Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কিছুমিছু

পথে পথে পাথর ছড়ানো

Icon

মোকাম্মেল হোসেন

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পথে পথে পাথর ছড়ানো

ছোট নাতির অসুখের সংবাদ শুনে ঢাকায় যাওয়া সাব্যস্ত করলেন ছবদর খান। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা যাওয়া এখন আঙুলের তুড়ি বাজানোর মতোই সহজ। ‘ফোর লেন’ সড়কে প্রচুর বাস চলাচল করে।

মাসকান্দা বাস টার্মিনালে গিয়ে টিকিট কেটে বাসে উঠলেই হলো। দুই-আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার মামলা খতম। তবে এ ব্যাপারে আপত্তি পেশ করল ছবদর খানের ভাগ্নে মিলন খান। বলল-

: বাসে যাওয়ার নাম ভুলেও মুখে লইন না যে মামা!

: কেন! সমস্যা কী?

: সমস্যা গুরুতর। পরশু দিন ঢাকা যাওনের কালে আমারে বাপের নাম ভুলাইয়া দিছিল।

: বাসে ডাকাতি হইছিল

: না।

: বাস অ্যক্সিডেন্ট খাইছিল?

: না।

: তাইলে?

: মমিসিং থেইকা জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত মারেব্বাস গতিতে বাস চললেও এর পরপরই সেইখানে দুই লাইন কবিতা রচিত হইছিল।

: বুঝলাম না!

: বুঝাইতে গেলে তো আরেকটা ‘মহাভারত’ রচনা করন লাগবে। অল্প কথায় বলতেছি; মন দিয়া শুনেন-এই রুটে সড়ক পরিবহণ মন্ত্রণালয় একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতেছে। এইটার নাম হইল বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প। সংক্ষেপে বিআরটিএ প্রকল্প। প্রকল্পের পটভূমি রচনা করার সময় বলা হইছিল-হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেইকা গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পথে বিআরটি প্রকল্পের আওতায় কুনুখানে উড়ালপথে আবার কুনুখানে বিদ্যমান সড়কে চলাচল করবে বিশেষ বাস। এই বিশেষ বাসের স্বপ্ন অহন বিশেষ বাঁশ হইয়া জনগণের দফারফা কইরা দিতেছে। অবস্থা পর্যবেক্ষণ কইরা স্বয়ং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলতে বাধ্য হইছেন, বিআরটি প্রকল্প এখন গলার কাঁটা। আমি যেদিন ঢাকা যাইতেছিলাম, সেদিন জয়দেবপুরের পরে সরু সড়কে মাল বোঝাই একটা ট্রাক কেক্কর-মেক্কর কইরা কুনুরকমে যাওনের কালে চিৎ হইয়া পড়ল। কয়েক ঘণ্টা বাসে বইসা ঝিমানির পরে জয়দেবপুর ইস্টিশনে যাইয়া ঢাকামুখী ট্রেন ধরতে হইছিল।

: এই সড়ক না মেলা দিন ধইরা বানাইতেছে?

: মাত্র দশ বছর।

: একটা সড়ক বানাইতে এত টাইম লাগে?

: টাইম লাগবে না কি জন্য মামা! রাজনৈতিক দলের পরিচয় বেইচা এইসব কাম যারা হাতাইয়া নেয়, তারা হইল ডুপ্লিকেট ঠিকাদার। এ কারণে তাদের মধ্যে কুনু পেশাদারিত্ব থাকে না। রাতারাতি ‘কন্ট্রাক্টর’ বইন্যা যাওয়া এইসব ঠিকাদাররা কেবল ফুসুর-ফুসুর বিল তোলার ধান্ধা করে আর কাম লইয়া ভুং-ভাং করে।

: এইসব দেখার জন্য কর্তৃপক্ষ নাই?

: আছে।

: তারা কুনু অ্যাকশন নেয় না?

: আরে মামু! কারে বলমু বাদাম চোর; সুযোগ পাইলে সবার আগে আমি নিজেই তো এক মুঠ পকেটে ঢুকাইবাম।

: মানে?

: মানে হইল-এইসব ভুং ভাং পার্টিরে টাইট দেওনের ক্ষমতা আল্লাহপাক যাদের হাতে ন্যস্ত করছেন, কন্ট্রাক সাইন হওয়ার আগেই তারা পার্সেন্টেজ খাইয়া বইসা থাকে। অতএব, আপনে প্রতিকারটা কার কাছে আশা করবাইন?

: তাইলে বাসে যাইতে নিষেধ দিতেছ?

: হ। বাস এভয়েড কইরা ট্রেনে যাওয়াই উত্তম।

: রেলে তো আরেক ফ্যাকরা। রেল ইস্টিশন হইয়া গেছে সিনেমা হল। কালোবাজারিসাব গো সেলাম না দিলে টিকিট পাওয়া যায় না।

: গরম ভাতে ঘি ঢালার প্রয়োজন কী আপনের! আপনে আগেভাগে যাইয়া অগ্রিম টিকিট কাটবেন।

মিলন খানের পরামর্শমতো রেলস্টেশনে গেলেন ছবদর খান। গিয়ে দেখেন আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কাউন্টার বন্ধ। বিপরীত দিকের লোকাল ট্রেনের টিকিট কাউন্টারে খোঁজ নিতে গেলে প্রথমে কেউ উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। ছবদর খান রেগে গেলেন। বললেন-

: আশ্চর্য কাণ্ড-কারখানা! দেশ থেইকা কি ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ সব উইঠা গেল? আমি একজন বৃদ্ধ মানুষ। একটা কথার উত্তর জানার জন্য গলা শুকাইয়া ফেলতেছি; অথচ আপনারা কেউ কুনু কথা বলতেছেন না?

খানের বচন শুনে বিরস মুখে একজন বলল-

: আপনে অনুসন্ধানে যাইয়া খোঁজ করেন।

ছবদর খান লোকটার চোখে চোখ রেখে বললেন-

: অনুসন্ধানে যামু কেন? আপনে বললে অসুবিধা কী? মাননীয় অর্থমন্ত্রী তো মানুষের মুখের কথার ওপর ভ্যাট আরোপ করেন নাই। কাজেই সমস্যা কী?

ছবদর খানের কথায় লোকটা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকাল। তবে পাশের একজন চোখে-মুখে আপদ বিদায় করার ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলে বলল-

: ইন্টারসিটি ট্রেনের কাউন্টার সন্ধ্যার সময় খোলে। আপনে সন্ধ্যায় আসেন।

সন্ধ্যার সময় কাউন্টারে গিয়ে একজনকে কম্পিউটার সামনে নিয়ে বসে থাকতে দেখলেন ছবদর খান। খুচরা একশ বিশ টাকা লোকটার সামনে রেখে বললেন-

: আমারে শনিবারের একটা টিকিট দেন।

: কই যাবেন?

: ঢাকা।

: সিট হবে না। সিট ছাড়া নিবেন?

: সিট ছাড়া বুড়া মানুষ দাঁড়াইয়া যামু কেমনে? কম্পুটারে একটু ঘটর-মটর কইরা দেখেন না-একটা সিট পাওয়া যায় কিনা?

: আরও একশ টেকা দেন।

: ক্যান?

: এই যে আপনেরে সিটডাউন করার বন্দোবস্ত কইরা দিতেছি।

: বসার জায়গা আপনের নিজের পকেটের টেকা দিয়া চেয়ার কিইনা কইরা দিতেছেন নাকি?

: আপনে কথা বেশি বলেন চাচা। যে টিকিটটা আপনেরে দিতেছি, সেইটা অন্য একজনের কাছে বিক্রি করা। আপনের রিকোয়েস্ট ফেলতে না পাইরা আমি আমার নিজের কান্ধে রিস্কের বোঝা লইয়া টিকিটটা আপনেরে দিতেছি। আপনে আমারে চা-পান খাওয়ার জন্য টেকা দিবেন না?

: চা-পান খাওয়ার বাবদ সবার কাছ থেইকাই একশ টেকা আদায় করেন নাকি?

: আদায় করতে হয় না। অধিকাংশ মানুষ খুশি মনেই দিয়া যায়।

: আপনের চা-পান খাইতে এত টেকা লাগে? সর্বনাশ! প্রতিদিন আপনের যে কালেকশন হয়, তা বেহুদা চা-পান খাইয়া নষ্ট না করলে তো বাড়ি-গাড়ির মালিক হইয়া যাাইতে পারতেন!

: চাচা মিয়া, আপনেদের দশজনের দোয়ায় মমিসিং শহরে একটা বাড়ির মালিক আল্লায় আমারে বানাইছে।

: পান পাওয়া বাদ দেন। তাইলে গাড়ির মালিক হইতে আর বেশি টাইম লাগবে না।

: পান খাওয়া বাদ দিলে পাবলিকের কাছে কী উপলক্ষ কইরা টেকা চামু? উ-হু, পান খাওয়া ছাড়ন যাবে না; বরং পান সবসময় মুখের মধ্যে দিয়াই রাখন লাগবে।

: তাইলে এক কাম করেন!

: কী কাম?

: আসল একশ টেকার ওপর পান খাওয়া বাবদ ১৫ পার্সেন্ট হারে ভ্যাট বসাইয়া দেন। পাবলিক আপনের হাতে একশ টেকা দেওয়ার পর অতিরিক্ত আরও পনের টেকা ভ্যাট হিসাবে তাদের কাছ থেইকা চাইয়া নিবেন। এই দেশে মানুষ ভ্যাট শব্দটারে খুবই সম্মান করে। আপনে ভ্যাটের টেকায় পান খাবেন আর ঘুসের টেকায় গাড়ি কিনবেন।

: চাচা তো জব্বর একটা বুদ্ধি দিলেন! আপনের পঞ্চাশ টেকা মাফ। বাকি পঞ্চাশ টেকা দেন।

: না, না। মাফ হবে ক্যান? আমিই বরং আইজ থেইকা আসলের সঙ্গে ভ্যাট সংযুক্তকরণের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা কইরা আপনেরে একশ পনের টেকা প্রদান করতিছি।

টাকার জন্য পাঞ্জাবির পকেটে হাত রাখলেন ছবদর খান; কিন্তু সে হাত কোথাও বাধাগ্রস্ত না হয়ে নিচের দিকে ধাবিত হতেই চমকে উঠলেন তিনি। কাউন্টারের বুকিং ক্লার্ক টিকিট হাতে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছেন ছবদর খানের দিকে। ছবদর খান তলাবিহীন পাঞ্জাবির পকেটসহ ডান হাতটা বুকিং ক্লার্কের চোখের সামনে মেলে ধরতেই তিনি মৃদু একটা আর্তনাদ তুলে বললেন-

: কী হইল!

: নতুন কিছু না! এক সাধুর সঙ্গে কথা বলার টাইমে আরেক সাধু তার কর্ম করছে!

: পকেটে কি বেশি টেকা ছিল?

: খুব বেশি না।

: যাক, অল্পের উপর দিয়া গেছে।

: কিন্তু আমার মনটা তো খারাপ হইয়া গেল; আপনের টেকাটা দিতে পারলাম না।

: হ, সন্ধ্যাবেলা; এখন বওনি হয় নাই।

বুকিং ক্লার্কের কথার উত্তরে ছবদর খান তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন-

: মন খারাপ কইরেন না। ঢাকা যাওনের জন্য আমার তো ইস্টিশনে আওনই লাগবে। তখন ভ্যাটসহ সমুদয় পাওনা টেকা আপনের হাতে আমি তুইলা দিবাম।

মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

mokamia@hotmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম