Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

স্মরণ

সমাজকে আলোকিত করেছেন তিনি

Icon

মোহাম্মদ কবীর আহমদ

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সমাজকে আলোকিত করেছেন তিনি

আজ বিশিষ্ট সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তার সৃজনশীল কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনার আগে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা দরকার। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে যখন স্মার্ট ও দক্ষ কর্মী গড়ে তোলার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে, তখন সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার বিষয়ে দেশে দেশে এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কেন? কারণ, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ধারণ করে। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গ্রন্থপাঠ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ লক্ষ্যে কেউ ইচ্ছা করলে দর্শন বা অন্য কোনো বিষয়ের চর্চায়ও মনোনিবেশ করতে পারেন। সাহিত্য পাঠে সব ধরনের পাঠক যেভাবে নিজেকে খুঁজে পান, অন্য বিষয়ে সেভাবে পান না।

এখন অনেকেই গ্রন্থপাঠে সময় দিতে চান না। অজুহাত-ব্যস্ততা। মনে রাখা দরকার, প্রযুক্তি বা এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যারা বড় অবদান রাখতে চান, তারা বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থপাঠ করলে আরও বড় কৃতিত্বের পরিচয় দিতে সক্ষম হবেন। কেবল প্রযুক্তি নিয়ে চিন্তা করলে রোবট ও মানুষের পার্থক্য থাকে কি? মানবিক মূল্যবোধের প্রভাব সংকুচিত হলে দেশে দেশে কী ধরনের সংকট সৃষ্টি হতে পারে, তা বহুল আলোচিত। বিশ্ববাসী হিরোশিমার মতো নতুন কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না। এ বিষয়ে জোরালো জনমত সৃষ্টি করা দরকার। মানসম্মত বই জোরালো জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিশ্বায়নের প্রভাবে দেশে দেশে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। এক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আগামীতে কী ধরনের বাড়তি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, তা বহুল আলোচিত। এ সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান খুঁজলে তেমন সুফল পাওয়া যায় না। কারণ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে গেলে তা পুনরুদ্ধার করা কঠিন। একটি দেশের ক্লাসিক শিল্প-সাহিত্যে সেদেশের সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানকে নিখুঁতভাবে সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়। বস্তুত কোনো দেশের সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান ক্লাসিক সাহিত্যে যতটা মর্যাদা দেওয়া সম্ভব, অন্যত্র তা কঠিন। সে কারণেই দেশে দেশে সংস্কৃতির সুরক্ষার সাহিত্যকর্মকে এতটা গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বর্তমানে অনেকে অজান্তেই নিজস্ব সংস্কৃতি বিশ্বময় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এখন নিজেদের সংস্কৃতি বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ারও এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। আমাদেরও উচিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া।

বস্তুত পড়ার অভ্যাসই জগৎ সম্পর্কে বিশেষ কৌতূহল সৃষ্টি করে, যা এ আমলের বিলগেটসসহ অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি স্বীকার করেছেন। তারা মনে করেন, সেই অভ্যাসই মানুষকে নিরন্তর এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। বিশ্বের আরও বহু খ্যাতিমান ব্যক্তির পুস্তকপ্রীতি সর্বজনবিদিত। তারা বলেছেন, যে বই মানুষকে প্রেরণা দেবে তেমন বই বেশি পড়তে হবে। বস্তুত বই মানুষের তৃষ্ণা বাড়ায়; যা সাফল্যের ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রাখে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে পরবর্তী অন্য লেখকদের লেখায় বাংলা সাহিত্যে কলকাতাকেন্দ্রিক একটি ধারা সৃষ্টি হয়েছিল। পাশাপাশি ঢাকাকেন্দ্রিক একটি ধারাও সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলাভাষী লেখকদের লেখায় এ ভিন্নতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সাহিত্যে ঢাকাকেন্দ্রিক ধারার লেখকদের লেখায় এ দেশের মানুষ নিজেদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন যেভাবে খুঁজে পায়, কলকাতার কোনো লেখকের লেখায় তা পায়নি। এভাবেই পাঠকপ্রিয় হতে থাকে সাহিত্যের ঢাকাকেন্দ্রিক ধারা। এ ধারা দিন দিন সমৃদ্ধ হতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে আমাদের দেশের লেখকদের হাতেই নির্মিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের নিজস্ব ভাষা ও বিষয়বস্তু। সেই সময় এ কাজে যেসব লেখক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, রাবেয়া খাতুন তাদের অন্যতম। তার উপন্যাস ‘মধুমতী’ প্রকাশিত হওয়ার পর কলকাতার দেশ পত্রিকায় প্রশংসাসূচক মন্তব্য ছাপা হয়।

রাবেয়া খাতুনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো প্রগতিশীল চিন্তাকে ধারণ করা। তিনি উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, স্মৃতিকথা, সম্পাদনাসহ সাহিত্যের বিচিত্র অঙ্গনে পরিভ্রমণ করেছেন। শিশুসাহিত্যেও তিনি রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তার সাহিত্যকর্মের সঙ্গে পরিচিত হলে এ দেশের আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। এটি পাঠকের জন্য বাড়তি পাওয়া। আগামীর পথে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার জন্য পেছনের তথ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া দরকার। যেহেতু তার রচনাবলিতে তিনি এ দেশের আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের চিত্র নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, সেহেতু তরুণদের উচিত তার রচনাবলির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়া।

বৈরী পরিবেশের কারণে তিনি বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাননি। সেই সুযোগ পেলে হয়তো আমরা তার কাছ থেকে ভিন্ন ধরনের সাহিত্যকর্ম উপহার পেতাম। কেবল আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের বহু দেশেই বহু গুণীজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের চেষ্টায় সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ হলেও রাবেয়া খাতুন নিরন্তর অধ্যয়ন করেছেন, তার রচনাবলি থেকেই তা স্পষ্ট। নারী হয়ে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করার কারণে নিন্দিত হলেও তিনি থেমে যাননি। সব বাধা অতিক্রম করে তিনি নিজেকে প্রগতিশীল লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পারিবারিক দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার পাশাপাশি যে সামাজিক দায়িত্ব পালনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা যায়, রাবেয়া খাতুন তা প্রমাণ করেছেন।

তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা এবং সেগুলোর সাহিত্যমান থেকেই স্পষ্ট সামাজিক দায়িত্ব পালনকে তিনি কতটা গুরুত্ব দিতেন। যারা প্রগতিশীল হিসাবে পরিচিত, তাদের অনেকে এখনো পরিবারের কোনো নারী সদস্যের সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়াকে সেভাবে উৎসাহ প্রদান করেন না। এর প্রধান কারণ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। অথচ সেই সময় রাবেয়া খাতুন সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার পথিকৃৎদের অন্যতম ও প্রথম চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা ‘সিনেমা’র সম্পাদক এবং বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’-এর পরিচালক ফজলুল হক ছিলেন তার স্বামী। রাবেয়া খাতুন পেশা ও লেখালেখির বিষয়ে স্বামীর পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছেন। যাদের লেখা পাঠ করে দেশে রুচিশীল পাঠকসমাজ গড়ে উঠেছে, রাবেয়া খাতুন তাদের অন্যতম। দেশে এখনো উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ পড়তে জানে না, রাবেয়া খাতুন তাদের কাছেও পরিচিত ও জনপ্রিয়। তার রচনাবলি অবলম্বনে টেলিভিশনে বহু নাটক ও সিনেমা নির্মিত হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে দেশে এখন দৃশ্যমাধ্যম ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। এ কারণে দেশে বিপুলসংখ্যক দর্শক তার নাটক ও চলচ্চিত্র দেখে সমৃদ্ধ হচ্ছে। দেশে দৃশ্যমাধ্যমে, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কনটেন্টের অভাব কতটা প্রকট, তা-ও বহুল আলোচিত। বর্তমানে ইউটিউবে রাবেয়া খাতুন রচিত নাটক ও চলচ্চিত্রগুলো সুলভ হওয়ায় মানুষ সেসব দেখে উপকৃত হচ্ছেন।

‘সেই যে আমার ছেলেবেলা’ শিরোনামের এক লেখায় রাবেয়া খাতুনের সন্তান ফরিদুর রেজা সাগর বলেছেন, ‘আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত করানোর জন্য বাবা ট্যাক্সি করে আমাদের নিয়ে ঢাকার বাইরে যেতেন। কখনো কখনো টাঙ্গাইল যেতেন। সঙ্গে মা একটা চাদর নিয়ে যেতেন। কোনো এক আমগাছের তলায় ওই চাদরে বসে আমরা খাওয়া-দাওয়া সেরে চারপাশে অনেকক্ষণ ঘুরে দেখার সুযোগ পেতাম। ... এভাবে বাবা-মা আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত করানোর চেষ্টা করেন।’ এ থেকেই বোঝা যায়, রাবেয়া খাতুন ও তার স্বামী ফজলুল হক কতটা দূরদর্শী ছিলেন।

২০১৯ সালে রাবেয়া খাতুন পান ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’। এ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তার সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়-‘তার লেখা প্রথম থেকে যারা পড়বেন, তারা আমাদের সমাজের পরিবর্তনের চিত্র পাবেন, সমাজের ভাঙাগড়ার ইতিহাস পাবেন ...। ... আমরা খেয়াল করে দেখি, এগোতে এগোতে তিনি আমাদের চারপাশের প্রায় সর্বত্রই আলো ফেলেছেন। সে আলোয় শুধু যে তার রচনাই আলোকিত হয়েছে তা নয়, আলো পেয়েছি আমরা, যারা পাঠক; আলো পেয়েছে আমাদের সাহিত্য।’

১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এ দেশের প্রত্যেক মানুষের জীবনের প্রতিমুহূর্তের প্রেরণা। তাই এ বিষয়ে যত বেশি সাহিত্য রচিত হবে, দেশের মানুষ তত বেশি উপকৃত হবেন। রাবেয়া খাতুনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যকর্ম আলাদাভাবে মূল্যায়ন হওয়া দরকার। তার রচিত সৃজনশীল কর্মকাণ্ড নিয়ে আলাদাভাবে গবেষণা হওয়া দরকার। এ লেখার উদ্দেশ্য রাবেয়া খাতুনের লেখার মূল্যায়ন নয়। উদ্দেশ্য, পাঠকদের একটি বার্তা দেওয়া। তা হলো, যারা আমাদের দেশের সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হতে চান, তারা রাবেয়া খাতুনের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হলে বিশেষভাবে উপকৃত হবেন।

মোহাম্মদ কবীর আহমদ : সাংবাদিক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম