Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ইন্টারনেটে অবাধ স্বাধীনতা ও সাইবার বুলিং

Icon

ফারিহা জেসমিন

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইন্টারনেটে অবাধ স্বাধীনতা ও সাইবার বুলিং

ইনবক্স খুললেই ভেসে আসে নোংরা ছবি, ভিডিও ক্লিপ, অশ্লীল বা হুমকিমূলক বার্তা। ফলাফল মানসিক হতাশা, সামাজিক ভীতি; কখনো কখনো আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত। এ দৃশ্যপট শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো পৃথিবীতেই। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে মৃত্যুবরণ করা কোরিয়ান কে-পপ তারকা থেকে শুরু করে ২০২২ সালে ঢাকার বাসাবোতে আত্মহত্যা করা কিশোরী মেয়েটি ছাড়াও রয়েছে আরও কত শত উদাহরণ।

নেপথ্য কারণ কী? কারণ, নতুন বৈশ্বিক সামাজিক সমস্যা-সাইবার বুলিং বা ভার্চুয়াল হয়রানি। বিশ্বায়নের উপচেপড়া সুযোগ-সুবিধার যুগে যখন উন্নত প্রযুক্তি অধিকাংশ লোকের হাতে হাতে, তখন সাইবার বুলিং-এর পরিসর বেশ বড় এবং এর প্রভাব মারাত্মক। এটি সাম্প্রতিক সময়ে সবার নজরে আসা একটি সামাজিক সমস্যা, বড় অর্থে একটি গুরুতর সামাজিক অপরাধ।

বিভিন্ন রকমের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ই-মেইল, খুদে বার্তা, গেমিং প্ল্যাটফর্ম বা মুঠোফোন ইত্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিথ্যাচার করা, কারও পক্ষ হয়ে কাউকে বাজে কথা লিখে পাঠান, বিব্রতকর ছবি/ভিডিও পোস্ট করা; কাউকে আক্রমণাত্মক কথা বলা বা ছবি দেওয়া এর মধ্যে পড়ে।

উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বা শত্রুতার জেরে ইন্টারনেট ব্যবহার করে কারও ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া কিংবা ফেসবুক আইডি হ্যাক করে হুমকি দিয়ে অর্থ আদায় করা, কখনো ছবি বা ভিডিও এডিট করে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া-এসব বুলিং এখন নিত্য ঘটে চলেছে। এ ছাড়া ফটোশপ করা ছবি, পর্নোগ্রাফি ছবি দিয়ে আপত্তিকর কনটেন্ট বা ফেক আইডি তৈরি করে, ফোন নম্বর ছড়িয়ে দিয়ে হয়রানিমূলক এসএমএস, মেইল বা লিংক পাঠানোসহ বিভিন্ন উপায়ে হয়রানি করা হয়।

ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে আজেবাজে কন্টেন্ট পাঠানো, অন্তরঙ্গ ছবি ছড়িয়ে হয়রানি করা বা যৌন হয়রানি তো আছেই। এমন সব কাজের মাধ্যমে কাউকে সামাজিকভাবে হেনস্তা বা বদনাম করার নাম সাইবার বুলিং বা ভার্চুয়াল হয়রানি।

প্রযুক্তি মানুষের জীবনে আলো ছড়ায়। প্রযুক্তির ব্যবহার জীবনকে সহজ করে। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার বা অপপ্রয়োগ জনজীবনকে অন্ধকারে ঢেকে দিতে পারে, কঠিন করে তুলতে পারে। নিজে শিকার হয়েছেন বা কারও কাছে গল্প শুনেছেন-এমন মানুষের কাছে সাইবার বুলিং একটি আতঙ্কের নাম। আধুনিক প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগে মানুষকে হেনস্তার আধুনিকতম উপায় সাইবার বুলিং বা ভার্চুয়াল হয়রানি, যার পেছনে রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহজ প্রবাহ এবং ইন্টারনেটের অবাধ স্বাধীনতা।

ইউনিসেফ বলছে, ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাউকে হয়রানি করার নামই সাইবার বুলিং। এটি সামাজিক মিডিয়া, মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম, গেমিং প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল ফোনে ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে যাদের টার্গেট করা হয়, তাদের ভয় দেখানো, রাগিয়ে দেওয়া, লজ্জা দেওয়া বা বিব্রত করার জন্য বারবার এরূপ আচরণ করা হয়। যেমন, সামাজিক মাধ্যমে কারও সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া বা বিব্রতকর অথবা অবমাননাকর ছবি পোস্ট করা, মেসেজিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্ষতিকর মেসেজ দেওয়া বা হুমকি দেওয়া, অন্যের ছদ্মবেশ ধারণ করে তার পক্ষে আর একজনকে মেসেজ পাঠানো।

মুখোমুখি বুলিং এবং সাইবার বুলিং প্রায়ই একে অপরের পাশাপাশি ঘটতে পারে। তবে, সাইবার বুলিং একটি ডিজিটাল পদচিহ্ন রেখে যায়। এ ডিজিটাল পদচিহ্ন এমন একটি রেকর্ড, যা কার্যকর প্রমাণ হিসাবে কাজ করতে পারে এবং অপব্যবহার বন্ধে সহায়তা করতে প্রমাণ সরবরাহ করতে পারে।’

ইন্টারনেট মানুষে মানুষে যোগাযোগকে একেবারেই সহজ করে দিয়েছে, যার উদাহরণ হলো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম যেমন-ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে দিয়েছে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের বাঁধ। সংগঠিত হচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সাইবার বুলিংসহ বিভিন্ন অপরাধ। অন্যদের সঙ্গে সঙ্গে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীরাও এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন। কেউ বুলিং করছেন, কেউ কেউ এর শিকার হচ্ছেন। তবে গবেষণা বলছে, পুরুষের তুলনায় নারীরা এ পরিস্থিতির শিকার হন বেশি। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম ও টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে হরহামেশাই নারীরা বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন।

সংবাদমাধ্যমেও উঠে এসেছে, সাইবার বুলিং, ট্রলিং, তথ্য অপব্যবহার ও প্রকাশ, ব্ল্যাকমেইলিং, রিভেঞ্জ পর্নোসহ বিভিন্ন উপায়ে সাইবার স্পেসে যত হয়রানির ঘটনা ঘটে, তার প্রধান শিকার হন নারীরা। ভুক্তভোগী নারীরা অধিকাংশ সময় বুঝতে পারেন না এর প্রতিকারে তার করণীয় কী? অনেক ক্ষেত্রে পরিবারকে জানাতে বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ জানানোর ব্যাপারে তারা দ্বিধাবোধ করেন। এসব নারীর পাশে দাঁড়াতে ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) নামক একটি পরিষেবা।

সংবাদমাধ্যমে পাওয়া তথ্যমতে, গত দুই বছরে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে আসা অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ছবি ও পরিচয় গোপন করে ভুয়া আইডি খুলে ভুক্তভোগীর ছবি, ভিডিও ও তথ্য প্রকাশ করে-এমন অভিযোগ এসেছে ৪৩ শতাংশ। ১৩ শতাংশ অভিযোগ-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইডি হ্যাক, পাসওয়ার্ড চুরি করে অ্যাকাউন্টের দখল নেওয়ার।

পূর্বপরিচয় বা সম্পর্কের জের ধরে বা অন্য কোনোভাবে প্রাপ্ত ছবি, ভিডিও বা তথ্য প্রকাশের হুমকি দিয়ে টাকা বা সুবিধা আদায় করার অভিযোগ ১৭ শতাংশ। মুঠোফোনে কল করে বা খুদে বার্তা পাঠিয়ে হয়রানি ১০ শতাংশ; বিভিন্ন মাধ্যমে অশ্লীল শব্দ, লেখা, ছবি বা ভিডিও হয়রানির অভিযোগ ৯ শতাংশ। এর বাইরে অন্যান্য অভিযোগ রয়েছে আরও ৮ শতাংশ। ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর পিসিএসডব্লিউ যাত্রা শুরু করার পর থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ২ বছরে ২১ হাজার ৯৪১ নারী এ সংস্থার কাছে হয়রানির অভিযোগ করেছেন।

এর মধ্যে বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৭ হাজার ৮৮৯টি অভিযোগ এসেছে; অর্থাৎ গড়ে মাসে ৭৮৯টি অভিযোগ। এ ছাড়া ৯৯৯-এ উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির অভিযোগ সংক্রান্ত গত চার বছরের কল বিশ্লেষণে দেখা যায়, দিন দিন এমন ঘটনা বেড়ে চলেছে। এ জরুরি নম্বরে ২০১৮ সালে ৬৯২টি, ২০১৯ সালে ৭৩৭টি, ২০২০ সালে ৮৯৫টি এবং ২০২১ সালে ১ হাজার ৭১টি কল এসেছিল। ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৯ মাসে এসেছে ১ হাজার ৪৪৪টি কল; অর্থাৎ মাসে গড়ে ১৪১টি অভিযোগ।

ইন্টারনেটে অবাধ বিচরণের স্বাধীনতা, সহজলভ্যতা, নজরদারির অভাব-এসব কারণে সাইবার বুলিং দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে আরও বেড়ে গেছে। একমাত্র আইন এবং আইনের প্রয়োগ অর্থাৎ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পারে এ অপরাধ কমিয়ে আনতে। সাইবার অপরাধ দূর করতে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে। সাইবার নিরাপত্তা এবং সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ, তদন্ত ও বিচারের উদ্দেশ্যে ২০০৬ সালে প্রণয়ন করা হয় তথ্য ও প্রযুক্তি আইন, যা ২০১৩ সালে আবার সংশোধন করা হয়েছে।

২০১২ সালের পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি বহন, বিনিময়, মুঠোফোনের মাধ্যমে ব্যবহার করা, বিক্রি প্রভৃতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকার ২০১৩ সালে সাইবার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণীত হয়। সাইবার বুলিংয়ের অপরাধীদের যথাযথ শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে ডিজিটাল আইন-২০১৮তে। ধারা ২৮, ২৯ এবং ৩১ এ বুলিংয়ের বিভিন্ন শাস্তি সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে।

সাইবার বুলিং একটি মারাত্মক অপরাধ এবং মানুষকে হেনস্তা করার একটি অসুস্থ মাধ্যম। বুলিংয়ের শিকার হওয়া ৮৮ শতাংশ নারীই সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে আইনি সহায়তা নিতে আসেন না; কিন্তু তারা প্রতিনিয়তই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। সাইবার বুলিং প্রতিকারে সাইবার আইন মেনে চলা, সবাইকে সচেতন করা, এর ক্ষতিকর দিক ও শাস্তি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বুলিংয়ের শিকার হয়ে ঘরে বসে হতাশায় না ভুগে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রচলিত আইনের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা, যাতে অন্যরা মানুষকে হেনস্তা করার এ অসুস্থ পন্থা থেকে বের হয়ে আসে।

ফারিহা জেসমিন : সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম