পর্বতসম বাণিজ্য ঘাটতি আর কতদিন?
এম এ খালেক
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জাতীয় সংসদে উত্থাপিত সরকারি দলের এক সদস্যের প্রশ্নের উত্তরদানকালে সংসদকে জানিয়েছেন, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দেশের প্রতিকূলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৯৬০ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন বা ৩ হাজার ৯৬ কোটি মার্কিন ডলার। তিনি আরও জানিয়েছেন, চীন ও ভারতের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৮২৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত বছর বাংলাদেশ চীন থেকে ১৮ হাজার ৫০৯ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ চীনের বাজারে ৬৮৩ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। ভারতের সঙ্গে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৬৯৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ভারত থেকে মোট ১৩ হাজার ৬৮৯ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। এর বিপরীতে দেশটিতে বাংলাদেশ ১ হাজার ৯৯১ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। বাংলাদেশের বিপরীতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশ হচ্ছে-সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, সৌদি আরব, জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পাকিস্তান।
মন্ত্রী জাতীয় সংসদকে আরও জানান-চাল, গম, আলু, পেঁয়াজসহ ১০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে একমাত্র আলু উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। অবশিষ্ট পণ্যগুলো বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে জনগণের চাহিদা পূরণ করা হয়।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির দেওয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থা ও অবস্থান সংক্রান্ত তথ্যাদি নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে-এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সেই অর্জিত উন্নয়ন কতটা টেকসই ও স্থিতিশীল, তা নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় রয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর গত ৫১ বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভারসাম্য একবারের জন্যও বাংলাদেশের অনুকূলে আসেনি। এ জন্য আমাদের নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতাই দায়ী। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ছিল মূলত কয়েকটি দেশ ও অঞ্চলের ‘দয়া’র ওপর নির্ভরশীল। ‘দয়া’ শব্দটি আমি অত্যন্ত সচেতনভাবেই ব্যবহার করছি। স্মর্তব্য, ২০০৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উদ্যোগে উদার ও মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত কোটা সুবিধা হারায়। এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের পণ্য আমদানির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোটা সুবিধা প্রদান করত। কোটা সুবিধাপ্রাপ্ত দেশগুলো থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য আমদানি করত। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্স) সুবিধা দিয়ে আসছে। জিএসপি সুবিধার আওতায় দেশের পণ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশে বিনা শুল্কে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে। অন্য দেশগুলোকে যেখানে ১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিতে হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে, সেখানে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের পণ্য কোনো ধরনের শুল্ক প্রদান ছাড়াই রপ্তানি করতে পারছে। বাংলাদেশ প্রতিবছর যে রপ্তানি আয় করে, তার প্রায় ৯০ শতাংশই আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোটা সুবিধা প্রত্যাহার করার পর কয়েক বছর বাংলাদেশকে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা দিচ্ছিল। কিন্তু নানা কারণে, বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত রেখেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনো বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আরও তিন বছর তারা এ সুবিধা দেবে। ২০২৯ সালের পর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি সুবিধা বন্ধ করে দেবে। সেই অবস্থায় দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই সমস্যায় পড়বে।
বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় নানা চটকদার নীতি-কৌশলের কথা বলে বাহবা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সত্যিকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ কী কী সমস্যা মোকাবিলা করছে, তা কারও অজানা নয়। কিন্তু সমস্যা সমাধানে আমাদের কোনো বাস্তবসম্মত উদ্যোগ এখন পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, আমরা সীমিতসংখ্যক দেশ ও সামান্য কিছু পণ্যের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সফল হতে চাচ্ছি। এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাংলাদেশ অন্তত ২০০টি দেশে পণ্য রপ্তানি করে থাকে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে অর্জিত হয় মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ।
আরও একটি সমস্যা নগ্নভাবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়, যা হলো, বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করে থাকে, সেসব দেশে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। বাণিজ্যমন্ত্রীর দেওয়া পরিসংখ্যান থেকেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। চীন ও ভারত থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করে থাকে। কিন্তু এ দুটি দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। এ ধরনের অসমতাপূর্ণ বাণিজ্য কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আরও একটি জটিল সমস্যা রয়েছে। আমাদের রপ্তানি পণ্য তালিকায় স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর পণ্যের উপস্থিতি খুবই কম। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আসে ৪২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু তৈরি পোশাক শিল্প মূলত আমদানিকৃত কাঁচামালনির্ভর। ফলে এ খাত জাতীয় অর্থনীতিতে আনুপাতিক হারে মূল্য সংযোজন করতে পারছে না। প্রতিবছর তৈরি পোশাক রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়, তার অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই চলে যায় কাঁচামাল আমদানিতে। গত অর্থবছরে প্রথমবারের মতো তৈরি পোশাক ছাড়া আরও চারটি পণ্য শত কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের ল্যান্ডমার্ক অতিক্রম করেছে। নতুন যে চারটি পণ্য রপ্তানি করে শত কোটি ডলার আয় হয়েছে তার সবই স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর। স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর পণ্য রপ্তানি বাড়ানো না গেলে কোনোভাবেই রপ্তানি আয় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নীত করা যাবে না।
বাণিজ্যমন্ত্রী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দেশের প্রতিকূলে সৃষ্ট ঘাটতির যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কিন্তু এটা কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ আমদানি ব্যয়ের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তা প্রকৃত আমদানি ব্যয়ের চিত্র নয়। কারণ আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অধিকাংশ পণ্যের অতিমূল্যায়ন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কয়েক দিন আগে বলেছেন, আমদানিকালে কোনো কোনো পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেখানোর কিছু নমুনা তার দৃষ্টিতে এসেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্যটি বাস্তব মূল্যের চেয়ে ২০ থেকে ২০০ গুণ পর্যন্ত অতিমূল্যায়ন করে দেখানো হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো যদি পণ্য আমদানিকালে সেসবের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করত, তাহলে আমদানি পণ্যের অতিমূল্যায়ন অনেকটাই কমানো যেত।
অর্থবছরের শুরুতে আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করায় বর্তমানে আমদানি বাবদ এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার হার কিছুটা কমেছে। অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে এলসি খোলার হার আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এলসি খোলার হার ছিল ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে এলসি খোলার হার কমেছে ২২ দশমিক ৪১ শতাংশ। আগের অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ভোগ্যপণ্য আমদানি বাবদ এলসি খোলার হার বেড়েছিল ২৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে তা ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। একইভাবে শিল্পে ব্যবহার্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ আগের অর্থবছরে বেড়েছিল ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এ বছর তা ৬৫ দশমিক ৩২ শতাংশ কমেছে। গত অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছিল ৩ হাজার ৩৬৯ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে তা ৩ হাজার ৫১৫ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় যে দশটি পণ্য আমদানি করে, চেষ্টা করলে তার বেশিরভাগই স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বাংলাদেশের প্রতিকূলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও অর্থনীতি বিষয়ক লেখক