কিনে খেতে পারে না। সব মানুষ কেজিতে মাংস কেনার ক্ষমতা রাখে না। এ কথা মনে রেখে একটি সংস্থা খুচরা মাংস বিক্রির ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তাতে কী হবে, এতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। কারণ খাসির মাংসের কেজি ৮০০-১০০০ টাকা। ২৫০ গ্রাম যদি কেউ কেনে, এর দাম পড়ে ২০০-২৫০ টাকা। দিনে ৪০০-৫০০ টাকা রোজগার করে ৪-৫ জনের সংসারে ২৫০ গ্রাম মাংস কেনা এক দুরূহ বিষয়।

এখন বলা হচ্ছে, মানুষ ভোগ কমাচ্ছে। সঞ্চয় ভাঙছে। ধার-দেনা করছে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ কমাচ্ছে, দুধের খরচ কমাচ্ছে। যাতায়াত খরচ কমাচ্ছে। সব ঠিক আছে। কমানোর তো শেষ আছে। তাহলে এর শেষ কোথায়। কেউ কেউ মনে করেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। এ আশার ভিত্তি কী? আর যদি স্বাভাবিকও হয়, তাহলেও এর জন্য সময় লাগবে আরও দুই-তিন বছর।

এরপর কি জিনিসপত্রের দাম কমতে শুরু করবে? আমার ধারণা, তা হওয়ার নয়। একবার দাম বাড়লে তা আর কমে না-এটাই অভিজ্ঞতা বলে। আর কয়েকদিন পরই শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। তারপর আসছে বার্ষিক বাজেট। কী আছে কপালে? আমরা কেউ তা জানি না। সরকার কি মূল্যস্ফীতি কমাতে পারবে? সরকার কি ধনীদের ওপর করারোপ করতে পারবে? সরকার কি কর-রেয়াত, কর মওকুফ ইত্যাদি করতে পারবে? নাকি পরোক্ষ করই ভরসা হবে, ভরসা হবে ভ্যাট আর উৎসে কর? এ দুশ্চিন্তাতেই আছে সবাই।

এসব আলোচনাই হয় টেবিলে টেবিলে। পাশাপাশি আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে দুর্নীতি, মহা দুর্নীতি, সম্পদ-অর্থ পাচার, দুর্ঘটনা, ট্র্যাফিক জ্যাম। নির্বাচনের কথাও হয়। কী হবে নির্বাচনে? সবাই আসবে তো নির্বাচনে? আসন ভাগাভাগি হবে কিনা-তাও আলোচনায় আসে। কিন্তু মজার বিষয়, একটি কথা সাহস করে লিখতে/বলতে চায় না কেউ। আমিও না। সেটি হচ্ছে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিষয়।

একথা ঠিক, গেল এক বছরে নজিরবিহীনভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। আগেও বাড়ত, কিন্তু এখন বাড়ছে সপ্তাহে সপ্তাহে, মাসে মাসে। অজুহাত যুদ্ধ। যুদ্ধ এক বিশাল-বিরাট অজুহাত। কামিয়ে নিচ্ছে বড়-ছোট সব ব্যবসায়ী। আন্তর্জাতিকভাবে, দেশীয়ভাবেও তা-ই। এখানেই প্রশ্ন, সবার সংসার যদি না চলে, সবারই যদি সঞ্চয় ভাঙাতে হয়, ধার-দেনা করতে হয়, তাহলে বেতন বৃদ্ধির কথা হচ্ছে না কেন? যারা চাকরি করে না, তারা নানাভাবে রোজগার বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু যারা চাকরি করে, তারা তো বেতন বৃদ্ধির কথা তুলতে পারে। না, তা কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ কী? কারণ খুঁজে লাভ নেই। কেউ কারণের কথা সঠিকভাবে বলতে পারবে না।

তবে এরই মধ্যে আংশিক একটা উত্তর পাওয়া যায়। প্রায় সবাই ধরে নিয়েছে, যুদ্ধের কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। সরকার বাধ্য হয়ে ভর্তুকি কমাচ্ছে। আইএমএফ ধরে বসেছে, ভর্তুকি কমাতে হবে। তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। এসবে সরকারের দায় কম বলে অনেক মানুষ মনে করে; যদিও এর মধ্যেও অনেক কথা আছে-যা বলা যায়, বলা উচিত। কারণ, সব মূল্যবৃদ্ধিই যুদ্ধজাত বৃদ্ধি নয়।

অতিরিক্ত মুনাফা, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ওভার ইনভয়েসিং-এ ধরনের অনেক বিষয় আছে, যা মূল্যবৃদ্ধিতে প্রতিনিয়ত ইন্ধন জোগাচ্ছে। এসব বুঝেশুনে অনেকেই চুপ। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা আছে ভয়ে ভয়ে। কার চাকরি কখন যায়! বিশ্বের অনেক দেশে কর্মী-ছাঁটাই শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও শুরু হয়েছে। ‘ফুড পান্ডা’ অনেক কর্মচারী ছাঁটাই করেছে। পোশাক শিল্পে নতুন নিয়োগ বন্ধ। অনেক চুক্তিভিত্তিক চাকরির চুক্তি নবায়ন হচ্ছে না। বেতন অনিয়মিত। এসব দেখে বেসরকারি খাতের কর্মচারী-কর্মকর্তারা আতঙ্কিত। বেতন বৃদ্ধির দাবি দূরের কথা, চাকরি রাখাই এখন তাদের একমাত্র লক্ষ্য। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা সবার।

কিন্তু সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের অবস্থা তো এমন নয়। তাদের চাকরি ‘খেতে’ পারে এমন শক্তি কারও নেই! এক সরকার থেকে আরেক সরকার-তাদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকে। তাদের চাকরির নিশ্চয়তা-নিরাপত্তা শতভাগ। পদোন্নতি নিশ্চিত। পদায়নও নাকি আজকাল ঘটে তাদের ইচ্ছায়, শুনতে পাই। তাহলে তারা কেন বেতন বৃদ্ধির কথা বলছেন না? তাদের তো চাকরি যাওয়ার ভয় নেই। তারা তো বলতে পারেন, আমাদের সংসার চলে না। দয়া করে বেতনটা বাড়িয়ে দিন। না, একথা নেই। আমরা কেউ জানি না এমন দাবি কোথাও উঠেছে। এর অর্থ কী? এর অর্থ কি এই যে, সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা মূল্যস্ফীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত নন? নাকি তারাও সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন? তারাও কি ধার-দেনা করছেন? নাকি তারা ‘নানাভাবে’ চলছেন?

কারও কারও নানা সুযোগ আছে। যেমন সরকারি ডাক্তার। তারা প্রাইভেট ‘প্র্যাকটিস’ করে অঢেল টাকাপয়সা কামাই করতে পারেন। এছাড়া অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা নানা উপায়ে রোজগার বাড়াতে পারেন। কেউ তা আমরা জানি, কেউ জানি না। কিন্তু বড় কথা, এরা সংখ্যায় অনেক-১০-১৫ লাখ, হয়তো তারও বেশি। তারা সবাই কীভাবে চলছেন, এটা একটা প্রশ্ন। প্রশ্নটি অবশ্য সবার জন্যই। মূল্যস্ফীতি ঘটছে। এটা নিরন্তর প্রক্রিয়া। এর থেকে কোনোদিনই আমরা মুক্তি পাব না। তাহলে উপায়? একমাত্র উপায় ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি। ক্রয়ক্ষমতা যদি মূল্যস্ফীতির সমান হয়, তাহলে বাঁচা যায়। কিন্তু এটি কখনো হয় না। জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, মূল্যস্ফীতি হয়। পাশাপাশি ক্রয়ক্ষমতাও কিছুটা বাড়ে। কিন্তু সমান সমান নয়। এ কারণে ক্রমাগতভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম