কিছুমিছু
বাইশ গেল তেইশ আইলো তুমি আইলা না

মোকাম্মেল হোসেন
প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

১৪৫ কিলোমিটার দূর থেকে লবণ বেগমের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। গলায় বিষাদের ঢেউ তুলে বললাম-
: বাইশ গেল তেইশ আইলো, তুমি আইলা না!
খ্রিষ্টীয় ২০২২ সাল সম্প্রতি গত হয়েছে। আজ ২০২৩ সালের প্রথম মাসের পঞ্চম দিবস। বাইশ-তেইশ নিয়ে উচ্চারিত পদ্য শুনে লবণ বেগম খুব মজা পেল। বলল-
: তোমার কথা শুইনা লোকজন নিঃসন্দেহে তোমারে মজনুর খালাত ভাই বজলু মনে করবে আর ভাববে, আহা রে! ২০২২ সাল বেচারার বিরহে কাটছে; ২০২৩ সালেও যার অবসান ঘটেনি!
: ঘটনা তো সত্য।
: সত্য হইলেও ফারাক কয়দিনের?
ফারাক অবশ্য বেশিদিনের না। ছেলেদের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর গত বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে তারা মায়ের সঙ্গে পিঠা-পায়েস খেতে গ্রামে গেছে। পত্রিকা অফিসে চাকরি না করে অন্য কোনো পেশায় থাকলে নিশ্চয়ই আমিও তাদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারতাম! ঢাকা শহরের কোলাহল আর ধুলামাখা বাতাসের হাত থেকে কয়েকদিনের জন্য নিষ্কৃতি পেয়ে নির্মল বায়ু সেবনের পাশাপাশি রান্নাঘরে চুলার পাশে বসে মা ও শাশুড়ির হাতের হরেকরকম গরমাগরম পিঠার স্বাদ নিতে পারতাম। কিন্তু হায়! আমার এমনই এক পেশা, বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া এক-দুদিনের বেশি ছুটি পাওয়া দুষ্কর। তারপরও আশায় বুক বেঁধে বিভাগীয় প্রধানের সামনে দাঁড়ালাম। বললাম-
: ভাই, আমারে সাতদিনের ছুটি দেওন লাগব!
বস এমনভাবে তাকালেন, যেন আমাকে তিনি চিনতে পারছেন না। হুশে আসার পর চোখ কপালে তুলে বললেন-
: সাত-দিনের ছু-টি!
: হ।
: কি-জন্য?
: বউ-বাচ্চারা গ্রামে যাইতেছে। আমিও তাদের লগে যাইতে চাই।
:এইটা পত্রিকা অফিস। বউ-বাচ্চাদের সঙ্গে তাল মিলাইলে চলবে? আমি আমার বিবাহের সময় মাত্র তিনদিনের ছুটি পাইছিলাম, তাও জোর-জবরদস্তি কইরা; আর আপনে বউ-বাচ্চার পোঁটলা টানার জন্য সাতদিনের ছুটি চাইতেছেন! সেভেন ডেস! হাউ ইজ ইট পসিবল!
: শুধু পোঁটলা টানার বিষয় না; আরও বিষয় আছে।
: আর কী বিষয়?
: নির্মল বায়ু সেবন করব।
: কী করবেন?
: গ্রামে যাইয়া নির্মল বায়ু সেবন করার ইচ্ছা পোষণ করতেছি।
বস আমার কথা শুনে হো-হো করে কতক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন-
: শুনছি, আগের দিনে মানুষ হুক্কার আগায় কল্কি বাইন্ধা তামাক সেবন করত। ইদানীং এক ফ্যাশন বাইর হইছে-অভিজাত শ্রেণির ইয়াং ও ক্রেজি ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্ট-ক্লাবে যাইয়া ‘সিসা’ সেবন করে। হুক্কাও না, সিসাও না; আপনে যাবেন বায়ু সেবন করতে! বায়ু একটা সেবন করার বিষয় হইল? বায়ু তো ত্যাগ করার বিষয়!
: ভাই, বিষয়টারে আপনে হালকা কইরা ফেলতেছেন! আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি।
: বুঝলাম সিরিয়াসলি বলছেন। এই জন্য কষ্ট কইরা গ্রামে যাওয়ার দরকার কী? আপনে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে চইলা যান। সেইখানে নির্মল বায়ু সেবনের সুযোগ তো পাবেনই, সেইসঙ্গে অতিথি পাখিদের কলকাকলি শুইন্যা, তাদের ওড়াওড়ি দেইখ্যা বিমুগ্ধ হইয়া যাবেন।
: শুধু বায়ু সেবনের বিষয় না; আরও বিষয় আছে।
: আর কী বিষয়?
: শাশুড়ি পিঠা খাওয়ার দাওয়াত দিছেন। আর আম্মাও তার পোলারে পিঠা খাওয়ানোর জন্য অস্থির হইয়া পড়ছেন।
বস আরেক প্রস্থ হাসলেন। হাসি থামার পর বললেন-
: আজকাল পিঠা খাওয়ার জন্য দল বাইন্ধা গ্রামে যাওয়ার সেই ট্র্যাডিশন আছে? ঢাকা শহরের অলিগলিতে এখন হাজার হাজার পিঠা-পুলির দোকান। দোকানদাররা হরেকরকমের পিঠার পসরা সাজাইয়া বইসা রইছে। আপনে আন্ডাবাচ্চা সবাইরে লইয়া দোকানে যাবেন, অর্ডার দিবেন আর গপাগপ গিলবেন। ব্যস, পিঠা-পর্ব ফিনিস।
রাস্তাঘাটের পিঠা আর মা-শাশুড়ির হাতে বানানো পিঠা কি এক? এসব কথা কে কাকে বোঝাবে! হতাশ হয়ে রণেভঙ্গ দিলাম। পত্রিকা অফিসে ‘ডে-অফ’ বলে একটা কথা চালু আছে। সাপ্তাহিক ছুটি বোঝাতে কলমজীবী মহল ডে-অফ শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। ডে-অফের দিন পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ময়মনসিংহ যাওয়ার পর পাইকাররা কারওয়ান বাজারে আড়তের সামনে ট্রাক থেকে যেভাবে আলু-বাইগনের বস্তা ছুঁড়ে ফেলে, সেভাবে তাদের ছুঁড়ে ফেলে পরদিন খুব ভোরে ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি, লবণ বেগম বলল-
: তোমার খাবার রেডি। খাইতে আসো।
খেতে বসার পর পাতে এটা-সেটা দিতে দিতে লবণ বেগম বলল-
: নার্গিসের মারে বলবা, সাতদিনের খাবার যেন একদিনে রান্না কইরা ফ্রিজে না ঢোকায়। প্রতিদিনের খাবার যেন প্রতিদিন রান্না কইরা দেয়।
পশ্চিমবঙ্গের দাদারা যাদের ‘ঠিকে ঝি’ বলে, নার্গিসের মা হচ্ছে সেই টাইপের গৃহকর্মে সাহায্যকারী মহিলা, আমাদের দেশে যারা ‘বুয়া’ নামে পরিচিত। আমাদের মা-চাচিরা গৃহকাজে সাহায্যকারী জনবল নিয়ে যেরকম আরাম-আয়েশে সময় কাটিয়েছেন, এ যুগের বউ-ঝি’রা সে সুযোগ থেকে প্রায় বঞ্চিতই বলা চলে। বর্তমানে ফুলটাইম গৃহকর্মী পাওয়া আর আসমানের চাঁদ পাওয়া প্রায় সমান কথা। নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের এই যুগে পোকড়া-ধোকড়া ফুলটাইমার গৃহকর্মী দু’একজন যাওবা পাওয়ার চান্স ছিল, সরকার তাদের নানারকম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। দেশের মধ্যবিত্ত ও নিুমধ্যবিত্তের এখন একমাত্র ভরসা হলো ‘নার্গিসের মা’ টাইপের বুয়া। নার্গিসের মা লবণ বেগমের শর্ত মানবে বলে মনে হয় না। সে সকালবেলা আমাদের বাসায় এসে আধঘণ্টা, সর্বোচ্চ চল্লিশ মিনিট সময় ব্যয় করে। এরপর ঠিক একচল্লিশ মিনিটের মাথায় মোবাইল ফোনে হ্যালো-হ্যালো করতে করতে বের হয়ে যায়। নার্গিসের মা সময় ভাগ করে সকাল-সন্ধ্যা বিভিন্ন বাসায় হাজিরা দেয়। তার সময় অনেক মূল্যবান। এ দামি সময়ে ভাগ বসাতে চাইলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সে যদি গোসা করে নোটিশ দিয়ে দেয়, তাহলে নাস্তা-পানি যা পাওয়ার আশা আছে, কপালে সেটাও জুটবে না। সবকিছু জানার পরও লবণ বেগমের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে গেলাম না। জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছি-ঘুড়ির সুতা কাটাকাটি করা আর নারী জাতির সঙ্গে কথা কাটাকাটি করা এক জিনিস নয়। শুধু নার্গিসের মা’র বিষয়ে নয়, লবণ বেগম যদি বলে-
: আসমান থেইকা কিছু তারা আইনা আমারে একটা মালা গাঁইথা দেও তো!
কোনো বাক্য ব্যয় না করে বলব-
: আইচ্ছা।
সে মালা আসমানের তারা দিয়ে গাথা হবে, না পুঁতি দিয়ে গাথা হবে-তার ফয়সালা সময়মতো হবে। নার্গিসের মা’র ব্যাপারে ‘আইচ্ছা’ বলার পর দেখলাম, প্রসঙ্গের অবসান ঘটেনি। আরও ‘আইচ্ছা’ বাকি আছে। লবণ বেগম কিছুক্ষণ আমার ভোজনক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে বলল-
: আমরা বাসায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত চোখ বন্ধ কইরা সিঁড়ি দিয়া নামবা। চোখ বন্ধ কইরা সিঁড়ি দিয়া উঠবা। ডাইনে-বামে কোনো দিকে তাকাবা না।
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। কোনো কাটাকাটি-ফাটাফাটির মধ্যে না গিয়ে শিশুর মতো সরল ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলাম-
: আইচ্ছা।
: কেউ যদি আহ্লাদ কইরা কোনো খাবার লইয়া আসে, খাওয়া তো দূরস্থান, চোখ তুইলা সেদিকে তাকানোও নিষেধ দিলাম।
: আইচ্ছা।
: সামনে ইংরেজি নববর্ষ। নববর্ষের বাহানা তুইল্যা কোনো ধরনের আয়োজন কইরা দাওয়াত দিলে বলবা, গতকাইল থেইকা আমার পাতলা পায়খানা শুরু হইছে। শুধু স্যালাইন আর ডাবের পানির ওপর আছি।
: যদি বিশ্বাস না করে?
: বিশ্বাস না করলে প্রমাণ দিবা।
: কী প্রমাণ দিব?
: জোলাপের বড়ি খাইয়া পায়খানা পাতলা বান্ধাবা। তারপর কাচের বয়ামে সেই বস্তু চিনি বেগমের সামনে রাইখা বলবা-এই দেখেন আপা, স্যাম্পল।
: আইচ্ছা। কিন্তু...
: কিন্তু কী?
: যদি মিষ্টি নিয়া আইসা বলে, মিষ্টি খাইলে কোনো সমস্যা নাই; তখন কী করব?
: ওই মিষ্টি ভুলেও মুখে তুলবা না। কার মনে কী আছে, কে জানে! সাধারণত মিষ্টি জাতীয় খাবার লইয়াই তুকতাক কারবার বেশি চলে।
: তুকতাক কারবার মানে!
: মানে জাদুটোনা। জাদুটোনা করা মিষ্টি খাওয়ার পর দেখা গেল, তুমি আর হুঁশে নাই।
: বেহুঁশ করার কারবার তো রাস্তা ঘাটে অজ্ঞান পার্টির লোকজন কইরা থাকে।
: রাস্তা ঘাটের চেয়ে আশপাশের অজ্ঞান পার্টি আরও বেশি ভয়ংকর। কাজেই সাবধান। খুব সাবধান।
: আইচ্ছা, ঠিক আছে। একটা কথা বলি?
: কী কথা?
: চিনি বেগমের সঙ্গে আমার বেশি খাতির; না তোমার? বছরে আমি কয়দিন তার বাসায় যাই, আর তুমি দিনে কয়বার যাও?
: না যাইয়া উপায় আছে? একদিন আইসা বলে, আপা নতুন একটা ড্রেস কিনছি-দেইখ্যা যান তো কেমন হইছে। পরের দিন আইসা বলে-বাচ্চার ইংরেজি গ্রামারটা বুঝতে পারতেছি না, আপনে একটু আইসা বুঝাইয়া দিয়া যান। তারপরের দিন আইসা বলে-চুলায় আচার বসানোর পর রেসিপি ভুইলা গেছি। আপা, কাইন্ডলি আমারে উদ্ধার করেন। এরপরের দিন...
: তুমি তো তারে ফেসবুক ফ্রেন্ডও বানাইছো!
: বানাইছি কি আমোদ কইরা? সে উইলিংলি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাইছে। তাও তো ছয় মাস ঝুলাইয়া রাখছিলাম। তারপর স্বীকৃতি দিছি।
ঢাকায় ফেরার পর নার্গিসের মার কাছে প্রস্তাব পেশ করতেই সে মুখ বেঁকিয়ে বলল-
: আপা তো বইলাই খালাস! সকালবেলা গ্যাসের কী অবস্থা হয়, এইটা আপা জানে না? এই রহম টিমটিমাইয়া জ্বলা গ্যাস দিয়া এক মুঠ চাইলের ভাত ফুটাইতেই আমার জান কবজ হওয়ার দশা। প্রত্যেক দিন সব খাবারের আয়োজন কেমনে করবাম?
গ্যাসের সমস্যা মানে জাতীয় সমস্যা। এক্ষেত্রে নার্গিসের মার কী আর করার আছে? কাজেই সে তার রুটিনে পরিবর্তন ঘটাল না। অফিসে থেকে বাসায় ফেরার পর লবণ বেগমের নির্দেশ অনুযায়ী দু’চোখ বন্ধ করে সিঁড়ি টপকাচ্ছি, হঠাৎ গলা খাঁকারির শব্দ কানে এলো। পরক্ষণেই চিনি বেগমের গলার স্বর শুনতে পেলাম। বিস্ময়মাখা গলায় ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন-
: কী ব্যাপার! আপনে এই রকম কানাবাবা সাইজা সিঁড়ি ভাঙতেছেন কেন! চোখে কিছু পড়ছে নাকি?
আর চোখ বন্ধ রাখার উপায় নেই। চোখ মেলে পিটপিট করে বললাম-
: না।
: তাইলে এই রকম করছিলেন কেন?
: ফায়ার সার্ভিসের লোকজন মাঝেমধ্যে মহড়া দেয় দেখেন নাই? সেইরকম মহড়া দিতে ছিলাম।
: ফায়ার সার্ভিসের লোকজন তো তাদের চাকরির অংশ হিসাবে এই কাজ করে। আপনে কোন দুঃখে কানাবাবার মহড়া দিতেছেন?
: যদি ভবিষ্যতে কাজে লাগে?
: কী রকম!
: যদি কোনো কারণে অন্ধ-টন্ধ হইয়া যাই, দৃষ্টিশক্তি বিনষ্ট হইয়া যায়, তখন এই মহড়া কাজে লাগবে।
: আল্লাহ মাফ করুক। আপনের হইল আজাইরা কামে গজাইরা বুদ্ধি। এত বোকা কেন আপনে, বলেন তো!
: আরে! ভবিষ্যতের ভাবনা মাথায় রাইখ্যা প্রস্তুতি সম্পন্ন কইরা রাখলে ক্ষতি কী?
: রাখেন আপনের ভবিষ্যৎ-ভাবনা। স্মার্টলি সিঁড়ি পার হইতে হইতে বাসায় যান।
: আইচ্ছা।
পরদিন বাসায় ফেরার পর আবার সিঁড়িতে চিনি বেগমের মুখোমুখি হলাম। তিনি মুচকি হেসে বললেন-
: আইজ আপনের বাসায় ঢুকছিলাম।
: বাসায় ঢুকছিলেন মানে! কেমনে ঢুকলেন? তালা দেওয়া ছিল না?
: তালা দেওয়া ছিল। আপনের বুয়া সকালে কাপড় ভিজাইয়া রাইখা গেছিল। বিকাল বেলা সেইগুলা কাচতে আইসা দরজার তালা আর খুলতে পারে না।
: কেন?
: সে তো বলল, জর্দা দিয়া পান খাওয়ার পর তার মাথা ঘুরাইতেছে। সেইজন্য ঠিকমতো তালার মধ্যে চাবি ঢুকাইতে পারতেছে না। আমি ছাদে যাইতেছিলাম। আমারে দেইখা বলল, আপা, হেলপ করেন; তালাটা একটু খুইলা দিয়া যান।
গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারপরও বিশ্বাস করার ভান করে বললাম-
: অঃ।
: আপনের বাসায় ঢোকার পর তো দেখি অবস্থা ভয়াবহ। ১৪-১৫টা রুটি আধাছেঁকা কইরা ফ্রিজে রাইখা দিছে। ওইগুলার মধ্যে ফাঙ্গাস পইড়া গেছে। তরকারিও তো কয়েকদিনের বাসি মনে হইল। আপনে এ ফাঙ্গাস পড়া রুটি আর বাসি তরকারি খান কেমনে?
: খাই। অভ্যাস হইয়া গেছে।
: যদি মারাত্মক কোনো অসুখ-বিসুখ হয়?
: হবে না।
: কেমনে বুঝলেন, হবে না? আইচ্ছা এক কাজ করি, আপা না আসা পর্যন্ত আমি আপনের নাস্তা আর খাবার রেডি কইরা পাঠাইয়া দিব। ঠিক আছে?
: না, না।
: না কেন! সমস্যা কী?
: কোনো সমস্যা নাই। আমি এই খাবার খাইয়াই সন্তুষ্ট আছি।
এর দিন দুয়েক পর থার্টিফার্স্ট নাইটের সন্ধ্যায় হঠাৎ দরজার বেল বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখি, চিনি বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রমহিলা হাসিমুখে বললেন-
: আপনেরে দাওয়াত দিতে আসলাম।
: কিসের দাওয়াত?
: আইজ আমরা ছাদে থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন করব। বাড়িওয়ালার পারমিশন নেওয়া হইছে। বাইরের দোকান থেইকা বিরাট আকারের দুইটা সাউন্ড বক্সও ভাড়া আনা হইছে। আপনে কিন্তু অবশ্যই আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন।
: উহুঁ! আমার পক্ষে যোগ দেওয়া সম্ভব হবে না।
: কেন সম্ভব হবে না?
: আমার প্রচণ্ড মাথা ধরছে। আমি ওইসব হাউ-কাউয়ের মধ্যে যাইতে পারব না।
: মাথা ধরছে? আমি মাথা টিইপা দেই?
চিনি বেগমের কথা শুনে মুখ হা হয়ে গেল। ঠোঁটে রহস্যময় হাসির আবির্ভাব ঘটিয়ে চিনি বেগম বললেন-
: মুখ বন্ধ করেন-মাছি ঢুকবে। আমি কি সত্যি সত্যি বলছি নাকি? মজা করার জন্য বলছি।
রাত দশটার দিকে ছাদে হইচই পর্ব শুরু হলো। এটা চলল রাত বারোটা পর্যন্ত। বারোটা এক বাজতেই ব্রায়ান অ্যাডামসের গলা ভেসে এলো। তিনি উচ্চসুরে গেয়ে উঠলেন-
: হোয়েন ইউ লাভ সাম ওয়ান...
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে লবণ বেগম জানতে চাইল-
: কী ব্যাপার! থুম ধইরা রইছো কেন? কথা কও।
: তুমি কবে আসবা?
: আমি আইলেই কী; আর না আইলেই কী! আমারে কি তোমার কোনো প্রয়োজন আছে?
: এসব কী ধরনের কথাবার্তা! প্রয়োজন নাই মানে? তোমারে ছাড়া আমি একেবারেই অচল।
: সত্য?
: একশবার সত্য। হাজারবার সত্য। আমি বর্তমানে এক ঠ্যাইংগা বকের মতো উদাসীন দৃষ্টিতে তোমার আসার পথের দিকে চাইয়া রইছি।
: মাছের নড়াচড়া দেখলে এক ঠ্যাইংগা বকের দুই ঠ্যাইংগা হইতে কিন্তু টাইম লাগে না।
লবণ বেগমের কথা শুনে চুপ হয়ে গেলাম। নিজের কথার জালে নিজেই আটকে গেছি। এখন আর কিছুই করার নেই...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
mokamia@hotmail.com