শতফুল ফুটতে দাও
শিশুর বিকাশে অভিভাবকদের যত্নশীল হতে হবে
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। একদিকে যেমন অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি অপরাধের বৈচিত্র্যও বাড়ছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
নবীন রাষ্ট্রে অনেক নতুন ধরনের অপরাধের বিস্তার আমরা লক্ষ করেছি। পাকিস্তান আমলে পকেটমাররা মানুষের টাকা অথবা মূল্যবান কোনো সামগ্রী হাতিয়ে নিত। তারা বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে নিরীহ যাত্রীদের অথবা হাটবাজারে সদাই করতে যাওয়া মানুষের ভিড়ের মধ্যে পকেটে থাকা অর্থ নিয়ে নিত।
বাংলাদেশের বয়স এখন ৫০ বছরেরও বেশি। এ সময়টিকে খুব অল্প সময় বলা যায় না। যতই দিন যাচ্ছে, ততই আমরা পরিচিত হচ্ছি নতুন ধরনের অপরাধের সঙ্গে। এর পাশাপাশি ভালো কাজ করার মানুষও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ভালো মানুষেরা জনকল্যাণমূলক কাজ না করত, তাহলে আমরা আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারতাম না। বর্তমানে পকেটমারের পাশাপাশি ছিনতাইকারীদের উৎপাত ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্বাধীনতার পরপর শুনতাম মানিক মিয়া এভিনিউতে খুব ছিনতাই হতো। মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকাটি অন্য এলাকার তুলনায় জনশূন্য ছিল। সে সময় মানিক মিয়া এভিনিউয়ের পাশে তেমন কোনো ঘরবাড়ি ছিল না। এর ফলে সেখানে ছিনতাই করাটা অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত ছিল। তখন স্ট্রিট লাইটের জ্যোতি সামান্যই ছিল বলা যায়। এখন স্ট্রিট লাইটিংয়ের জন্য এলইডি বাল্ব ব্যবহার করা হচ্ছে। এলইডি বাল্বের উজ্জ্বলতা এবং আলো ছড়ানোর শক্তি অতীতে ব্যবহৃত বাতির তুলনায় শতগুণ বেশি। এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এমন পরিস্থিতিতে যারা ছিনতাই করে, তাদের ঝুঁকি অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সাফল্য অর্জন করছে এমনটি বলা যাবে না। এই ছিনতাইকারীরা পথচারীদের পকেট হাতিয়ে নেয় খোলামেলাভাবে। পকেটমারদের মতো নীরব কৌশল ছিনতাইকারীরা অবলম্বন করে না। ছুরি কিংবা খেলনা পিস্তল অথবা সত্যিকারের পিস্তল উঁচু করে দেখিয়ে সাধারণ পথচারীদের মনে ভয় ধরিয়ে তার কাছ থেকে সর্বস্ব হাতিয়ে নেয়। এমন কথাও শোনা যেত, পথচারীদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা না থাকলে তাদের পরনের কাপড়চোপড় ছিনিয়ে নিত ছিনতাইকারীরা। এখন ছিনতাইয়ের ধরনও পালটেছে। ছিনতাইকারীরা হেঁটে চলা পথচারী অথবা সিএনজি ও রিকশায় চলা পথচারীদের চোখে বিষাক্ত মলম মাখিয়ে তার দৃষ্টিশক্তি সাময়িকভাবে অচল করে দিয়ে টাকা-পয়সা ও মূল্যবান সম্পদ কেড়ে নেয়। এদের রয়েছে প্রচণ্ড দুঃসাহস।
মোদ্দাকথা হলো, যতই দিন যাচ্ছে অপরাধপ্রবণতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে, নতুন নতুন ধরনের অপরাধ হচ্ছে এবং এর কৌশলেরও পরিবর্তন হচ্ছে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে গডফাদাররা তাদের অনুগতদের দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ফোনে ভয় দেখিয়ে এভাবে চাঁদা তোলা এখন বহুল আলোচিত একটি বিষয়। এসব অপরাধের পাশাপাশি আমরা এটাও দেখেছি যে, ভুলক্রমে রিকশায় কোনো যাত্রীর ফেলে যাওয়া টাকার ব্যাগটি যখন রিকশাওয়ালার চোখে পড়ে, তখন সেই রিকশাওয়ালা টাকার মালিককে খুঁজে বের করে টাকাগুলো মালিকের হাতে পৌঁছে দিয়েছেন। সমাজে খারাপ কাজ করার মানুষের সংখ্যা যখন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এমতাবস্থায় রিকশাওয়ালার সৎ আচরণ সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় স্থান পাচ্ছে। এসব দৃষ্টান্ত দেখে অনেকে ভালো কাজ করার চেষ্টা করছেন।
মানুষ অপরাধ করে কেন, তা একটি জটিল ও কঠিন জিজ্ঞাসা। সমাজে খারাপ কাজের লোকজন যেমন আছে, তেমনি ভালো কাজের লোকও আছে। তা না হলে সমাজটা ১৬ আনাই ধ্বংস হয়ে যেত। শিশু যখন মায়ের জঠর ছেড়ে বাইরের পৃথিবীর দিকে তাকায়, তখন সে থাকে নিষ্পাপ। এ জন্যই মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ শয়তানও নয়, ফেরেশতাও নয়; সামাজিক পরিবেশ একটি শিশুকে শেষ পর্যন্ত শয়তানে পরিণত করে। এই সমাজেরই আবার অনেকে ফেরেশতাতুল্য হয়ে যান তাদের কাজের মাধ্যমে।
সমাজ সংস্থায় পরিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। পরিবারের মধ্য দিয়েই মানুষ বৃহত্তর সমাজে বিচরণ করে। যে পরিবার ভেঙে যায়, তাকে বলা হয় ব্রোকেন ফ্যামিলি। এই ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানদের জীবন স্বাভাবিক পরিবারের সন্তানদের তুলনায় ভিন্নভাবে গড়ে ওঠে। ব্রোকেন ফ্যামিলির শিশুরা পর্যাপ্ত স্নেহ-ভালোবাসা পায় না। এর ফলে তাদের মন-মানসিকতা ভালো পরিবারের সন্তানদের মতো হয় না। অনেক সময় দেখা যায়, পিতা ও মাতার স্নেহবঞ্চিত হয়ে এদের মনোস্তাত্ত্বিক গঠন ভিন্নতর হয়। দারিদ্র্যের কারণে একটি স্বাভাবিক পরিবারের সন্তানরাও পদস্খলিত হতে পারে। দারিদ্র্র্যের ফলে এসব পরিবারের দৈনন্দিন জীবনে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাবলির কারণে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অস্বাভাবিক হয়ে যায়। দারিদ্র্যের ফলে পরিবারে অশান্তি লেগে থাকে। এ ধরনের অশান্তি কোমলমতি শিশুদের জীবনের স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করে। অনেক সময় পিতা-মাতা সন্তানদের কাছ থেকে এমন কিছু প্রত্যাশা করে, যা শিশুদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি নীতিবাক্য হলো ‘Spare the rod and spoil the child’. ওই সময় ব্রিটেনের অভিজাত পরিবারের সন্তানদের গ্রামার স্কুলে পড়াশোনা করার জন্য পাঠানো হতো। এসব গ্রামার স্কুলে নিয়মশৃঙ্খলা ছিল খুবই কঠোর। এসব স্কুলের শিক্ষকরা মনে করতেন, শিক্ষার্থীদের ভালো মানুষে রূপান্তরিত করার জন্য উদ্ধৃত প্রবাদটির কোনো বিকল্প নেই।
ব্যক্তিগত জীবনে আমার লেখাপড়া শুরু হয়েছিল হাই ইংলিশ স্কুলের প্রাথমিক সেকশনে। তখন দেখেছি, প্রাথমিক সেকশনের প্রধান মজিদ পণ্ডিত সাহেব একটি বেত হাতে ঘোরাফেরা করতেন। অন্যদিকে হাইস্কুলের হেডমাস্টার মান্নান স্যার বেত হাতে আমাদের ক্লাসের বারান্দা দিয়ে ধীর পদক্ষেপে শ্রেণিকক্ষে কী হচ্ছে তার ওপর নজরদারি করতেন। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখানো অথবা মারধর করা কঠোরভাবে বারণ করা হয়েছে। বেত মেরে শিশুদের পড়া শেখানোর জন্য চাপ দিলে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। শিশুদের মনে কিছু নেতিবাচক ধ্যানধারণা এর ফলে বদ্ধমূল হয়ে যায়। স্কুলজীবনে আমি ও আমার সহপাঠীরা কঠোর শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করেছি। তবে হয়তো এ নিয়মশৃঙ্খলা ইংলিশ গ্রামার স্কুলের মতো কঠোর ছিল না। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। মজিদ পণ্ডিত স্যার আমাদের ক্লাসে ঢুকে বেত উঁচিয়ে অনেকটা ধমকের সুরে বললেন, লেখ, ‘ভুল লিখিতে ভুল লিখিও না।’ ভুল শব্দটির সঠিক বানান হলো ভয়ের নিচে হ্রস্বউকার। স্যার একে একে আমাদের লেখার খাতা দেখাতে বললেন। দেখা গেল দু-একজন বাদে সবাই ভুলের বানান লিখেছে দীর্ঘউকার দিয়ে। আমরা যারা ভুল করেছিলাম, তাদের হাতের তালুতে একটা করে বেত মারা হয়েছিল। মনে হয় পরবর্তী সময়ে আমরা কেউ ভুল লিখতে ভুল করিনি। এই অবস্থাটিকে কী বলা যায়? মজিদ স্যারের বেত মারার সঙ্গে তার স্নেহ যুক্ত ছিল। এ কারণে আমরা কেউ বিপথগামী হইনি। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে তার একটি বাক্য তুলে ধরা যায়। বাক্যটি হলো ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে গো।’ শাসন যদি এমন হয়, তাহলে শিশুরা হয়তো বিপথগামী হবে না।
সম্প্রতি মিরপুরের একটি থানায় অদ্ভুত ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছে। সময়টা ছিল শনিবার, ১৪ জানুয়ারি, রাত ১১টা। এ সময় ১০ বছরের একটি শিশু, যার নাম সাহস (আসল নাম নয়), ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় ঢুকল। সে পড়ে মনিপুর স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে উসকুখুসকু চুলে থানায় হুড়মড়িয়ে ঢুকল ১২ বছরের আরেক শিশু রাজ্জাক (ছদ্মনাম)। মিরপুরের জনতা হাউজিং এলাকার এই শিশুটি হোটেল কর্মচারী। তাদের দুজনের অভিযোগ অভিন্ন। বাসায় মারধর করার জন্য তারা এসেছে তাদের নিজ নিজ বাবার নামে নালিশ জানাতে। থানায় একাকী পরপর দুই শিশুকে মধ্যরাতে দেখে পুলিশ সদস্যরাও ভড়কে যান। এমন ঘটনা আর কোনোদিন বাংলাদেশে কোথাও ঘটেছে বলে মনে হয় না। নিঃসন্দেহে এ ঘটনাটি ব্যতিক্রমী, আবার কাকতালীয় বলেছেন খোদ পুলিশ কর্মকর্তারা। ডিউটি অফিসারের সামনের চেয়ারে বসে সাহস বলতে থাকে, ‘বাবা আমাকে মেরেছে, তার বিচার চাইতে আপনাদের কাছে এসেছি।’ ওই পুলিশ কর্মকর্তা তাকে বারবার অভয় দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
রাজ্জাকের অভিযোগ আরও গুরুতর। সে জানায়, মিরপুর-২ নম্বরে পরিবারের সঙ্গে সে থাকে। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। তার বাবা রিকশাচালক। অভাব-অনটনের সংসারে লেখাপড়া করা হয়নি। হোটেল কর্মচারী হিসাবে সে আয়-রোজগারে নেমেছে। ১৪ জানুয়ারি শনিবার বাবার কাছে বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরে রাজ্জাক। তার বাবা বলেছিলেন, সামনে ঈদে গ্রামে নিয়ে যাবেন। তবে সেটা মানতে নারাজ ছিল রাজ্জাক। অবাধ্য হওয়ায় তাকে মারধর করা হয়। রাজ্জাক সমকালের প্রতিবেদককে বলে, মারধর করার সময় বাবা বারবার বলছিলেন, তোর মতো ছেলের দরকার নেই। বাবার মুখে এমন কথা শুনে ঘর থেকে বের হয়ে যায় রাজ্জাক। তার কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে বাবাকে খবর দেয় পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তারা রাজ্জাকের বাবার কাছ থেকে জানতে চান কেন সন্তানকে শাসন করেছিলেন। এ প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, ‘জিজ্ঞেস করেন ওকে, কতবার বুঝিয়েছি সবাই মিলে একসঙ্গে বাড়ি যাব। কারও কথা শুনতে চাইল না।’ বাবার বক্তব্যের পর ছেলে বলল, ‘কেন তুমি গরুর মতো মারলা। ৫০০ টাকা ছিল সেটা নিয়ে গেলা।’ সব শোনার পর ডিউটি অফিসার বললেন, এখন ওয়াদা করেন সন্তানকে আর মারবেন না। অন্যায় করলে বোঝানোর চেষ্টা করবেন।
সাহস জানায়, খেলাধুলা করে শনিবার বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়েছিল। দেরিতে বাসায় ফেরায় তাকে মারধর করে বাবা। সাহসের বাবার মিরপুর এলাকায় একটি চায়ের দোকান রয়েছে। মার খেয়ে সাহস চলে গিয়েছিল তার খালার বাসায়। সেখানেও তাকে আরেক দফা মারধর করেছে তার খালাত ভাই। পুলিশ কর্মকর্তা জানতে চাইলেন, বাবা তুমি এখন কী চাও? উত্তরে শিশুটি বলল, মারধর কেন করা হলো, এর শাস্তি চাই। আমাকে যেন আর মারা না হয়। অবশেষে পুলিশ কর্মকর্তা দুজনকে তাদের পরিবারের কাছে তুলে দেন।
এমন ঘটনা বাংলাদেশে কখনো ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। ছেলে দুটির আচরণ থেকে বোঝা যায় তারা দুজনেই বেশ বুদ্ধিমান। তাদের আরও জিজ্ঞাসা করলে জানা যেত তারা শিশু নির্যাতন আইনের ব্যাপারটি হয়তো জানে। নিঃসন্দেহে এদের দুজনের মানসিক বয়স শারীরিক বয়সের তুলনায় অনেক বেশি। মনস্তত্ত্বের ভাষায় তারা ইন্টেলিজেন্ট। দারিদ্র্যের ফলে পরিবারের মধ্যে তারা ভালো পরিবেশ পায় না। তাদের যদি কড়া শাসনে অনির্দিষ্টকাল রাখা হয়, তাহলে তারা পদস্খলনের বিপদে পড়ে যাবে। তাদের স্নেহ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে মানুষ রূপে গড়ে তুলতে হবে। ওরা অতি অল্প বয়সেই বুঝতে পারে তাদের সমাজটা কেমন! সঠিক প্রক্রিয়ায় সঠিকভাবে তাদেরকে অভিভাবকরা গড়ে তুলবেন, এটাই কাম্য। নেট সার্চ করে দেখা গেছে, ভারতের মধ্যপ্রদেশে ঠিক এরকমই একটি ঘটনা ঘটেছে। দেখা যাচ্ছে, শিশুদের এমন আচরণ বিশ্বের অন্যত্র ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
ড. মাহ্বুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ