ফিরে দেখা ২০২৩
যুদ্ধের খঞ্জরে রক্তাক্ত বিশ্ব
ইসরাত জাহান স্বর্না
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে গেল আরেকটি বছর-২০২৩। বিশ্ব ইতিহাসের উত্তাল এই বছরজুড়েই দেশে দেশে লড়াই কিংবা সাম্রাজ্যবাদী রোষানলে পড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন জনপদ। দিন ফুটতেই পৃথিবীর বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে সে বিষবাষ্প! ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে শুরু করে আন্তঃদেশীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। যুদ্ধের খঞ্জরে রক্তাক্ত হয়েছে বিশ্ব। বলতে গেলে বিশ্ববাসীর ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছে ২০২৩ সাল। রণ-দামামায় উত্তাল হয়ে উঠেছে আমাদের শান্তির ধরণি!
ইসরাইল-গাজা যুদ্ধ : বছর শেষের ঠিক দুমাস আগেই সবচেয়ে বড় কলঙ্কের কালিটা লাগে ২০২৩-এর গায়ে। একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বর্বর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে ইসরাইল। পৈশাচিক হামলা শুরু করে গাজায়। গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস গাজা সীমান্ত অতিক্রম করে ইসরাইলে হামলা চালায়। হামাস অভিযানে ইসরাইলের বেসামরিক নাগরিকসহ প্রায় ১,২০০ মানুষ নিহত হন। এছাড়া জিম্মি করা হয় ইসরাইলের প্রায় ২৪০ জন নাগরিককে। হামাস অভিযানের পরপরই গাজায় স্থল আক্রমণ শুরু করে ইসরাইল। নৃশংস হামলায় অঞ্চলটিতে নিহত হয়েছেন প্রায় ২১ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। যুদ্ধের সাত সপ্তাহ পর গত ২৪ নভেম্বর দুপক্ষ ইসরাইলের জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে গাজায় চার দিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। পরবর্তী সময়ে এই যুদ্ধবিরতির মেয়াদ দুদিন বাড়ানো হয়। যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পরপরই গাজায় পুনরায় আক্রমণ শুরু করে ইসরাইল।
ইউক্রেন যুদ্ধ : গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আক্রমণ চালিয়েছিল রাশিয়া। ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। ইউক্রেন রাশিয়ায় আক্রমণের ১৬ মাস পর কিয়েভও পশ্চিমাদের সাহায্যে রাশিয়ায় পালটা আক্রমণ শুরু করে। তবে চলতি বছরের শেষ দিক এসে অস্ত্র, তহবিল ও সেনা সংকটে পড়েছে ইউক্রেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে দেশটির প্রধান সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনও দিন দিন কমে যাচ্ছে। ডেমোক্র্যাটরা ইউক্রেনকে সাহায্য দিতে চাইলেও রিপাবলিকানদের তা আর কংগ্রেসে পাশ করা সম্ভব হয়নি। ইউক্রেনকে সমর্থনে কংগ্রেসে আগেই পাশ হওয়া বাজেটের শেষ ধাপ দেওয়া হয়েছে।
ইউক্রেনে হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে জাতিসংঘের অনুমান অনুযায়ী, ১০ হাজারেরও বেশি ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। এ পর্যন্ত ৫ লাখ ইউক্রেন ও রুশ সেনা নিহত হয়েছেন বলে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
মিয়ানমার সংঘাত : মিয়ানমারের বর্তমান সংঘাতের সূচনা হয় ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। সেই বছর অং সান সু চির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করেছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তারা ক্ষমতা দখলের পর থেকেই দেশটিতে উদ্বাস্তু ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। জান্তাবিরোধীদের সঙ্গে বাড়তে থাকে সংঘাত। সম্প্রতি দেশটির বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠী বিদ্রোহ শুরু করায় দেশটিতে সংঘাত আরও চরমে উঠে। দেশটির উত্তর-পূর্বে তিনটি শক্তিশালী জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী ২৭ অক্টোবর থেকে অপারেশন-১০২৭ নামে একটি আক্রমণ শুরু করে। নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে দেশটির উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বে শহর ও অন্যান্য অঞ্চলের। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, জাতিগত গোষ্ঠী ও জান্তাদের মধ্যে যুদ্ধে প্রায় ২০০ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। নতুনভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৩ লাখ ৩৫ হাজার জন।
চলমান এ সংঘাত নিয়ে নভেম্বরেই আতকে ওঠা হুঁশিয়ারি দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইউ মিন্ট সোয়ে। বলেন, সীমান্ত অঞ্চলে অকার্যকর ব্যবস্থাপনার কারণে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে মিয়ানমার। জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর বিদ্রোহে জান্তা ‘সক্রিয়ভাবে ভেঙে পড়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন মিয়ানমারের স্বাধীন বিশ্লেষক ম্যাথিউ আর্নল্ড। দেশের প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো বর্তমানে জান্তাকে মৌলিকভাবে পরাস্ত করার জন্য মিয়ানমারের প্রধান শহরগুলো দখলের দিকে মনোনিবেশ করছে।
সুদানে সেনা-আধাসেনা যুদ্ধ : এ বছরই আরেকটি নতুন যুদ্ধে জড়ায় বিশ্ব। সেনা-আধাসেনা যুদ্ধে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি, অর্থনৈতিক সংকট আর স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবার প্রায় পতনের মুখে সুদান। সুদানিজ সশস্ত্র বাহিনী (এসএএফ) ও র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের মধ্যে (আরএসএফ) ক্ষমতার লড়াই শুরু হয় চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরুর পর থেকেই দেশটিতে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ও গণহত্যার ঘটনা ঘটতে থাকে। শুরুর দিকে তাদের এই সংঘাত সুদানের রাজধানী খার্তুমে কেন্দ্রীভূত থাকলেও পরবর্তী সময়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও তা ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া দারফুরে গণহত্যা ও বাস্তুচ্যুতিসহ জাতিগত নির্মূলের খবরও পাওয়া গেছে।
বিশ্বের অর্থনীতি অথবা রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে এমন যুদ্ধের পাশাপাশি কোথাও কোথাও আগে থেকেই শুরু হওয়া যুদ্ধের নতুন মোড় নিয়েছে। আর্মেনিয়া আর আজারবাইজান অঞ্চলে এ বছরই পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপসহ বিশ্বব্যাপী সশস্ত্র সংঘাতের দিকে নজর রাখার এ সম্পর্কিত ওয়েসাইটগুলোর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সরাসরি যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলা মিলিয়ে বিশ্বের ৩২টি দেশ বর্তমানে সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য সংঘাত চলছে আলজেরিয়া, বুরকিনা ফাসো, চাদ, কঙ্গো, ঘানা, আইভরি কোস্ট, নাইজার, সুদান, তানজানিয়া, টোগো, তিউনেশিয়া, উগান্ডা, ইয়েমেন, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, আফগানিস্তান, মালি, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া, ইথিওপিয়া ও গাজা-ইউক্রেনের মতো দেশ। ইয়েমেনে এখন জাতিসংঘের চেষ্টায় শান্তি কার্যকর হলেও উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। একই অবস্থা ইথিওপিয়ায়। যেকোনো সময় আবার সরাসরি যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। ২০২৩ সালেই তাইওয়ান প্রণালিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মুখোমুখি অবস্থান নেয়। হামাসের অভিযানের পর লেবাননের সঙ্গেও ইসরাইল সংঘাতের নতুন মাত্রা পেয়েছে। গত ৩ ডিসেম্বর হিজবুল্লাহ-ইসরাইল পালটাপালটি হামলা চালিয়েছে। এতে নিহত হয়েছেন লেবাননের তিন নাগরিক। এ ছাড়া লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে লেবাননের এক সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন।
২০০৩ সালে ইরাকে অভিযান চালিয়ে সাদ্দাম সরকারকে উৎখাত করে যুক্তরাষ্ট্র। তখন থেকেই সেখানে সামরিক ঘাঁটি করে রয়েছে মার্কিন সেনারা। সেসব সেনাঘাঁটি লক্ষ্য করে প্রায়ই হামলা চালায় ইরান সমর্থিত ইরাকের কাতায়েব হিজবুল্লাহ মিলিশিয়া ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী। গত দেড় মাসে অন্তত ১২ বার হামলার শিকার হয়েছে ইরাক। সম্প্রতি কাতায়েব হিজবুল্লাহর হামলায় কিছু মার্কিন সেনা আতহ হওয়ার পর আবারও ইরাকে নতুন করে আক্রমণ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশে দেশে যুদ্ধের বাইরেও এ বছর মানুষের মধ্যে সহিংসতার প্রবণতাও বেড়েছে। ২০২৩ সালে ভয়াবহ বন্দুক সহিংসতায় আমেরিকায় ৪২ হাজার ৩০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। আমেরিকার অলাভজনক সংস্থা ‘গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ’ বার্ষিক রিপোর্টে এ তথ্য জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চলতি বছর যেসব মানুষ বন্দুক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছে তারে বেশিরভাগই বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তারপরই রয়েছে হত্যাকাণ্ড, আত্মরক্ষার চেষ্টা এবং অনিচ্ছাকৃত গুলি। রিপোর্টে আরও বলা হয়, ৪২ হাজার ৩০০-এর মধ্যে ১৮ হাজার ৫৪১ জন নিহত হয়েছে বন্দুক সহিংসতা সম্পর্কিত ঘটনায়। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে ৬৫০টির বেশি গণগুলিবর্ষণ, ৪০টি গণভাবে হত্যা, এক হাজার ১৬১টি আত্মরক্ষামূলক ঘটনা এবং এক হাজার ৫৪৩টি ছিল অনিচ্ছাকৃত গুলিবর্ষণের ঘটনা। গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ বলছে, আমেরিকায় ২০২৩ সালে মোট ২৩ হাজার ৭৬০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।