Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বয়োবৃদ্ধদের বিপথগামী হওয়া ও আমাদের দায়বদ্ধতা

Icon

সম্পাদকীয়

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বয়োবৃদ্ধদের বিপথগামী হওয়া ও আমাদের দায়বদ্ধতা

কয়েকদিন আগে পত্রিকার পাতায় কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ লোকের ছবি প্রকাশিত হয়েছে, যাদের সবাইকে চোর বলে উল্লেখ করা হয়। বস্তুত এ দেশের বৃদ্ধরা জীবনের শেষ সময়গুলোতে ধর্মকর্ম করেন, সংসার চালান, পরিবারের দেখাশোনা করেন এবং সবার সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে চলেন। বয়োবৃদ্ধরা সমাজের বা পরিবারের বোঝা নন; তারা আপনার-আমার ও পবিরাবের জন্য আশীর্বাদ। যদিও অতি বয়োবৃদ্ধদের আজকাল কিছু কিছু বৃদ্ধাশ্রমেও রাখা হয়। এই বৃদ্ধাশ্রমে অল্প কিছু বয়োবৃদ্ধ থাকলেও বৃদ্ধ মা-বাবাদের সঙ্গে রাখাই শ্রেয়। এ ব্যাপারে প্রতিটি ধর্মেই বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ফিরে আসা যাক বৃদ্ধদের চোর হওয়ার খবরে। বৃদ্ধ কয়েকজন মানুষ মিলে চুরি করেছে। অর্থাৎ কিছু সংখ্যক বৃদ্ধ চোর হয়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, আমাদের সমাজের অবক্ষয় এতটাই হয়েছে যে, যারা আমাদের উপদেশ দেবেন, ধর্মপরায়ণ হতে বলবেন, নীতিবাক্য শুনাবেন, সমাজের উন্নয়নের জন্য বুদ্ধি-পরামর্শ দেবেন, তারাই যদি চুরি করেন, তবে বিষয়টি কেমন মনে হয় না? এ বয়স্ক চোরদের চুরি করাটাই কেমন যেন সমাজের একটা অভূতপূর্ব অবক্ষয়ের ইঙ্গিত করছে। ছবিতে যে কয়জন বৃদ্ধ দেখলাম, তাদের কয়েকজনের মুখে আবার পাকা দাড়ি। প্রশ্ন হলো, এই বয়স্ক লোকেরা কেন চুরি করলেন? এমন বয়সে তারা আর যাই করুন না কেন, চুরি করাটা কিছুতেই তাদের মানায় না। তবে কী কারণে তারা এমন ঘৃণ্য কাজে জড়িয়ে পড়লেন? জীবিকার অভাব, ছেলেমেয়েরা তাদের ভরণপোষণ করেন না-সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে সাহায্য-সহযোগিতা না পাওয়া ইত্যাদি কারণেই হোক না কেন-বয়স্ক ব্যক্তিদের চোর হওয়ার বিষয়টি মেনে নেওয়া সত্যিই কষ্টকর।

আমি বর্তমানে যে স্থানে কাজ করছি, এখানে নানা কারণে বয়স্ক ও অতি বয়োবৃদ্ধ লোকদের প্রায়ই আসতে হয়। যেসব বৃদ্ধলোক বহু দেশ ঘুরেছেন, তারা প্রায়ই আমাকে প্রশ্ন করেন-এখানে কি সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই? দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না-এমন কথা অনেক বৃদ্ধলোক আক্ষেপ করে বলেন। আমি তাদের সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না। নিজের অপারগতা প্রকাশ করা ছাড়া আমার আর কী বা করার আছে!

ফিরে আসা যাক-কী এমন ঘটল যে, বয়োবৃদ্ধরা চুরি করেছেন; তাও আবার দলবদ্ধ হয়ে। এখানটায় সমাজের বেশ দায় আছে বলে আমি মনে করি। বৃদ্ধদের সম্মান এখন আর পরিবার বা সমাজে সেরকমভাবে হয় না। বয়োবৃদ্ধদের বাড়িতে রাখাটাকে অনেক ছেলেমেয়ে বোঝা মনে করেন। বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় অনেক মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দেখা যায়। অথচ বাবা-মা নিঃশেষ হলেও নিজ নিজ সন্তানকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে রাখেন শত অভাব অনটনের মধ্যেও। কজন বাবা অথবা মা জীবিত থাকা অবস্থায় নিজ সন্তানকে এতিমখানায় পাঠিয়েছেন-ভেবে দেখার বিষয়। বয়োবৃদ্ধদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ উঠে যেতে শুরু করে, যখন থেকে এদেশের একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভাঙতে শুরু করে। তারপর বয়োবৃদ্ধদের প্রতি শ্রদ্ধার সেই নিম্নগামিতা আর ফেরানো গেল না। ছেলেমেয়েদের বিদেশ পাঠানোও অনেক ক্ষেত্রে এ প্রবণতার জন্য দায়ী। বদ্ধ ঘরে বৃদ্ধ বাবা-মা’র লাশ পড়ে থাকে; অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের খবর দিয়েও দেশে আনা যায় না। বৃদ্ধ বাবা-মাকে বছরের পর বছর দেখতে না আসাটাও বয়োবৃদ্ধদের প্রতি অসম্মানের বৈকি! এক বয়োবৃদ্ধ আত্মীয়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম-আন্টি, আপনি প্রতি বছর আমেরিকায় যান মেয়ের কাছে। নিশ্চয়ই খুব মজা করেন ওখানে। তিনি বলেছিলেন-না বাবা, তা নয়; ওরা তো দুজনেই কাজ করে, তাই বাসায় নাতি-নাতনিদের দেখার জন্য আমাকে নিয়ে যায়। ওখানে বাসার বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয় না।

বয়োবৃদ্ধদের এ অসম্মান দিন দিন আরও প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকেও নীতি-নৈতিকতা শিক্ষার কোনো উল্লেখযোগ্য লেখা ছাপা হয় না। শিক্ষকরাও আজকাল ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যর কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেন বলে মনে হয় না। বৃদ্ধ বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা কি স্কুলের সভাপতি বা সম্মানিত পদগুলো অলংকৃত করেন? মনে হয় না। আমরা বয়োবৃদ্ধদের শ্রদ্ধা না করতে করতে সমাজে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি, তা একেবারেই বেমানান। খাবার, বাসস্থান ও সমাজে শ্রদ্ধাবোধের যে কমতি বা ঘাটতি সৃষ্টি করেছি-এসব মিলে বৃদ্ধদের চোরের ভূমিকায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কেউ ইচ্ছা করে বৃদ্ধ বয়সে চুরি করে না, চোর হতে চায় না। তবে সমাজের অর্থ লুটেরা কিছু বয়স্ক পণ্ডিত আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে এখন এসব জ্ঞানপাপীদের দিকে আঙ্গুল তোলার সাহস কজন রাখেন, এটাই প্রশ্ন। এ কথা সত্য-বয়োবৃদ্ধদের প্রকৃত মূল্যায়ন যদি আমরা করতে ব্যর্থ হই, তবে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ এবং তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতেই থাকবে। তাই পাড়া-মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে ও সমাজে বয়োবৃদ্ধদের শ্রদ্ধেয় করে তুলতেই হবে। তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে সমাজকে সুন্দর করে গড়তে হবে। এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা হবে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আর বাস্তবে রূপ দেবে সরকার; সব ধরনের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে। আগামী সময় হোক বয়োবৃদ্ধদের মূল্যায়ন ও ভালোবাসার। প্রত্যেক সিনিয়র সিটিজেন হাসুন শ্রদ্ধার হাসি-আমার, আপনার সবার দিকে তাকিয়ে।

এদেশে বহু পরিবার রয়েছে, যেখানে বয়োবৃদ্ধদের যথাযথ মূল্যায়ন হয়। ছেলেমেয়েরা বাবা-মার প্রকৃত মূল্যায়ন করে, সম্মান করে। ‘ডিসিশন মেকিং প্রসেসে’ তারা বাবা-মা’র মতামতকে প্রাধান্য দেয়। কোনো কোনো পরিবার তাদের বয়স্ক লোকদের ‘বৃদ্ধ’ বলতেও নারাজ। তারা মনে করেন, এতে তাদের অসম্মান করা হয়। পরিবারের খাবার খাওয়ার সময় তারা বয়োবৃদ্ধদের বিশেষ খেয়াল রাখেন। বয়োবৃদ্ধরা চলাফেরা করতে না পারলে পরিবারের অন্যরা নানাভাবে তাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করেন। পরিবারের এ বন্ধন দেখে খুব ভালো লাগে। বয়োবৃদ্ধদের আমরা যদি সাহায্য-সহযোগিতা না করতে পারি, তবে যেসব কাজে তারা অসম্মান বোধ করেন, তা যেন না করি। বয়োবৃদ্ধরা পরিবারের তথা সমাজের প্রাণ, যারা নিজ নিজ গুণে মহিমান্বিত এবং তাদের জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রতিটি পরিবারকে অমঙ্গল থেকে রক্ষা করে যাচ্ছেন, করতে চান। তাই আমাদের উচিত-আমরা যেন বয়োবৃদ্ধদের কিছুতেই এমন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে না দেই, যাতে তারা চোর বনে যান।

আমরা কি বয়োবৃদ্ধদের একাকিত্ব বুঝি, বোঝার চেষ্টা করি? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না; কিন্তু একথা সত্য-বয়োবৃদ্ধরা তাদের ন্যায্য অধিকার পাচ্ছেন না। কী বাসায় বা রাস্তায় আমরা কি বৃদ্ধদের জ্ঞানের প্রদীপের আলোর শিক্ষায় উদ্ভাসিত হতে পেরেছি? না পারিনি। যদি পারতাম, তাহলে আমরা কজন বয়োবৃদ্ধদের রাস্তা পারাপারে সাহায্য করেছি, কজন চালক তার গাড়ির ব্রেকে পা রেখে বয়োবৃদ্ধদের রাস্তা পার হতে সাহায্য করেছে-এ প্রশ্ন আজ উঠত না। আজ আমরা যারা যুবক, আগামীকাল আমরা বয়োবৃদ্ধ হব, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আগামীকাল বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় আমরা যেন সমাজ থেকে বিছিন্ন হয়ে না পড়ি, সে জন্য আজই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। সেনাবাহিনীতে ইতোমধ্যে ৬০ বছর বা তার ঊর্ধ্বে সেনা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য সিএমএইচ-এ পৃথক কাউন্টারে ওষুধ সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে সিনিয়র সিটিজেনদের আর দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ওষুধ সংগ্রহ করতে হয় না। এদেশের সব হাসপাতালে এ রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। আর RAOWA অবসরে যাওয়া অফিসার ও তার পরিবারের জন্য সময় সময় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বয়োবৃদ্ধরা কিছুটা হলেও আনন্দ উপভোগ করছেন। ব্যাপক পরিসরে এরকম কিছু অনুষ্ঠান করা যায় কিনা, তা সংশ্লিষ্ট সবার ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করছি। বয়স্ক ভাতার প্রচলন রাষ্ট্রের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান বলে আমি মনে করি। ভবিষতে অফিসে, আদালতে, ব্যাংকে, সমাজের বিভিন্ন স্থানে বয়োবৃদ্ধদের দেওয়া হোক অগ্রাধিকার-শান্তিতে কাটুক তাদের শেষ সময়গুলো।

লে. কর্নেল মো. সাইফুল ইসলাম (অব.) : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

mdsaifulislam99@yahoo.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম