Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাংলার বিচারালয়ে বাংলাবিবাদ

Icon

মঈদুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলার বিচারালয়ে বাংলাবিবাদ

কোর্ট-কাচারি ভালো করে চেনা ছিল না ১৯৮৫-র অক্টোবরে লাইসেন্স পেয়ে ওকালতিতে নামার আগে। মুন্সেফ-মোক্তার দূরে থাক, মক্কেলও ছিল না কেউ চৌদ্দগুষ্টিতে। আমাতেই শুরু সে পাট, আমাতেই শেষ। লাইসেন্সের আগে ছয় মাসের শিক্ষানবিশিতে পুরো ফাঁকি মারার শোধ দিতে হয়েছে পরে ছাব্বিশ মাস দিয়ে। ওকালতি আর হয়ে ওঠেনি, ছাব্বিশ মাস জজ কোর্টে গেছে জুনিয়রগিরিতে। জজিয়তিটা না জুটলে আরও কত ছাব্বিশ যেত কে জানে! ছিলাম সিভিলে। সেকালের সিভিলে জুনিয়রদের আরজি-জবাব লেখার ট্রেনিংটা হতো সত্যি সত্যি হাতেকলমে। সিনিয়র ডিকটেশন দিতেন, হাতে কলম নিয়ে লিখতাম কাগজে। সেই মুসাবিদা পরে টাইপ করিয়ে দাখিল হতো কোর্টে। সিনিয়রের সেরেস্তায় কাজ হতো সব ইংরেজিতে। বাংলাটা চলত শুধু টাইম পিটিশনে মোহরারের লেখাতে। বাংলাও চলত অল্পকিছু সেরেস্তাতে। বাংলা চলত ইংরেজির পিছে পিছে লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে। সদম্ভে চলত ইংরেজি বাংলার বিচারালয়ে।

১৯৮৭-র ৩ মার্চের পরে শুরু হলো খাস বাংলাতে। সেদিন থেকেই জারি হয় ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’। বাংলা ছাড়া চলবে না আর অন্য ভাষা অফিস কিংবা আদালতে। ‘আইন আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার‌্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ আইনের কারবারি সিনিয়র ইংরেজি ছেড়ে বাংলা ধরলেন আইন মেনে। ইংরেজিতে ডিকটেশন দেওয়া ছিল যার এতকালের অভ্যাস, তিনিই দেখি দিচ্ছেন চমৎকার বাংলায় অনায়াসে। ইংরেজি ভালো জানা বাঙালি বাংলাটা তো ভালো জানবেই। বাংলার মাটিতে জন্ম তার বাঙালির ঘরে। শুধু আমার সিনিয়র নন, রাজশাহী জজ কোর্টের সব সিনিয়র-জুনিয়র সিভিলের আরজি-জবাব, ক্রিমিনালের জামিন-নালিশি দরখাস্ত সবই করতে লাগলেন খাস বাংলাতে। জজ-ম্যাজিস্ট্রেটরাও রায়-আদেশ-ডিক্রি সব দিতে লাগলেন বাংলাতেই।

জুনিয়রগিরি চুকিয়ে ১৯৮৮-র ফেব্রুয়ারিতে ঢুকলাম জজিয়তিতে। এলাম উপজেলা আদালতে, ভিন্ন এক জেলায়। দেখি সে জেলার সব আদালতে বাংলাই চলছে, ইংরেজির পাত্তা নেই কোনোখানে। দেশের জেলায় জেলায় সব আদালতে বাংলা চালু হয়ে গেছে জোরেশোরে। দিনে দিনে বাংলা ততদিনে পাকাপোক্ত হয়ে বসেছে অধস্তন সব আদালতে, ইংরেজি ভেগেছে পাততাড়ি গুটিয়ে। তক্ষুনি খবর হলো, কাম সারছে! হাইকোর্টের রায় হয়ে গেছে, ইংরেজিটাও চলবে আগেকার মতো। বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটাই চলবে না আর অধস্তন আদালতে (হাইকোর্টে আইনটা চলেইনি মোটে)।

উপজেলার সব আদালতে সরকারি গেজেট আর ডিএলআর-এর নিয়মিত বরাদ্দ ছিল, সরাসরি আসত ডাকে। ডিএলআর আসত দুমাসের দুটি ইস্যু একসঙ্গে। ১৯৯২-এর মাঝামাঝিতে পাওয়া গেল ৪৪ ডিএলআর ৩৩২ পৃষ্ঠায় হাইকোর্টের সেই রায়, হাসমতউল্লাহ বনাম আজমিরি বিবি গং মামলার। চক্ষু-কর্ণের বিবাদ হলো ভঞ্জন। ইংরেজিতেই লেখা রায় ১৯৯১-এর ২৮ নভেম্বরে। ফ্যাসাদটা বেধেছিল সিভিলেই। অধস্তন কোনো এক (নামধাম নেই সেই রায়ে) আদালতে ইংরেজি আরজি-জবাব নিয়ে চলে আসা পুরোনো এক মামলায় বাদীর আইনজীবী অস্থায়ী-নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত ইংরেজিতে করেন ১৯৮৭-এর ২২ মার্চে। অর্থাৎ কিনা, বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটা প্রচলন হওয়ার ১৯ দিন পরে (আইন ভাঙার বুদ্ধি ছিল ঘটে)! বিবাদীর আইনজীবীও লিখিত আপত্তিটা দেন ইংরেজিতে (বুদ্ধিতে কম কীসে!) ১৯৮৭-র ৩১ মার্চে। ইংরেজিতে লেখা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার দরখাস্তটা রেখে বাংলায় ছাড়া চলবে না বলে আদালত প্রত্যাখ্যান করেন শুধু ইংরেজিতে লেখা আপত্তিপত্রটা (একটা পক্ষে তো যেতেই হয় আদালতকে!)। ঠ্যালা সামলাতে ইংরেজি-বিবাদী হাইকোর্টে রিভিশনে আসে ১৯৮৭-তেই। ১৯৮৯-তে আরেকটা, ১৯৯০-তে ৬টা, ১৯৯১-তে ১০টা, সব মিলে আরও ১৭টা মামলা আইনজীবীরা দাখিল করেন ইংরেজিতে লেখা আরজি দিয়ে (আদালতের নামধাম নেই সেই রায়ে)। বাংলায় ছাড়া চলবে না বলে বিবাদীরা সব আরজি প্রত্যাখ্যানের দরখাস্ত দিলে সব কটাই যার যার আদালতে নামঞ্জুর হয় যার যার সালে। ঠ্যালা সামলাতে বাংলা-বিবাদীরাও রিভিশনে আসে হাইকোর্টে যার যার সালে।

সেই ১৮টি রিভিশনের একসঙ্গে শুনানি হয় দ্বৈত বেঞ্চে, ফয়সালা হয় এক রায়ে। ইংরেজিওয়ালাদের ছিল বাঘা বাঘা সব আইনজীবী। তারা আগে কেউ বিচারপতি, কেউ অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন, পরে কেউ বিচারপতি, কেউ অ্যাটর্নি জেনারেল হন, বাকিরা পরে বাঘা হন আরও। হেরে যায় বাংলা, জিতে যায় ইংরেজি, যুক্তির মারপ্যাঁচে। সেই সনাতন যুক্তি-ফাঁক আছে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনেই! সেই ফাঁকে পেনালটি গোল পেয়ে জিতে যায় ইংরেজি বাংলার বিচারালয়ে! অধস্তন আদালতের ভাষার যেসব বিধান আছে দেওয়ানি-ফৌজদারি কার্যবিধিতে, তাতে ইংরেজিও চলার কথা লেখা আছে। সংশোধন করা হয়নি সেসব, বাতিলও করা হয়নি নাম ধরে। আদালতের ভাষার ব্যাপারে কার্যবিধি দুটোই ‘বিশেষ আইন’ (স্পেশাল ল), আর ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ হলো ‘সাধারণ আইন’ (জেনারেল ল) মাত্র। বিশেষ আইনের বিশেষ বিধান ভেসে যায় না সাধারণ আইনের পাইকারি কথার তোড়ে। আইনপ্রণেতাদের জানা সবই। আদালতে ইংরেজি চলা বন্ধ করার ইচ্ছাটা যদি সত্যিই তাদের থাকত, তবে তো কার্যবিধি দুটোতেও একটু কাটাকুটি করতেন, কাটাকুটিটা বাংলা ভাষা প্রচলন আইনেও তো একটু লিখতেন! বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটা হয়েছে সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের দোহাইয়ে। সে অনুচ্ছেদ তো রাষ্ট্রভাষার। রাষ্ট্রভাষা বিশাল সিন্ধু ব্যাপার! সেই সিন্ধুর গভীরে দপ্তরের ভাষা (অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ), আদালতের ভাষা (কোর্ট ল্যাঙ্গুয়েজ), এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সব বিন্দু থাকে। বিশাল সিন্ধু শুধু রাষ্ট্রভাষা প্রচলনের কথাতে ক্ষুদ্র এক বিন্দু আদালতের ভাষার কথা টের পাওয়া যায় না ঘুণাক্ষরেও। আদালতের ভাষা ঠিক করে দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের আছে দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭(২) আর ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫৮ ধারাতে। কিছুই তো করা হয়নি সে দুটো দিয়ে।

সুতরাং, আদালতে ইংরেজিও চলবে, যেমন চলে আসছিল রাষ্ট্রভাষা প্রচলনের আগে থেকে। নিম্ন আদালত ঠিক করেছে ১৭ বার ইংরেজিতে লেখা আরজি গ্রহণ করে, আর ভুল করেছে প্রথমেই শুধু ইংরেজিতে লেখা আপত্তিপত্রটা প্রত্যাখ্যান করে! হৃদয় জুড়াল ইংরেজির, জেঁকে বসল আবার অধস্তন আদালতে। সুপ্রিমকোর্টে তো তার আসন টলেইনি। বোঝা গেল, আইন না মানা স্বভাব কেন বেশি এদেশে! আইনের ফাঁক আর ফাঁক ধরা ওস্তাদে ভরা (কোনটা যে বেশি কে দেখে হিসাব কষে!) দেশে আইন মানে কিছু ভিতু বোকাতে! দাপুটেরা বুদ্ধিমান, জানে ভাঙলেই ফাঁক বেরুবে আইনে, অভাব হবে না ফাঁক ধরা ওস্তাদের! ছা-পোষা বাঙালি ততদিনে মজেছি বাংলাতে। বাংলাটা বিদায় করেনি, তাতেই রক্ষা! জজিয়তিটা শেষ করি বাংলাতেই। বছরে দুটো করে ইংরেজি রায় লিখতে হয়েছে নিতান্তই এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন) বাঁচাতে, পাছে পদোন্নতিতে না পিছলে পড়ি সেই ভয়ে। তাতেই ভোগায় পাপবোধে! ইংরেজ তো কেউ ছিল না মামলার কোনো পক্ষে। ইংরেজিতে রায় চায়নি কোন মক্কেলে। বাঙালি বিচারকের দেওয়া ডিক্রি-ডিসমিস, সাজা-খালাসের মর্ম বুঝতে বাঙালি মক্কেলকে ইংরেজি মাস্টার ধরতে হবে!

এসবের ফয়সালা হয়নি হাইকোর্টের রায়টাতে। আপিল বিভাগে যায়নি আর ১৮ মামলার কেউ। বাঙালিকে হাইকোর্ট দেখিয়েই শেষ! হাইকোর্ট পর্যন্ত আসতে-লড়তেই দম ফুরিয়েছে বাংলা-বিবাদীদের, আশা-ভরসা সব শেষ। সরকারের দম ফুরাল কীসে! সংসদ চলে বাংলায়, আইন-বিধি হয় বাংলায়। সরকারি সব দপ্তর চলে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের কথায়। চলে না কেবল আদালত, সে-আইনে পরিষ্কার লেখা থাকা সত্ত্বেও। চলে ব্রিটিশি চালে।

নিজেদের করা আইনের প্রয়োগে ব্যর্থতা মেনে সরকার নির্বিকার হাইকোর্টের এক কথাতে। আপিল বিভাগে চ্যালেঞ্জ তো করার ছিল সরকারি স্বার্থে, রাষ্ট্রীয় স্বার্থে, জনস্বার্থে! বলার ছিল, বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটা সামরিক ফরমানে নয়, হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের মালিক’ (অনুচ্ছেদ ৭) যে জনগণ, সেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদে। হয়েছে ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্ত’ (অনুচ্ছেদ ৭) যে সংবিধান, সেই সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদের জোরে। যেখানে জনগণ একবাক্যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করে কেবল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেছে, রাষ্ট্রের সব কার্যালয়ে বিচারালয়ে আচার-বিচার সব নিশ্চিত বাংলায় পাবে বলে। বলার ছিল, সেই অভিপ্রায় ব্যক্তের সঙ্গে সঙ্গেই সব কার্যালয়ে, বিচারালয়ে আচার-বিচার সব বাংলায় পাওয়ার ছিল জনগণের। কার্যালয় বিচারালয়গুলো সেই অভিপ্রায়কে পাত্তা না দিয়ে ১৫ বছর ধরে বেয়াড়াপনা-বেয়াদবি করে এসেছে মালিকের সঙ্গে। সেই চরম অবাধ্যতা থামাতে এ বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটা হয় জাতীয় সংসদে, সংবিধানের রাষ্ট্রভাষার বিধানমতে।

বলার ছিল, সংবিধানের চেয়ে বড় নয় কোনো কার্যবিধি। কার্যবিধির যে বিধান সংবিধানের সঙ্গে অসমঞ্জস লাগে, সে-বিধানটা বাতিল বলেই জনগণের অভিপ্রায় রাখা আছে (অনুচ্ছেদ ৭ ও ২৬)। বাতিল ঘোষণার এখতিয়ারটা দেওয়া আছে হাইকোর্টকেই। সেই আমানতের খেয়ানত মানায় না সর্বোচ্চ বিচারালয়ে। বলার ছিল, সংবিধানমতে বিচারালয়ে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটাই চলে, চলে না আর দেওয়ানি-ফৌজদারি কার্যবিধির ওসব বিধান। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন চলার কথা সুপ্রিমকোর্টেও, চলবে না সংবিধানের সঙ্গে বেখাপ্পা আইন-বিধি। আদালত অর্থে সুপ্রিমকোর্টকেও ধরে রেখেছে জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিতে (১৫২ অনুচ্ছেদে)। বলার ছিল, হাইকোর্ট বিভাগের সেই রায়ে ভুল হয়েছে এখানটাতে, ভুল হয়েছে ইংরেজিতে রায়টা লেখাতেও।

আপিল করেনি সরকার। তবে কি সত্যি সদিচ্ছা ছিল না বিচারালয়ে বাংলা ভাষা প্রচলনের! আপিলটা হলে দেখার ছিল, বাংলার স্বাধীন দেশে কার ভাষাটা আদালতের ভাষা হবে। কার ভাষাতে আরজি-জবাব, রিট-পিটিশন, রুলনিশি, রায়-ডিক্রি, আদেশ লেখা হবে। আইনজীবীর, নাকি বিচারকের, নাকি বিচার চাওয়া মক্কেলের ভাষাতে। লেখা হবে কার অভিপ্রায়ে। জানা যেত, সেই ১৮ মামলায় ইংরেজি জানা মক্কেল ছিল কতজন। আপত্তিপত্র, আরজিগুলো ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল কি পয়সা দেওয়া মক্কেলের অভিপ্রায়ে! আদালতে ঘোরা মক্কেলের কতভাগ ইংরেজি জানা! বিচার পাওয়ার সঙ্গে বোধগম্য ভাষায় বিচার পাওয়াটাও বিচারপ্রার্থীর মৌলিক অধিকার বটে। বিচার করাই তো যথেষ্ট নয়, সঠিক বিচারই যে হলো সেটাও তো বোঝানোর কথা বিচারের নীতিতে। প্রিভি কাউন্সিলে বিচার যায় না আর। অবাঙালি মক্কেল দু-একজন যদিওবা কখনো জোটে, অবাঙালি কোনো বিচারক, আইনজীবী জুটবে না এদেশে। ইংরেজিটা তবে কীসের জন্য! বাঙালির বিচারের কথা বাঙালি বিচারক, বাঙালি আইনজীবী বাংলায় লিখতে জানেন না বলে ভাবতেও তো লজ্জা লাগে। খেয়ালখুশিতে দু-একটা যদি বাংলায় লেখা যায়, তবে নিশ্চয় যায় সবটাই।

অধস্তন আদালতে যেটুকু বাংলার চল, সেটুকু ওই ব্রিটিশেরই বদৌলতে। তার আগে বাংলা ছিল না বাংলার কোনো বিচারালয়ে। তুর্কি, পাঠান হয়ে মোগল আমলে বাংলা-বিহার-ওড়িশাসহ ভারতের সব মুলুকে দরবারের ভাষা, আদালতের ভাষা ছিল ফারসি। ১৭৯৩ ও ১৭৯৭-এর রেগুলেশনে নিম্ন আদালতে দেশি ভাষায় সাক্ষ্য নেওয়া দিয়ে শুরু ব্রিটিশের। ফারসি উঠিয়ে ভারতীয় ভাষাগুলোকে নিম্ন আদালতের ভাষা করতে চায় খরচ বাঁচাতে। ব্রিটিশকেও সে কাজে বেগ পেতে হয় ব্রিটিশ বিচারকদের কাছেই। শেষে লর্ড অকল্যান্ডের আমলে ১৮৩৭-এর ২৯ নম্বর আইনে গভর্নর জেনারেল ক্ষমতা পায় ভারতীয় ভাষাগুলোকে যার যার মুলুকে নিম্ন আদালতের ভাষা করার। শুরু হয় দেশি ভাষাকে নিম্ন আদালতের ভাষা করা, ইংরেজিটা সঙ্গে রাখা হয় যদি কারও ইচ্ছা করে তবে। বাংলা মুলুকের নিম্ন আদালতের ভাষা হলো বাংলা, সঙ্গে রইল ইংরেজি, যদি কারও ইচ্ছা করে তবে। ফল হলো ঠিক উলটো-ইংরেজিকেই আদালতের ভাষা মানে, বাংলাটা চলে ইচ্ছার ওপরে।

স্বাধীন বাংলাদেশের বিচারালয়ে বাংলা কি আর ইচ্ছাধীন থাকা চলে! স্বাধীনতার পর ভারত অফিস-আদালতের কাজে ইংরেজিকে সংবিধানেই রেখেছে অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দির পাশে। ভিন্ন ভাষাভাষীর বহু রাজ্য আর অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ রাখার একটা যুক্তি পায় তারা, ইংরেজিটা রেখেছেও রাখঢাক না করেই। কোথায় কতটুকু কোন ভাষা চলবে তারও বিধান করেছে সংবিধানে আলাদা একটা পার্ট করে ৪টা চ্যাপ্টারে ৯টা অনুচ্ছেদে। আদালতের ভাষার জন্য আলাদা একটা চ্যাপ্টারও করেছে। সেখানে হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টের ভাষার চলও ঠিক করা আছে। পাকিস্তানের কথা তুললেই তো ভাষা আন্দোলনের কথা চলে আসে, রক্ত দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা পাওয়ার কথা মনে পড়ে! ভিন্ন ভাষাভাষীর কিছু প্রদেশের দেশ পাকিস্তানের সংবিধানেও অফিস-আদালতের কাজে ইংরেজি চলার বিধান ছিল, আছে এখনো। তারাও একই যুক্তি পায় ভারতের মতো।

দেশ ছাড়া আমাদের নেই কোনো প্রদেশ, ভিন্ন কোনো ভাষা নেই বাংলা ছাড়া। হুজ্জতি ছাড়া কোনো যুক্তি নেই। সংবিধানে তাই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ বলেই শেষ। তাতেও যখন পোষায় না হুজ্জতে বাঙালির, তখন সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগে বিচার বিভাগের ভাষার একটা অনুচ্ছেদ বসালেই তো মিটে। যেখানে লেখা থাকবে, ‘সুপ্রিম কোর্ট, অধস্তন সব আদালতে বিচারের যাবতীয় কার্য অবশ্যই বাংলা ভাষায় সম্পাদন হইবে। মামলামোকদ্দমার এক পক্ষে অবাঙালি থাকিলে বাংলার সহিত আদালতের অনুমোদিত ইংরেজি অনুবাদ অতিরিক্ত হিসাবে চলিবে। কোনো পক্ষেই কোনো বাঙালি না থাকিলে সেই ক্ষেত্রে কেবল ইংরেজি চলিবে।’ তার সঙ্গে মিলিয়ে আদালতের ভাষার একটা আইন করলেই হয় দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭(২) আর ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫৮ ধারা দিয়ে। সেইমতো হাইকোর্ট আর আপিল বিভাগের রুলসে ভাষার বিধান মিলিয়ে নিলেই হয়। মেরামত করলেই হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইনে হাইকোর্টের রায়ে ধরা ফাঁকগুলোর সংশোধনী দিয়ে। সবই করা যায় রক্তে পাওয়া রাষ্ট্রভাষা বাংলার ন্যায্য পাওনাটা দিতে, হুজ্জতিটা একটু ছাড়লে, সদিচ্ছাটা সত্যিই থাকলে।

মঈদুল ইসলাম : প্রবন্ধকার ও আইন গ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক

moyeedislam@yahoo.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম