শতফুল ফুটতে দাও
মূল্যস্ফীতির কালে জীবনযাত্রা
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় খুবই বেড়ে গেছে। বাজারে যে কোনো পণ্য কিনতে গেলে দেখা যায়, গত ১ বছরে দাম বেড়েছে দেড় থেকে দ্বিগুণ।
মুষ্টিমেয় ধনী ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে আমরা যদি অন্যান্য শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে ভাবি, তাহলে দেখব মূল্যস্ফীতির ফলে সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং স্থির আয়ের মানুষ খুব কষ্টের মধ্যে আছে।
বিগত দিনে অনেকেরই আয় বাড়েনি, কিন্তু ব্যয় বেড়েছে দেড় থেকে দুই গুণ। এ অবস্থায় মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষদের বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত নানা কৌশল ব্যবহার করতে হয়।
মূল্যস্ফীতিজনিত কারণে ব্যয় বৃদ্ধি মোকাবিলার প্রধান কৌশল হলো ব্যয় হ্রাস করা অথবা ছেঁটে ফেলা। কিছু ব্যয় আছে যেগুলো খরচের দিক থেকে বেশি হলেও বেঁচে থাকার জন্য সেগুলো হ্রাস করা সম্ভব হয় না বা কষ্টকর হয়।
নিম্নবর্গের মানুষদের ব্যয়ের থলিতে বড় অংশ হলো খাদ্যসামগ্রী। এই শ্রেণির মানুষদের কোনোরকম বিলাসিতার সুযোগ হয় না। যেসব পণ্যসামগ্রী এরা ক্রয় করে তার মধ্যে খাদ্যসামগ্রী অন্যতম। খাবারের ধরন দেখে বোঝা যায় কার অবস্থা কেমন। ধনী ব্যক্তিদের খাদ্যসামগ্রীর জন্য ব্যয় তাদের সামগ্রিক ব্যয়ের খুবই নগণ্য অংশ। ভোক্তাব্যয় বেশি হলেও ধনী ব্যক্তিরা এর জন্য উদ্বিগ্ন হন না। যারা কায়িক শ্রম দিয়ে আয়-রোজগার করেন, তাদের ব্যয়ের থলিটি খুবই ছোট। এই শ্রেণির মানুষদের প্রথমেই নিশ্চিত করতে হয় প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী। খাদ্যসামগ্রী প্রয়োজনমতো জোটাতে তাদের পরিশ্রমের ওপর নির্ভর করতে হয়। শরীরের জন্য অতি দরকারি শর্করাজাতীয় খাদ্য এবং সামান্য পরিমাণে হলেও আমিষজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে না পারলে মেহনতের কাজ করা সম্ভব হয় না। যদি কেউ অর্ধভুক্ত অবস্থায় কাজ করে, তাহলে তার কর্মদক্ষতা হ্রাস পাবে। এর ফলে তাদের যারা কাজে নিয়োগ দিয়েছে, তারা তাদের কর্মচ্যুত করবে। কর্মচ্যুত হলে বেঁচে থাকা আরও কঠিন হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে এসব মানুষকে ধনীদের দয়া-দক্ষিণা এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সহমর্মিতার ওপর নির্ভর করতে হয়। সমস্যা হলো, সহমর্মিতা তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়ার বিষয় নয়। কোথায় কার কাছ থেকে একটু সহমর্মিতা পাওয়া যাবে, তা নিতান্তই ভাগ্যের ব্যাপার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামষ্টিক অর্থনীতিতে একটি ধারণা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। এ ধারণাটি হলো NRU বা Natural Rate of Unemployment. দেশে যদি কোনো একটি সময়ে ৪-৫ শতাংশ লোক বেকার থাকে, তখন একে বলা হয় বেকারত্বের স্বাভাবিক হার। ধারণা করা হয়, এ লোকগুলো সাময়িকভাবে বেকার আছে। এরা নতুন কাজ পাওয়ার জন্য কাজের অনুসন্ধানে নিয়োজিত। আমাদের মতো দেশে বেকারত্বের স্বাভাবিক হারের ধারণা প্রযোজ্য নয়। এ রকম দেশে ছদ্ম বেকারত্বের ধারণাটি অনেক বেশি বাস্তব। এ ধারণাটি উপস্থাপন করেছিলেন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জোয়ান রবিনসন। ১৯৩০-এর দিকে মহামন্দার সময় তিনি দেখতে পান ব্রিটেনের পাতালরেল স্টেশনে কিছু লোক ম্যাচ বক্স ও সিগারেট বিক্রি করার কাজে নিয়োজিত আছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে এরা বেকার নয়। কারণ তারা কিছু একটা করছে। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যাবে এরা আসলে বেকার। সমগ্র অর্থনীতিতে এদের উৎপাদনমূলক অবদান খুবই সামান্য। সে কারণেই এই শ্রেণির বেকারদের সম্পর্কে ছদ্ম বেকারত্বের ধারণাটি ব্যবহার করা হয়েছে।
গ্রামীণ বাংলাদেশে বেশকিছু জেলায় দেখা গেছে, এক দল গ্রামের কিশোর ও তরুণ কোনো কাজ করে না। এরা আড্ডা মেরে, ঝগড়া-ঝাঁটি করে অথবা ঘোরাফেরা করে দিব্যি আছে। খাওয়াদাওয়ার জন্য এদের ভাবতে হয় না। কারণ পরিবারের প্রবাসী সদস্য দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের খাওয়া-পরার জন্য প্রবাস থেকে নিয়মিত অর্থের জোগান দেন। এমনি করে সহজভাবে বেঁচে থাকা জীবন কার্যত কোনো জীবন নয়। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। এর যে কিছু ক্ষতিকর দিক আছে, তা বিশ্লেষণধর্মী আলোচনায় ঠাঁই পায় না। গ্রামে বাস করা প্রবাসীর পরিবারের শখের বশে বেকার থাকার যে কালচার গড়ে উঠেছে, তা দেশের সার্বিক কল্যাণকে খর্ব করছে। দলাদলি, আড্ডাবাজি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড গ্রামবাংলার পরিবেশকে দূষিত করে তুলছে। সমাজের ওপর ঋণাত্মক এসব প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে সমাজের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠবে। আমাদের জাতীয় জীবনে রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তি সম্পর্কে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ উদ্বেগের পাশাপাশি প্রবাসী আয় অধ্যুষিত গ্রামে অল্প বয়সি একটি গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে, যাদের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারব গ্রামীণ সমাজও রাজনৈতিক সমাজের মতো দ্বিধাবিভক্ত। আমাদের গ্রামগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে আছে যূথবদ্ধতার কারণে। কিন্তু এখন সেই যূথবদ্ধতা তেমনভাবে দেখা যায় না। সমাজ ধসে পড়ছে। এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়ে চিন্তাশীল মানুষকে নতুন সমাজ ভাবনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব হলো, মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের আশপাশে রয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যের দাম দেড় থেকে দুই গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্দিষ্ট আয়ের ভোক্তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অনেক সময় দেখা গেছে, বাজার থেকে কোনো কোনো পণ্য কিছু সময়ের জন্য উধাও হয়ে গেছে। এমনটি ঘটেছে চিনি ও ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে। কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে সরকার দাম বেঁধে দিলেও কাজ হচ্ছে না। বিক্রেতা তার ইচ্ছামতো দাম হাঁকছে। এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে অসহায় ভোক্তারা কী করতে পারে? সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নির্দিষ্ট আয়ের লোকেরা তাদের সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। দেশে এমনিতেই সঞ্চয়ের হার সন্তোষজনক নয়। অর্থনীতি সম্পর্কে যাদের সামান্য জ্ঞান আছে, তারা জানেন সঞ্চয় ব্যতীত বিনিয়োগের জন্য অর্থ পাওয়া সম্ভব হয় না। দেশে ব্যক্তি খাতে সঞ্চয়ের হার কম হওয়ার ফলে এ খাতে বিনিয়োগ কাম্য মাত্রায় হতে পারছে না।
যে কোনো দেশে দুই ধরনের মানুষ থাকে। তারা হলো ঝুঁকি পছন্দকারী এবং ঝুঁকি পরিহারকারী। যে সমাজে ঝুঁকি পছন্দকারী মানুষ দেখতে পাওয়া যায়, সে সমাজে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের বেশ চাহিদা থাকে। এ অর্থ কোথা থেকে আসে? এ অর্থের জোগান দেয় ঝুঁকি পরিহারকারী ব্যক্তিরা তাদের সঞ্চিত তহবিল থেকে। সঞ্চিত তহবিল থাকে ব্যাংকের কাছে। ব্যাংক থেকে এই প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত অর্থ ঋণ নিয়ে ঝুঁকি পছন্দকারীরা বিনিয়োগ করতে পারেন। গত কয়েক বছরে ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের অর্থ সরিয়ে নিয়েছে একশ্রেণির ব্যক্তি, যারা এই ঋণ আদৌ ফেরত দেবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। দেশের ব্যাংকিং সেক্টর থেকে বল্গাহীনভাবে কোনো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত খেলাপিতে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেউ কেউ এ প্রক্রিয়াকে ঋণ নেওয়া বলে মানতে নারাজ। তারা এ প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করতে চান এক ধরনের লুটতরাজ হিসাবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে তার পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় খাতে বিনিয়োগ। বেসরকারি খাতে যে বিনিয়োগ হচ্ছে, তা সন্তোষজনক নয় বলেই অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। কিন্তু শেষ বিচারে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ধারা প্রবল করে তুলতে না পারলে প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ধরনের পুঁজিবাদী উন্নয়নের পথে চলছে, তাকে অনেকেই ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সাম্প্রতিককালে দেশে যেভাবে মূলস্ফীতি হয়েছে, তা বোঝাতে গিয়ে গণমাধ্যমগুলো একে ‘লাফিয়ে লাফিয়ে’ দাম বাড়া বলে উল্লেখ করেছে। ইংরেজিতে একে বলা হয় Galloping inflation. এমন পরিস্থিতিতে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ ব্যয় সংকুলানের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাঁট করছে। দেখা গেছে, ২০২২-এর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রতি মাসে কমেছে ১২ শতাংশেরও অধিক হারে। ফেসবুক ব্যবহারকারী কমেছে ১ কোটি ২৪ লাখ এবং মাসে স্মার্টফোন উৎপাদন কমে ৩ লাখে নেমেছে। এই কমতির ধারার সঙ্গে দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, তা জানতে চেয়েছিলেন প্রথম আলোর প্রতিবেদক। টেলিযোগাযোগ খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সায়িদ খান বলেছেন, ইন্টারনেট ব্যবহার কমে যাওয়া সরাসরি মানুষের আয় পরিস্থিতির সঙ্গে সংযুক্ত। ইন্টারনেট ব্যবহার না করলে মানুষের জীবনযাত্রা অচল হয়ে যাবে, বাংলাদেশ এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ফলে মানুষ ব্যয় কমাতে অন্য আরও উপায়ের সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহার কমানোকে বেছে নিচ্ছে। তিনি বলেছেন, দেখতে হবে মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার কমার বিপরীতে ব্রড ব্যান্ডের ব্যবহার কী দাঁড়াল। ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার নামে পরিচিত। এদের সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এমদাদুল হক বলেছেন, তাদের গ্রাহক এখনো কমেনি। তবে বৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে গেছে। ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার সরঞ্জামের দাম বেড়েছে। ফলে তাদের খরচও বেড়েছে। আরেকটি কারণ হতে পারে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া।
মূল্যস্ফীতি প্রকৃত আয় কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশে এখন সে অবস্থাই চলছে। এ কারণে সাধারণ মানুষ শুধু দু’মুঠো ভাতের জন্য বাধ্য হচ্ছে অন্য অনেক ধরনের সামগ্রীর ওপর ব্যয় কমিয়ে ফেলতে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ