শতফুল ফুটতে দাও
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাগাড়ম্বর আছে বাস্তবতা ভিন্ন
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একের পর এক ঘটছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা অনেক কারণেই ঘটতে পারে। আমরা লক্ষ করছি মানবিক ভুল, অবহেলা, অসাবধানতা, লাভের অঙ্কটি বড় রাখার জন্য অপরিণামদর্শিতা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার ফলে ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটে চলেছে।
কিন্তু এ রকম দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, এজন্য তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না।
আমরা মাঝেমধ্যে গর্ব করে বলি, পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বেশ উন্নত। এজন্য অনেক জীবন রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।
আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রধানত সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যাকেন্দ্রিক। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে ভালো করছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে এমনটি ভেবে সন্তুষ্ট হওয়ার অবকাশ নেই।
সমুদ্র থেকে উত্থিত সাইক্লোন যখন মূল ভূখণ্ডের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, তখন উপকূলবাসী দুই-তিন দিন সময় হাতে পান। ফলে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়। উপকূল এলাকায় অনেক ঘূর্ণিঝড়-আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে পারে-এমনটি মনে করে লোকজনকে ঘূর্ণিঝড়-আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। মানুষ যাতে ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে উদাসীন না হন, এজন্য শত শত স্বেচ্ছাসেবক সম্ভাব্য দুর্যোগ সম্পর্কে মানুষকে সাবধান হতে বলেন এবং নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে তাদের নিয়ে আসেন। এসব ব্যবস্থাপনার ফলে ঘূর্ণিঝড় ও তজ্জনিত জলোচ্ছ্বাস থেকে অনেক জীবন রক্ষা পায়।
বাংলাদেশের উপকূলসহ অন্যান্য এলাকায় প্রধান জনগোষ্ঠীর পেশা কৃষি। কৃষক সম্পর্কে নৃ-বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করেছেন। এসব গবেষণা থেকে কৃষক চরিত্র সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। কৃষক তাদের নিজ ভুবনে অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক। কৃষক যখন মাঠে কাজ করেন, তখন তারা অপরিচিত আগন্তুককে দেখলে সন্দিগ্ধ হন।
তারা বাইরের মানুষকে খুব সহজে গ্রহণ করতে পারেন না। এ কারণে যদি কোনো সমাজসেবী গ্রাম এলাকায় উন্নয়নকর্মী হিসাবে কাজ করতে আসেন, তখন তাদের সম্পর্কে নানা ধরনের সন্দেহ কৃষকের মনে দানা বাঁধে। এ থেকে বোঝা যায়, কৃষকের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে সংযুক্ত করতে চাইলে অতিরিক্ত সময় ও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। কার্ল মার্কস কৃষকের জন্য দরদি দার্শনিক ছিলেন।
কিন্তু কৃষকের আচরণ সম্পর্কে তার কিছু চাঁছাছোলা মন্তব্য আছে। কৃষকর সম্পর্কে তার একটি বহুল আলোচিত উক্তি হলো, ‘They represent barbarity in the midst of civilization’ অর্থাৎ তারা সভ্যতার বুকে বর্বরতার প্রতিনিধিত্ব করে। কৃষক সম্পর্কে তার আরেকটি মন্তব্য হলো, They are like a sack of potatoes. তারা আলুর বস্তার মতো। বস্তায় আলু ভরে মুখটি সেলাই করে দিলে সেই আলু কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়বে না।
কিন্তু বস্তার মুখটি খুলে দিলে আলুগুলো ছড়িয়ে পড়ে। এর মানে হলো, কৃষকের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি একটি কঠিন কাজ। তাদের ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন বস্তার মুখ যেভাবে সেলাই করা হয়, সেরকম কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ। আমাদের দেশে উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহার করে শস্যের উৎপাদন বাড়ানোর কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল আইয়ুব খানের আমলে। নতুন ধরনের বীজ ব্যবহারে তাদের ছিল ঘোর আপত্তি। তারা বলত, ইরি ধানের চাল রান্না করলে ভাত মোটা মোটা হয়। এ ভাতে স্বাদ নেই। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির এ প্রচেষ্টা কৃষকের সন্দেহ বাতিকের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কারণে ‘অধিক খাদ্য ফলাও’ স্লোগানে অত্যন্ত ধীরগতিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন তখনকার কৃষক।
বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে গত ১০০ বছরে ২টি ভয়াবহ সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। ১৯৭০ সালে ১২ নভেম্বর একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সাইক্লোন এবং এর সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় অঞ্চলকে ধুয়েমুছে নিয়ে গিয়েছিল। অনুমান করা হয়, এ সাইক্লোনে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ভেসে গেয়েছিল ঘরবাড়ি এবং গবাদি পশুসহ সব ধরনের সহায়সম্পদ। আরেকটি ঘূর্ণিঝড় ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০ কিমি./ঘণ্টা বেগে আঘাত হানে। এ ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ৬ মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে। এ কারণে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যান এবং ১ কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারান। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
১৯৭০-এ সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূল এলাকা দেখতে গিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। সেখান থেকে ফিরে এসে পল্টন ময়দানে একটি বিশাল জনসভা করেন তিনি। তিনি তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, আমি একটি ঘুঘু পাখিও দেখেনি। ঘুঘু পাখিরা বিরান প্রান্তর পছন্দ করে। সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসে বিরান হয়ে গিয়েছিল বিশাল উপকূলীয় এলাকা। সেখানে ঘুঘু পাখিরও দেখা মেলেনি। মওলানা ভাসানী আরও বলেছেন, ওরা কেউ আসেনি। ‘ওরা’ বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারি ও বেসরকারি নেতাদের। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি এ অবহেলা ও উদাসীনতা দেখে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি তুলেছিলেন। এ জনসভায় কবি শামসুর রাহমানও উপস্থিত ছিলেন। মওলানা ভাসানীর ভাষণ শুনে তিনি লিখলেন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘সফেদ পাঞ্জাবি’।
দক্ষিণ বাংলার জনগণ ঝড়ের উন্মত্ততা, জলোচ্ছ্বাসের আগ্রাসী ঢেউ দেখেছেন। এ অভিজ্ঞতা থেকে এখন ঝড়ের সিগন্যাল থেকে আত্মরক্ষার জন্য যা কিছু করতে হয় সে ব্যাপারে মানুষ ঢিলেমি করে না। এরপরও অনেকে আছেন, যারা তাদের গবাদি পশুর মায়া ত্যাগ করতে পারেন না বলে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিতে অনীহা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশে যেসব দুর্যোগ হয়, সেগুলোর মধ্যে একটি বড় ধরনের দুর্যোগ হলো ভয়াবহ গ্যাস ও কেমিক্যালের বিস্ফোরণ। গত ৫ মার্চ রোববার প্রচণ্ড বিস্ফোরণে উড়ে যায় সায়েন্স ল্যাবরেটরির পাশের তিনতলা শিরিন ভবনের বড় অংশ। পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ৩ তলা ভবনের তৃতীয় তলাটি যেন ধ্বংসস্তূপ। বিধ্বস্ত দেওয়ালের ইট, দরজা জানালা ও আসবাব ছিন্নভিন্ন হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। আশপাশে আতঙ্কিত লোকজন। সবাই বোঝার চেষ্টা করছেন কী হয়েছে! গত রোববার সকালে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার শিরিন ভবনে বিস্ফোরণের ৪৫ মিনিট পর ঘটনাস্থলে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। ততক্ষণে ভবনের ভেতর থেকে মৃত তিনজনকে উদ্ধার করে নিকটস্থ পপুলার হাসপাতালে পাঠানো হয়। আহত আরও ১৫ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
পাশের ভবনের নিরাপত্তাকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, বেলা পৌনে ১১টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। আশপাশের ভবনও কেঁপে ওঠে। ভূমিকম্প হচ্ছে মনে করে অন্যান্য ভবনের লোকজনও নিচে নেমে আসেন। বিস্ফোরণের পরপর আগুন ধরে যায় শিরিন ভবনে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ১০.৫৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। ৪টি ইউনিট মিলে ১৮ মিনিটের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে উদ্ধার কাজ শুরু করে। কেন এমন বিস্ফোরণ হলো, এ ব্যাপারে একটি জিনিস স্পষ্ট। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানায়, জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে। তারা ঘটনাস্থলে গ্যাস ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করে সেখানে গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েছেন। তবে ঠিক কোথায় ও কীভাবে গ্যাস জমেছিল এবং কীভাবে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয়, সেটা রোববার সারা দিনে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সীতাকুণ্ডে সিমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৬ ব্যক্তির প্রাণ হারিয়ে যায়। সিমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের পায়ে পায়ে ছিল অনিয়ম। ওই প্ল্যান্টে শুধু অক্সিজেন সিলিন্ডারই ছিল না, অনুমোদন না থাকার পরও ছিল কার্বন ডাইঅক্সাইড ও নাইট্রোজেন সিলিন্ডার। নিয়ম অনুযায়ী, এসব গ্যাস সিলিন্ডার আলাদা কক্ষে থাকার কথা। তবে প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অক্সিজেনের পাশাপাশি একসঙ্গে পেয়েছেন কার্বন ডাইঅক্সাইড ও নাইট্রোজেনের সিলিন্ডার। অনিয়মের এখানেই শেষ নয়, কারখানাটিতে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা ছিল না। হয়নি কখনো আগুন নেভানোর মহড়াও। লাইসেন্স আছে কি না, তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে পরপর দুটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ এবং এর আগে ঘটে যাওয়া চুড়িহাট্টা ও নিমতলির বিস্ফোরণের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও বিপন্মুক্ত থাকার তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই লেখা প্রেসে যাওয়ার আগে জানা গেল, রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারের একটি সাততলা ভবনে বিস্ফোরণে বহু লোকের মৃত্যু হয়েছে। এ মুহূর্তে জনবহুল শহরগুলোয় যাতে এমন দুর্ঘটনা না ঘটে, এজন্য কালবিলম্ব না করে উদ্যোগ নিতে হবে। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ প্রতিরোধে ভিন্ন একটি অথরিটি বা কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে। এ কর্তৃপক্ষের প্রথম কাজ হবে একটি নিবিড় জরিপের মাধ্যমে বিপজ্জনক কেমিক্যাল গোডাউন এবং গ্যাস বিস্ফোরণে নাজুক ভবন ও স্থাপনাগুলো চিহ্নিত করা। বিপদের শঙ্কা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের রং ব্যবহার করে এগুলোকে চিহ্নিত করে দেওয়া দরকার। এ কাজটি করলে যেসব ব্যবসায়ী নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করেন না, তারা সংযত হতে বাধ্য হবেন।
বিস্ফোরক পদার্থের ব্যবসার স্পটগুলোকে দেওয়াল অথবা স্টিলের নেট দিয়ে ঘেরাও করে ফেলতে হবে। এসব ভবন ও স্থাপনায় যেসব শ্রমিক কাজ করেন, তাদের মানবসৃষ্ট দুর্যোগ সম্পর্কে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাস দুর্যোগ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে যে প্রস্তুতি আছে, তা মূলত দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার পরবর্তী প্রস্তুতি। এখন চিন্তা করতে হবে এগুলোর জন্য দুর্যোগপূর্ব প্রস্তুতি। একটি দক্ষ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন হবে অর্থের।
দেশে যেসব শিল্প ও বাণিজ্যিক ইউনিট রয়েছে, সেগুলোর কাছ থেকে বার্ষিক ভিত্তিতে দুর্যোগ কর আরোপ করতে হবে। এ দুর্যোগ কর কারখানা, স্থাপনা ও ভবনের আকারের ওপর নির্ভর করে আরোপের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কর অবশ্যই ব্যবসা বা কারখানার মালিক পরিশোধ করবেন।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ