‘শব’ ফারসি শব্দ। অর্থ রাত বা রজনি। ‘বরাত’ শব্দটিও প্রকৃত অর্থে ফারসি ভাষা থেকে উৎকলিত, যার অর্থ ভাগ্য। এ দুশব্দের একত্রে অর্থ হচ্ছে ভাগ্যরজনি। শবেবরাতের আরবি প্রতিবর্ণী ‘লাইলাতুল বারাআত’ হচ্ছে ১৫ শাবান তথা মধ্য শাবানে পালিত একটি পুণ্যময় রাত। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মুসলমানরা বিভিন্ন কারণে এ রাতটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালন করে থাকেন। মুসলমান ধর্মবেত্তাদের মতে, এ রাতে আল্লাহতায়ালা তাঁর রহমতের দ্বার খুলে দেন, পাপী বান্দাদের উদারচিত্তে ক্ষমা করেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। ফারসি ভাষায় ‘শব’ অর্থ রাত আর ‘বরাত’ নামক আরবি শব্দটির অর্থ মুক্তি বা নিষ্কৃতি। সুতরাং ‘শবেবরাত’-এর অর্থ হলো মুক্তির রাত বা নিষ্কৃতির রাত। এ বিশেষ রাতের ব্যাপারে কুরআনের কোথাও সরাসরি কোনো কিছুর উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে সিহাহ্ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ছয়খানা হাদিস গ্রন্থের কোনো কোনো হাদিসে এ রাতের বিশেষত্ব নির্দেশক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও এ রাতের বিশেষত্ব উল্লেখ পাওয়া যায়। পবিত্র কুরআনের সূরা দুখানে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হা-মিম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমি তো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।’ উল্লিখিত আয়াতগুলোয় বর্ণিত একটি বিশেষ রাতের ব্যাখ্যায় তাফসিরকারদের কেউ কেউ বলেছেন, ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় সে রাতটি হচ্ছে মধ্য শাবানের পূর্ণিমা রাত তথা শবেবরাত (তাফসিরে মাযহারি, রুহুল মায়ানি ও রুহুল বায়ান)।
প্রখ্যাত তাফসিরকার হজরত ইকরামা (রহ.) ‘এক বরকতময় রাত’-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, এ রাতটি হলো মধ্য শাবানের রাত। ইক্রামা (রহ.)-এর উপরিউক্ত ব্যাখ্যার সঙ্গে অন্য তাফসিরকারদের অধিকাংশই সহমত পোষণ করেননি। তাদের সবাই কুরআনের উপর্যুক্ত আয়াতে বর্ণিত ‘এক বরকতময় রাত’ বলতে শবেকদরকে বোঝানো হয়েছে বলে মতপ্রকাশ করেছেন। এ মতের পক্ষে রায় দিয়েছেন হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.), ইবনে কাসির (রহ.), ইমাম কুরতুবি (রহ.) প্রমুখ তাফসিরকার। তবে ইমাম কুরতুবি (রহ.) তার তাফসির গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘কোনো কোনো তাফসিরকার বলেছেন, ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা বোঝানো হয়েছে মধ্য শাবানের রাতকে (শবেবরাত)।
এ রাত সম্পর্কে একটি সহিহ হাদিস যা সুনানে ইবনে মাজাহ্র ইকামাতুস্ সালাত অধ্যায়ে হজরত আবু মুসা আশয়ারি (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা মধ্য শাবানের রাতে সব সৃষ্টির দিকে বিশেষ নজর দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। হজরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, নবি করিম (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। তিনি আরও বলেন, নবি (সা.) তাকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া বকরির পশমের পরিমাণের চেয়েও বেশিসংখ্যক গুনাহ্গারকে আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করে দেন (সুনানে তিরমিজি : ৭৩৯)। হজরত আবু সালাবা (রা.) থেকে বর্ণিত : যখন শাবানের মধ্যরাত আসে, তখন আল্লাহপাক মাখলুকাতের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান; মুমিনদিগকে ক্ষমা করে দেন, কাফিরদের ফিরে আসার সুযোগ দেন এবং হিংসুকদের হিংসা পরিত্যাগ ছাড়া ক্ষমা করেন না (কিতাবুস সুন্নাহ্, খণ্ড: ৩, পৃ.-৩৮২)। হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : আল্লাহতায়ালা এ রাতে বিদ্বেষ পোষণকারী ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যাকারী ছাড়া বাকি সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন (মুসনাদে আহমদ, খণ্ড: ৪, পৃ.-১৭৬)। হজরত মু’আয ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, নবি করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন’ (ইবনে মাজাহ্, আস-সুনান : ১/৪৪৫)। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত : নবি করিম (সা.) বলেছেন : ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা পালন করো; কেননা এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহতায়ালা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন : কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিক প্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি তাকে উদ্ধার করব। এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা বান্দার বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন (ইবনে মাজাহ : ১৩৮৪)। জলিলে কদর সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত : বুখারি ও মুসলিম শরিফের হাদিসের বক্তব্য হলো, আল্লাহতায়ালা প্রতি রাতের শেষের দিকে নিকটতম আকাশে অবতরণ করে দোয়া কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। আর প্রতি রাতের মধ্যে ১৫ শাবানের রাতও অন্তর্ভুক্ত। অতএব, এ হাদিস মতে, অন্যান্য রাতের মতো শাবানের ১৫ তারিখের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহতায়ালা দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন।
এ রাতে যেমনভাবে আমরা ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য বিশেষভাবে উদ্গ্রীব হই, আমাদের উচিত বছরের প্রতিরাতের শেষাংশের বরকতময় সময়ে ইবাদত করার জন্য উদ্গ্রীব হওয়া। কেননা প্রতিটি রাতেই একটি বিশেষ সময় আছে, যখন আল্লাহ্তায়ালা আমাদের ডেকে ডেকে বলতে থাকেন, কার কী দরকার সে যেন আমার কাছে চায়, আমি দেব। কে আছ ক্ষমা চাওয়ার আমি ক্ষমা করে দেব। কে আছ আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব। আর তা হলো প্রতিরাতের এক-তৃতীয়াংশের শেষ অংশে, যা ফজর পর্যন্ত চলতে থাকে। সেই অর্থে প্রতিটি রাতই কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সুযোগ নিয়ে আসে-এ কথা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি।
অতএব, বছরের অন্যান্য দিবসের মতো মধ্য শাবান তথা শবেবরাত উপলক্ষ্যেও সাওম পালন করা, নফল নামাজ আদায়, কুরআন তেলাওয়াত করা, বেশি বেশি দোয়া-দরুদ, তাসবিহ্-তাহ্লিল, জিকির-আজকার, ইস্তিগফার পড়া, কবর জিয়ারত করা এবং সর্বোপরি নিজের জন্য, পিতামাতা-আত্মীয়স্বজন তথা সব মুমিন-মুসলমানের জন্য দেশ-জাতির কল্যাণ কামনা করে দোয়া করা দোষের কিছু নয়; বরং এগুলো অবশ্যই পুণ্যের কাজ।
ড. আবদুল আলীম তালুকদার : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ