বৈশ্বিক বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত
এমএ খালেক
প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ এখনই প্রত্যাহার করার কোনো পরিকল্পনা নেই। অন্তত আগামী ৬ মাস ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ বহাল থাকবে। তারপর বিষয়টি পর্যালোচনা করা হতে পারে। উল্লেখ্য, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অথবা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এভাবে ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার নির্ধারণ করে দিতে পারে না। বাজার চাহিদা এবং জোগানের ওপর নির্ভর করেই ব্যাংক ঋণ এবং আমানতের সুদ হার নির্ধারিত হওয়ার কথা। যখন আমানত ও ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তখন আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে অনুসন্ধান করে দেখেছিলাম, তাদের ‘কস্ট অব ফান্ড’ হচ্ছে সোয়া ৮ শতাংশ। যে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড সোয়া ৮ শতাংশ, তারা কীভাবে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে? এভাবে ব্যাংক ঋণের সুদ হার এবং আমানতের ওপর প্রদেয় সুদ হার উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার ফলাফল কখনোই ভালো হতে পারে না। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্যও এই উদ্যোগ ভালো ফল বয়ে আনেনি। এ খাতে বর্তমানে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে, তার পেছনে ঋণের সুদের হার ও আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়ার বিষয়টি কিছুটা হলেও ভূমিকা রেখেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, জোর করে ছাগলকে পানিতে নামানো যায়, কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে পানি পান করানো যায় না। ব্যাংক ঋণ এবং আমানতের ওপর প্রদেয় সুদহার বলপূর্বক নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাতে কখনোই ভালো ফল আশা করা যায় না। অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা প্রথম থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ব্যাংক ঋণের ওপর আপার ক্যাপ আরোপের বিরোধিতা করে আসছেন। এ বিরোধিতা আরও জোরালো হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে।
গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ার ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করে। পালটা ব্যবস্থা হিসাবে রাশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে জ্বালানি তেল ও গ্যাস সরবরাহ সাংঘাতিকভাবে কমিয়ে দেয়। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন থেকে খাদ্যপণ্য বাইরে রপ্তানি প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। লাখ লাখ টন খাদ্যপণ্য বোঝাই জাহাজ বন্দরে অপেক্ষা করতে থাকে। রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলিতভাবে বিশ্বের মোট দানাদার খাদ্যের ৩০ শতাংশ জোগান দিয়ে থাকে। রাশিয়া বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের এক-দশমাংশের জোগান দেয়। রাশিয়া জ্বালানি তেল ও গ্যাস রপ্তানি কমিয়ে দিলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিপাকে পড়ে। ইউক্রেনে গত মৌসুমে ৮ কোটি ৬০ লাখ টন খাদ্যপণ্য উৎপাদিত হয়েছে। এ খাদ্যপণ্যের বেশিরভাগই তারা বিদেশে রপ্তানি করতে পারেনি। এমনকি যুদ্ধের কারণে ৩০ শতাংশ ফসল মাঠ থেকে উত্তোলন করতে পারেনি। বিশেষ করে রাশিয়া গ্যাস ও জ্বালানি তেলের উত্তোলন ও জোগান কমিয়ে দেওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী পরিবহণ সংকট সৃষ্টি হয়। প্রতিটি দেশেই জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধের আগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য ছিল ৮০ মার্কিন ডলারের নিচে। সেই তেলের মূল্য ১৩৯ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রতিটি দেশেই মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, তার পেছনে পণ্যের উৎপাদন হ্রাসজনিত কারণ নয় বরং পরিবহণ সংকটই মূলত দায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে, তা বিগত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা সামাল দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা গত এক বছরের মধ্যে নীতি সুদহার ৬ বার বৃদ্ধি করেছে। নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে বাজারে মানি সাপ্লাই কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাজারে মানি সাপ্লাই কমে গেলে ভোক্তারা চাইলেই বেশি মূল্য দিয়ে পণ্য ক্রয় করতে পারবে না। এতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও কমে আসবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। উল্লেখ্য, মূল্যস্ফীতি বিত্তবান-বিত্তহীনের জন্য একই রকম সমস্যা সৃষ্টি করে না। বিত্তবান ব্যক্তিরা চাইলেই তাদের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বর্ধিত মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারেন। কিন্তু দরিদ্র মানুষ চাইলেই তার আয়-রোজগার বাড়াতে পারেন না। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় থাকলে তাদের প্রকৃত আয় কমে যায়। তাই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় থাকলে প্রতিটি দেশই তাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। গত এক বছরেরও কম সময়ে বিশ্বের অন্তত ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একাধিকবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। নীতি সুদহার বাড়ানোর একটি নেতিবাচক দিকও আছে। এতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে গেলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মন্থর হয়ে পড়ে। ফলে চূড়ান্ত পর্যায়ে একটি দেশ অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ধাবিত হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা হয়েছে ঠিক সে রকম।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক অন্তত দুদফায় নীতি সুদহার দশমিক ৭৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার ছিল ৫ শতাংশ। এখন তা ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নীতি সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগ কোনো সুফল বয়ে আনতে পারছে না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়ালেও ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ এখনো ৯ শতাংশে সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাজারে নীতি সুদহার বাড়ানোর কোনো প্রভাব পড়ছে না। কারণ নীতি সুদহার বাড়ানো হলেও ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ বজায় থাকায় সিডিউল ব্যাংকগুলো আগের মতোই সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদারোপ করতে পারছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সিডিউল ব্যাংকগুলোকে আগের চেয়ে দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি সুদ দিতে হচ্ছে। কিন্তু গৃহীত ঋণের অর্থ তাদের আগের মতো সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। এতে সিডিউল ব্যাংকগুলোর মুনাফার হার আগের তুলনায় দশমিক ৭৫ শতাংশ কমে যাচ্ছে। উদ্যোক্তা ও সাধারণ ঋণগ্রহীতারা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কালেও তুলনামূলক কম সুদে ঋণ গ্রহণ করতে পারছেন। এতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবাহ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২০২৩) প্রথম ষান্মাসিকের জন্য যে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়, তাতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। আগের মুদ্রানীতিতে এটা ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু সেই সময় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ১১ শতাংশ। সেই বিবেচনায় অনেকেই মনে করেছিলেন, ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের যে প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই অর্জিত হবে না। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এক মাসে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। বর্তমানে তা ১৪ শতাংশের কিছু নিচে নেমে এসেছে। যেহেতু উচ্চ মূল্যস্ফীতির কালেও তুলনামূলক কম সুদে ব্যাংক ঋণ পাওয়া যাচ্ছে, তাই একশ্রেণির উদ্যোক্তা ও সাধারণ ঋণগ্রহীতা আগের চেয়ে বেশি ঋণ গ্রহণ করছেন। কিন্তু গৃহীত এ ঋণের অর্থ শিল্পে ব্যবহার না হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। এর প্রমাণ হচ্ছে, অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। তাহলে ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের অর্থ কোথায় যাচ্ছে? অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে একশ্রেণির মানুষ তা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। আমাদের দেশের একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর দেশ থেকে অর্থ পাচার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। আগামী বছর জানুয়ারি মাসে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তা হবে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন ও জটিল নির্বাচন। তাই এর আগে দেশ থেকে অর্থ পাচার বৃদ্ধি পাবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। অর্থ পাচারের একটি বড় ক্ষেত্রে হচ্ছে ব্যাংক খাত। এ পর্যন্ত ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে যারা খেলাপি হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই ঋণকৃত অর্থ বিদেশে পাচার করে দিয়েছে।
এই মুহূর্তে অর্থ পাচার রোধ এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রোধ করতে হলে ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ জরুরিভিত্তিতে তুলে দিতে হবে। অধিকাংশ অর্থনীতিবিদই মনে করেন, ব্যাংক ঋণ এবং আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা তুলে দিয়ে ইস্যুটিকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। মহলবিশেষকে খুশি করতে গিয়ে জাতির ক্ষতি করা কোনোভাবেই উচিত হবে না।
এমএ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড; অর্থনীতিবিষয়ক লেখক