Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কিছুমিছু

গাধা শব্দটাই অতি মানানসই

Icon

মোকাম্মেল হোসেন

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গাধা শব্দটাই অতি মানানসই

দোকান খুলছি বিদ্যাশিক্ষার

আসেন যত ফাদার-মাদার

আন্ডাবাচ্চা লইয়া।

দায়দায়িত্ব সব আমাদের

আপনে জোগান দিবেন অর্থের

তবেই হবে মোক্ষলাভ

সবাই বলবে বাপরে বাপ॥

বিদ্যাশিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ে যাওয়ার নিয়ম। তবে আজকাল এ নিয়ম মানার প্রয়োজন নেই। কারণ, বিদ্যা জিনিসটা এখন পণ্যে পরিণত হয়েছে। আর এ পণ্য জনগণের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য রাস্তার মোড়ে মোড়ে খোলা হয়েছে প্রচুর দোকান। এমনই একটা দোকানে গিয়ে হাজির হয়েছেন ইয়াদ আলী। সেখানে কাউকে দেখতে না পেয়ে তিনি উচ্চৈঃস্বরে বললেন-

: এইখানে কেউ আছেন?

ইয়াদ আলীর গলা শুনে ভেতর থেকে এক যুবক বের হয়ে এলো। যুবকের নাম পানচু মোল্লা। পানচু মোল্লা এখানে অফিস সেক্রেটারি হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। ইয়াদ আলীকে একনজর দেখে পানচু মোল্লা বলল-

: এই যে আমি আছি; বলেন, কী দরকার।

: আইছিলাম একটু খোঁজখবর জানতে...

: ছেলে না মেয়ে?

: মানে?

: কার জন্য খোঁজ নিতে আসছেন? ছেলে সন্তান, না মেয়ে সন্তান?

: ছেলে সন্তান।

: কোন ক্লাসে পড়ে?

: এখনো ইস্কুলে দেই নাই। কেবল দুধ ছাড়াইন্না হইছে।

ইয়াদ আলীর কথা শুনে পানচু মোল্লা ইশারায় তাকে ভেতরে আমন্ত্রণ জানাল। ইয়াদ আলী ভেতরে গিয়ে চেয়ারে উপবেশন করার পর পূর্বের কথার রেশ ধরে পানচু মোল্লা বলল-

: ভালো, খুবই ভালো। পোলাপানরে সাইজ করতে হইলে কচি বয়সেই খোঁয়াড়ে ঢুকাইয়া দেওয়া উচিত। এই যে নেন আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রসপেক্টাস।

ইয়াদ আলীর প্রসপেক্টাস হাতে নিয়ে উলটেপালটে দেখতে লাগলেন। এ সময় পানচু মোল্লা উঠে দাঁড়ানোর কোশেশ করতেই ইয়াদ আলী জানতে চাইলেন-

: আপনে কই যান?

: আপনের জন্য একটু চা-নাশতার ব্যবস্থা করি।

: চা-নাশতা আনতে কি হোটেলে যাইতে হবে?

: মাথা খারাপ! আপনের মতন একজন সম্মানিত অভিভাবকের মেহমানদারি করব হোটেলের খাবারদাবার দিয়া?

: তাইলে?

: বাসায়ই সব সিস্টেম করা আছে।

: বাসা! বাসা পাইলেন কই? এইটা না অফিস?

ইয়াদ আলীর কথায় পানচু মোল্লা অট্টহাসি দিয়ে বলল-

: এইটারে যে অফিস মনে করে, তার কাছে অফিস; আর যে বাসা মনে করে, তার কাছে বাসা।

: বুঝলাম না।

: ইশারায় বললে বুদ্ধিমানে বুঝে; আর শানে-নজুল কইরা বললে গাধায় বুঝে। বলেন, আপনে কোন কাতারে আছেন?

: ধইরা নেন, আমি একটা গাধা। আপনে আমারে সবকিছু খেলাসা কইরাই বলেন।

পানচু মোল্লা লম্বা শ্বাস নিল। তারপর মুখ দিয়ে সব বাতাস বের করে বলল-

: আসলে এইটা হইল আমাদের প্রিন্সিপাল সাহেবের বাসা। বাসার ড্রয়িং রুমটারেই অফিস বানানো হইছে। আর আমি হইলাম সেই অফিসের সেক্রেটারি।

: আপনে সেক্রেটারি?

: জি।

: অ। আমি আরও মনে করছিলাম আপনে পিওন।

পানচু মোল্লা চোখ দুটো মার্বেলের মতো গোল করে ফেলল। এরপর দুই চোখের তারায় অত্যাশ্চর্য হওয়ার ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল-

: আমার মতন একজন অফিস সেক্রেটারিরে আপনে পিওন বানাইয়া দিলেন!

: আর আমার মতন একজন অভিভাবকরে আপনে যে গাধা বানাইয়া ফেললেন?

: কে বলল গাধা বানাইছি?

: একটু আগেই তো বললেন।

পানচু মোল্লা এবার দিলখোলা হাসি উপহার দিল। হাসতে হাসতে বলল-

: ওইটা তো একটা পয়ার-কথার কথা। আরে ভাইসাব, আপনে গাধা হইতে যাবেন কোন দুঃখে! আপনে হইলেন গাধার আব্বা।

: গাধার আব্বা!

: জি, গাধার আব্বা।

: আমার ছেলে গাধা, না ঘোড়া; বাঘ, না সিংহ-তা না দেইখাই আপনে তারে গাধা সাব্যস্ত কইরা ফেললেন?

পানচু মোল্লার ঠোঁটে এবার জ্ঞানী লোকের হাসি দেখা গেল। সে বলল-

: ভাইসাব, বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করেন। এই যে আপনে আসছেন; এখন সবকিছু শোনার পর, দেখার পর যদি আপনের সিদ্ধান্ত পজিটিভ হয়, তাইলে কী করবেন?

: আপনেই বলেন কী করব?

: সন্তানরে আমাদের হাওলায় দিয়ে যাবেন। ঠিক কিনা?

: হ।

: ধন্যবাদ। আপনের সন্তানরে আমরা গাধা হিসাবেই গ্রহণ করব। তারপর স্টেপ বাই স্টেপ সেই গাধারে পিটাইতে পিটাইতে মানুষ করব।

: আপনেরা তারে মারধর করবেন নাকি?

: মারধর তো মাস্ট। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র রাজনৈতিক ক্যাডাররা আজকাল টর্চার সেল খুইলা যেভাবে ছ্যাঁচা দেওয়ার কালচার চালু করছে, আমরা যদি পিটাইয়া পোলাপানের হাঁড়গোড় শক্ত কইরা না দেই, তাইলে তার পুরা বডি ছাতু হইয়া জিন্দেগি বরবাদ হইয়া যাবে। এইটা কি আমরা হইতে দিতে পারি? তবে...

: তবে কী?

: আমরা একতরফা কোনোকিছু করি না। মারধর যেমন করি, তেমনই আদর-সোহাগও করি। দুইটাই সমানতালে চলে।

: কী রকম?

: যেমন ধরেন, মাইরের চোটে কেউ যদি জ্বরে আক্রান্ত হয়, তার মাথায় জলপট্টি দিয়া দেই। প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়াই। হাত-পা ভাইঙ্গা গেলে ব্যান্ডেজ কইরা দেই।

: সিস্টেম খারাপ না। আপনের প্রিন্সিপাল সাব কই?

: প্রিন্সিপাল সাব সাইডে।

: সাইডে মানে?

: সাইডে মানে হইল প্রিন্সিপালগিরি তার আসল ব্যবসা না। তার আসল ব্যবস্থা হইল কন্ট্রাকটরি।

: ব্যবসা রাইখা মাস্টারি?

: না কইরা উপায় ছিল না। আপনেরে তো একে একে সব কথাই বইলা ফেলতেছি, এইটাও বইলা ফেলি। কনট্রাক্টর সাব তার এক বন্ধুর সঙ্গে শেয়ারে এই বাসাটা ভাড়া নিছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বন্ধু এই বাসায় উঠলেন না। তখন কী আর করা-কন্ট্রাক্টর সাব জাতিরে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার নিয়ত কইরা ফেললেন; নিজে প্রিন্সিপাল হইলেন আর বেগম সাবরে ভাইস প্রিন্সিপাল বানাইয়া এই প্রতিষ্ঠানটা খাঁড়া কইরা তার নাম দিলেন-মানুষ হও বিদ্যা নিকেতন।

: এইভাবে বাসা আর ইসকুল একসঙ্গে চালানো কি ঠিক?

: অবশ্যই ঠিক। শুধু ঠিক না, সঠিক। দেশের অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মার্কেট, দোকানপাট, গ্যারেজ, গার্মেন্ট ইত্যাদির সঙ্গে যদি চলতে পারে, তাইলে ইস্কুল চলতে পারবে না কেন? এইটা বরং পোলাপানের জন্য মঙ্গলজনক। যেমন ধরেন, এইখানের পরিবেশ হৃদয়ে ধারণ কিংবা এতে অভ্যস্ত হওয়ার পর সে যখন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবে, তখন তার পড়ালেখা করতে কোনো সমস্যা হবে না।

: আপনের কথা মাইনা নিলাম। এখন বলেন, ক্লাস কি এই বাসাতেই হয়?

: এইখানে ক্লাস হয় আবাসিক ছাত্র-ছাত্রীদের। অনাবাসিক ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস নেওয়ার জন্য চিকন খান লেনের ২৭ নম্বর বাড়িটা ভাড়া নেওয়া হইছে।

: চিকন খান লেনের ২৭ নম্বর বাড়ি? সর্বনাশ! কয়েক দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম বাড়িটা ঝুঁকিপূর্ণ; যে কোনো সময় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

: দুর্ঘটনা ঘটতে পারে-এই চিন্তা মাথায় রাইখাই বাড়িটা ভাড়া নেওয়া হইছে।

: আশ্চর্য তো!

: আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। ওইখানে যেসব ছাত্র-ছাত্রী ক্লাস করে, তাদের সবার জীবনবিমা করা আছে। যদি ঘটনা ঘইটাই যায়, তাইলে অভিভাবকদের পোয়াবারো। তারা এক থোকে অনেক টাকাপয়সা পাবে।

: আপনে মিয়া কসাইয়ের মতন কথা বলতেছেন।

ইয়াদ আলীর কথা শুনে পানচু মোল্লা ডানহাত উপরে তুলে বলল-

: থামেন। কথাটা শুনতে কসাইয়ের মতন মনে হইলেও এর বাস্তব দিকটারে আপনে অস্বীকার করতে পারবেন না। বিষয়টা একবার ভাইবা দেখেন-কাঁড়িকাঁড়ি টাকাপয়সা খরচ কইরা সন্তানরে আপনে লেখাপড়া শিখাইলেন। লেখাপড়া শিইখা সে কী হইল? হইল বেকার; ফুল টাইম বেকার। কাজ নাই-কর্ম নাই, আয় নাই-রোজগার নাই। এই রকম অবস্থার চাইতে শহিদ হওয়ার বিনিময়ে যদি কোনো সন্তান তার বাবা-মায়ের হাতে মোটা অঙ্কের টাকা তুইলা দিয়া যায়, তাইলে তার ক্ষেত্রে সেইটা ‘ইহকালেও সুখ, পরকালেও সুখ।’

পানচু মোল্লার ব্যাখ্যা শুনে ইয়াদ আলী মারাত্মক রকম রেগে গেলেন। বললেন-

: উষ্ঠা মারি এই সুখের কপালে। যত সব বদমাইশি কারবার।

: আপনে চেতেন ক্যান? আপনের দুধ ছাড়াইনা পোলা তো আর ওইখানে ক্লাস করতে যাবে না। তার জন্য আবাসিক ব্যবস্থা। আমাদের এই ব্যবস্থা অতি চমৎকার, অতি মনোরম।

: যেমন?

: যেমন-চব্বিশ ঘণ্টা যাতে তাদের উপর খবরদারি করা যায়, সেই জন্য এই বাসার ছাদের উপর তাদের থাকার বন্দোবস্ত করা হইছে।

: উন্মুক্ত ছাদের উপর থাকার ব্যবস্থা?

: সমস্যা কী? ভবিষ্যতে তারা যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমে থাকতে গিয়া বিব্রতবোধ না করে, সেই জন্য উন্মুক্ত ছাদই উত্তম ব্যবস্থা। অবশ্য আমাদের ছাদের উপরে টিনশেড আছে।

: কিন্তু গরমে তো পোলাপান আলুর চপ হইয়া যাবে।

: সেরকম আশঙ্কা নাই। সিলিং ফ্যানের ব্যবস্থা আছে।

: এরা ক্লাস করে কই?

: আলাদা ক্লাসের কোনো ব্যবস্থা নাই। ওখানেই খাওয়াদাওয়া, ওখানেই হাগা-মুতা, ওইখানেই লেখাপড়া। ফুলটাইম জব। সেখানে তারা কীভাবে পড়ছে, কীভাবে খাচ্ছে, কীভাবে ঘুমাচ্ছে, কীভাবে টয়লেট ইউজ করছে-সবকিছু সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে একেকজনের জন্য একেকরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

ইয়াদ আলী গভীর আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন-

: কী রকম ব্যবস্থা?

: যেমন ধরেন, পর্যবেক্ষণে কারও মধ্যে যদি নকলবাজির প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তাইলে তাকে নকলের যত রকম কায়দাকানুন আছে, সব শিখাইয়া দেওয়া হয়, যাতে পরীক্ষায় নকল করতে যাইয়া ধরা না খায় এবং পরবর্তী সময়ে যাতে নকলের উপরেই তার ক্যারিয়ার ডেভেলপ করতে পারে। আবার কারও মধ্যে মারামারির প্রবণতা লক্ষ করলে তারে কম্বল প্যারেড করানোর পর এখানে-সেখানে চান্দা তুলতে পাঠানো হয়, যাতে সে বড় হইয়া একজন তুখোড় চাঁদাবাজ-মাস্তান হইতে পারে। আবারও কারও মধ্যে ভাবের আধিক্য দেখা গেলে তার মসুর ডালের বাটিতে ফেনসিডিল মিশাইয়া দেওয়া হয়, যাতে সে এইসবে অভ্যস্ত হইতে হইতে পরবর্তীকালে একজন বড় ভাবুকরূপে অবির্ভূত হইতে পারে।

: এরা সবাই কি এক কক্ষেই বসবাস করে?

পানচু মোল্লা হেসে বলল-

: না। নেচার অ্যান্ড ক্যারেক্টার অনুযায়ী এদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রকোষ্ঠের ব্যবস্থা আছে। যেমন: নকলবাজ প্রকোষ্ঠ, দাঙ্গাবাজ প্রকোষ্ঠ, ভাবুক প্রকোষ্ঠ প্রভৃতি।

: অভিভাবকদের জন্য কোনো প্রকোষ্ঠের ব্যবস্থা রাখেন নাই?

: আছে, তাদের জন্য ব্যবস্থা রাখা হইছে। অভিভাবকরা যাতে এইখানে আসার পর সেই প্রকোষ্ঠে বইসা বিশ্রাম নিতে পারেন, সন্তানসন্তুতির লেখাপড়ার খোঁজখবর নিতে পারেন, সেই জন্য একটা প্রকোষ্ঠ নির্মাণ করা হয়েছে, যার নাম আব্বা-আম্মা প্রকোষ্ঠ।

পানচু মোল্লার কথা শুনে ইয়াদ আলী কিছুক্ষণ মাথা দোলালেন। তারপর বললেন-

: উহু! আমার মনে হয়, এর নাম গাধা প্রকোষ্ঠ রাখা উচিত।

পানচু মোল্লা অবাক হয়ে বলল-

: গাধার ব্যাপারে না কিছুক্ষণ আগে আপনে আপত্তি জানাইলেন?

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মুচকি হেসে পানচু মোল্লার উদ্দেশে ইয়াদ আলী বললেন-

: তা জানাইয়াছিলাম; কিন্তু এইখানের সব ব্যবস্থা দেইখা এবং আপনের কথাবার্তা শুইনা আমার মনে হইছে, আমরা যারা পোলাপানের বাপ-মা কিংবা অভিভাবক আছি, তাদের জন্য ‘গাধা’ শব্দটাই অতি মানানসই।

মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

mokamia@hotmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম