Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নিষ্ক্রিয় জীবনধারা : একটি উপেক্ষিত স্বাস্থ্যঝুঁকি

Icon

আসাদুজ্জামান খান

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নিষ্ক্রিয় জীবনধারা : একটি উপেক্ষিত স্বাস্থ্যঝুঁকি

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ একাধিক স্বাস্থ্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভালো করেছে-৫ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যু হ্রাস করেছে, বেশির ভাগ সংক্রামক রোগ নির্মূল করেছে, গড় আয়ু বৃদ্ধি করেছে ইত্যাদি। তবে সময় ও পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এখন স্বাস্থ্যক্ষেত্র নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, যা উদ্বেগজনক।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের (এনসিডি) কারণে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা প্রধানত হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস এবং স্তন ও কোলন ক্যানসারের কারণে। অসংক্রামক রোগগুলো জেনেটিক, শারীরবৃত্তীয়, পরিবেশগত এবং আচরণসহ বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। তবে এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা কার্যকলাপের অভাব। বিগত আট বছরে বাংলাদেশে এনসিডির জন্য দায়ী মোট মৃত্যু ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮ সালে এটি ছিল ৫২ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে বেড়ে হয়েছে ৬৭ শতাংশ। শারীরিক কার্যকলাপের অভাব এ এনসিডির জন্য তৃতীয় প্রধান ঝুঁকির কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে সাম্প্রতিক গবেষণায়। বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে দুজন (৩৯ শতাংশ) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মাত্রায় শারীরিক ক্রিয়াকলাপে নিয়োজিত হন না এবং এদের মধ্যে নারী ও শহুরে মানুষ কম সক্রিয়। অধিকন্তু ১৩-১৭ বছর বয়সি পাঁচজন কিশোর/কিশোরীর মধ্যে তিনজন (৫৯ শতাংশ) শিশু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত শারীরিক কার্যকলাপ নির্দেশিকা পূরণ করে না। নিষ্ক্রিয়তা বা অলস আচরণগুলো (যেমন-বসে থাকা, শুয়ে থাকা, টিভি দেখা) সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি প্রধানত দ্রুত নগরায়ণ ও আধুনিকীকরণের কারণে হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে; যেখানে মানুষ দিন দিন প্রযুক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। আমরা শ্রম-সংরক্ষণ প্রযুক্তি এবং মোটরচালিত যানবাহনের ওপর বেশি নির্ভরশীল এবং বিনোদনের জন্য ডিজিটাল স্ক্রিন বেশি ব্যবহার করছি।

এ পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘২০১৩-২০২০ অসংক্রামক রোগ-প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক কৌশলের জন্য অ্যাকশন প্ল্যান’ সর্বস্তরে শারীরিক কার্যকলাপ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। কর্মপরিকল্পনাটি ২০২৫ সালের মধ্যে শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ১০ শতাংশ হ্রাস করার একটি বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং সদস্য দেশগুলোর জন্য শারীরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধির জন্য বাস্তবসম্মত নীতির বিকল্পগুলো উল্লেখ করেছে। শারীরিক কার্যকলাপের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিকতম গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৮-২০৩০-এ তারা জোর দিয়েছে যে, শারীরিক ক্রিয়াকলাপের মাত্রা বাড়ানোর জন্য কাজ করতে ব্যর্থ হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা, পরিবেশ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সুস্থতা এবং জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাবসহ সংশ্লিষ্ট খরচ বাড়তে থাকবে। এ নতুন কর্মপরিকল্পনাটি ২০৩০ সালের মধ্যে শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ১৫ শতাংশ হ্রাস করার জন্য একটি নতুন বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যাতে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধি করতে এবং অলস আচরণ কমাতে কার্যকর ও সম্ভাব্য নীতি পদক্ষেপের নির্দেশনা দিয়েছে। সংস্থাটি জোর দিয়েছে-এ কর্মপরিকল্পনাটি কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন; একসঙ্গে কাজ করতে হবে সব স্তরে, ক্রস-গভর্নমেন্ট এবং মাল্টি-সেক্টরাল অংশীদারদের সঙ্গে। এটি যুক্তি দিয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বে শারীরিক কার্যকলাপকে উন্নীত করার নীতি ক্রিয়াকলাপে বিনিয়োগ করলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে। এ উদ্যোগগুলো পরিষ্কার বায়ু এবং কম যানজটসহ বিভিন্ন পরিবেশগত এবং সামাজিক সুবিধার পাশাপাশি সবার জন্য সুস্থতা ও জীবনের মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। শারীরিক ক্রিয়াকলাপের নীতিগত পদক্ষেপগুলো জাতিসংঘের ২০১৫-২০৩০ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর (এসডিজি) ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ১৩টির সঙ্গে যুক্ত। বৈশ্বিক স্বাস্থ্য এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য শারীরিক কার্যকলাপ সম্পর্কিত ২০১৬ সালের ব্যাংকক ঘোষণাপত্রেও শারীরিক ক্রিয়াকলাপকে এসডিজির লক্ষ্য অর্জনের পরিপূরক হিসাবে অনুমোদন করা হয়েছে। ব্যাংকক ঘোষণায় শারীরিক ক্রিয়াকলাপকে স্বাস্থ্যকর জীবনধারার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা উন্নয়নকে আরও টেকসই এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে উন্নীত করার সম্ভাবনা রাখে। আর তাই এর ওপর জরুরি অগ্রাধিকার এবং বিনিয়োগ নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের উচিত, তার জনগণকে আরও শারীরিকভাবে সক্রিয় করতে হাঁটা, সাইকেল চালানো, খেলাধুলা, সক্রিয় বিনোদন এবং অন্যান্য শারীরিক ব্যায়ামের প্রচারের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বে কাজ করা এবং জনগণকে শারীরিকভাবে সক্রিয় করার জন্য প্রতিটি সুযোগ ব্যবহার করা। বাংলাদেশ সরকার অসংক্রামক রোগসম্পর্কিত বেশ কয়েকটি নীতি চালু করেছে; তবে এগুলো কিছুটা অ্যাডহক ও খণ্ডিত, যেখানে সমন্বিত উপায়ে এ উদ্যোগ বা নীতিগুলো বাস্তবায়ন করার ক্ষমতার অভাব রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক ২০১৬-২০২১ সালের স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং জনসংখ্যা কৌশলগত বিনিয়োগ পরিকল্পনায় দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া অসংক্রামক রোগগুলোর চিকিৎসায় ভবিষ্যতের খরচ কমাতে ‘লাইফস্টাইল অ্যাপ্রোচ’ প্রস্তাব করা হয়েছে; কিন্তু কীভাবে এটি বাস্তবায়ন করা হবে, সে সম্পর্কে কোনো বিস্তারিত নির্দেশিকা নেই। আর একটি উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রতিষ্ঠিত স্বাস্থ্য এবং মনোসামাজিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সক্রিয় জীবনধারা এখনো দেশের বিদ্যমান সরকারি নীতি-নথিগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার এজেন্ডা হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি। এ ছাড়া মানুষের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব থাকা সত্ত্বেও কোনো স্বাস্থ্যনীতিই অলস আচরণকে ঝুঁকির কারণ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি, যা হতাশাজনক।

১৯৯৮ সালের জাতীয় ক্রীড়া নীতিতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠের জন্য উন্মুক্ত স্থান স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু এ নীতিটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে খেলাধুলা ও শারীরিক ক্রিয়াকলাপের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধার অভাব রয়েছে। একইভাবে যদিও ২০১৩ সালের জাতীয় সমন্বিত মাল্টিমোডাল পরিবহণ নীতি সক্রিয় যাতায়াতকে উৎসাহিত করা হয়েছে; পরিবহণের একটি প্রাথমিক মাধ্যম হিসাবে হাঁটা এবং সাইকেল চালানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাইকেল চালানো বা হাঁটার অবকাঠামো, বিশেষ করে শহুরে এলাকায় কার্যত অনুপস্থিত। ট্রাফিক এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক অবকাঠামোগত সুবিধাগুলো নিশ্চিত না করে বিশৃঙ্খল ও দুর্বলভাবে পরিচালিত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে বর্তমান পরিস্থিতিতে সক্রিয় ভ্রমণকে উৎসাহিত করা বাস্তবসম্মত নয়; বরং এ ধরনের উদ্যোগ বিপজ্জনকও হতে পারে।

আমরা জানি, রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ বেশি ভালো। প্রতিরোধ হলো অসংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক; কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে অগ্রাধিকার হিসাবে কোনো ব্যাপক প্রতিরোধ কৌশল বাস্তবায়িত হয়নি। যদিও কিছু সরকারি নীতি বা কর্মসূচি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার প্রসারের জন্য ব্যায়াম, খেলাধুলা বা শারীরিক কার্যকলাপের গুরুত্ব স্বীকার করে-এমন প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দের অভাব রয়েছে; অভাব রয়েছে আন্তরিক ও কার্যকর প্রচেষ্টার। এর ফলে সক্রিয় জীবনধারার কর্মসূচিগুলোর অগ্রগতি খুব একটা দৃশ্যমান হচ্ছে না।

সাম্প্রতিক সময়ে অসংক্রামক রোগের দ্রুত বৃদ্ধি, এর ব্যয় এবং জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরা ‘সক্রিয় জীবনধারা’কে জাতির জন্য স্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেন এবং সমন্বিত উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যাতে করে মানুষ আরও শারীরিক কার্যকলাপে নিয়োজিত হতে পারে। বিনোদনমূলক খেলাধুলা বা নাচ যেমন সক্রিয় জীবনধারার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সক্রিয় ভ্রমণের (যেমন-হাঁটা, সাইকেল চালানো) জন্য টেকসই সুযোগ তৈরি করাও তেমনই গুরুত্বপূর্ণ। এ কার্যক্রমগুলোর সহায়ক অবকাঠামোগত এবং সাংগঠনিক পরিবেশ তৈরি করা দেশে সক্রিয় জীবনধারার প্রসারের চাবিকাঠি। এ ছাড়া স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায়, বিশেষ করে শারীরিক কার্যকলাপ প্রচার ও নিষ্ক্রিয় বা অলস থাকা কমানোর ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত শিক্ষামূলক প্রচারণাও যথাযথভাবে বিবেচনা করা উচিত। অধিকন্তু উপযুক্ত স্বাস্থ্যকর জীবনধারা নীতি প্রচারের জন্য সমন্বিত স্বাস্থ্যকর জীবনশৈলী পরিকল্পনার জন্য পর্যায়ক্রমিক ব্যাপক এবং সমন্বিত নজরদারির বিষয়টিতেও যথাযথ মনোযোগ দেওয়া উচিত।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করা জিডিপির পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত (সরকারি খাতে ১%)। তাই সক্রিয় ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারায় বিনিয়োগ হতে পারে একটি সফল এবং কৌশলগত বিনিয়োগ, যা অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এবং একইভাবে চিকিৎসা খরচ কমিয়ে আনতে পারে। যত তাড়াতাড়ি আমরা স্বাস্থ্যকর জীবনধারার বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিতে পারব, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে পারব; তত তাড়াতাড়ি আমরা অসংক্রামক রোগের মহামারি থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারব।

আসাদুজ্জামান খান : সহযোগী অধ্যাপক, স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সায়েন্সেস, কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম