বিদায় ২০২৩, স্বাগত ২০২৪
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শিরোনামের কথাগুলো গতানুগতিক, আমরা সব সময়ই বছর শেষে এবং সমাগত বছরের আবাহন করি এভাবে। তবে এমন কথার পেছনে তথ্য ও যুক্তি যে আছে, তা অনস্বীকার্য। কারণ অভিজ্ঞতাপ্রসূত উপলব্ধ সত্য উচ্চারণ করে উইনস্টন চার্চিল বলেছেন, তুমি যতদূর পেছনে তাকাবে তত সামনে তাকাতে পারবে (If you look longer back, you can look farther ahead)। অর্থাৎ সামনে তাকাতে হলে পেছনে অবশ্যই তাকাতে হবে। জানা কথা, বর্তমান ভবিষ্যৎ নির্দেশ করে। জীবজগতেরও নিয়ম অভিন্ন। মানুষ হাঁটার সময় দুই পা একত্রে সামনে বাড়ায় না। এক পা পেছনে, আর অন্য পা থাকে সামনে। পেছনের পায়ের শক্তির ওপর সামনের পায়ের শক্তি নির্ভর করে। সুতরাং তথ্য-যুক্তি এবং জীবজগতের নিয়ম অনুযায়ী পেছন ফিরে না তাকিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি সম্প্রসারিত করা সম্ভব নয়।
আমরা রোমক কিংবদন্তির দেবতা জেনাসের (বা জানুস) মতো নই; তার সামনে ও পেছনে চার চোখ ছিল, সে সামনে ও পেছনে দেখতে পেত। সুতরাং তাকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু মানুষের সামনে দুটো চোখ, পেছনে কোনো চোখ নেই। কাজেই মানুষ ফাঁকিতে পড়ে। আর সে কারণেই তাকে পেছন ফিরে তাকিয়ে, পেছনটা ভালো করে বুঝে, সামনে এগোনোর প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়।
বিদায়ী ২০২৩ সালের দিকে তাকিয়ে জীবনানন্দের পঙ্ক্তি যেন মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে : ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন।’ ২০২৩ সালে পৃথিবী যেন অসুখে অসুস্থ ছিল। সে বছরের শুরুতে করোনার ছোবল কমে এসেছিল; তবে অন্য যেসব অসুখ পৃথিবীকে ভর করেছিল-তা দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিসরে। দেশ-বিদেশ সবখানেই যেন ‘গভীর গভীরতর’ অসুখের বিস্তার!
দেশ নিয়েই আগে কথা বলি। দেশের অসুখ তো নানাবিধ। মোটা দাগে, বছরটা ছিল নির্বাচনের। নির্বাচনি ডামাডোলের কমতি ছিল না; তবে তা সরকারের এবং সরকারপক্ষ সমর্থনকারীদের। প্রধান বিরোধী মহল (বিরোধী দল নয়) বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। তাদের আন্দোলন/কর্মসূচিতে দেশ ছিল উত্তাল-অস্থির। তাদের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা (জনসমর্থন সত্ত্বেও) আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ আছে। বিবেকি প্রসঙ্গ গাজার যুদ্ধ নিয়েও তাদের (বিএনপি+জামায়াত) কোনো উচ্চবাচ্য নেই। কারণ, তাহলে আমেরিকা রুষ্ট হবে। কাজেই তাদের আন্দোলন ছিল গন্তব্যহীন যাত্রা। তাদের লক্ষ্য ঠিক ছিল; কিন্তু পথ ঠিক ছিল না।
নির্বাচনি আমেজ আছে, কিন্তু উৎসব কোথায়? প্রার্থীরা উৎসবের আমেজে থাকবে, তা ঠিক; কিন্তু ভোট উৎসব হবে ভোটের দিন (৭ জানুয়ারি ২০২৪); এবং তা ভোটারের উপস্থিতি ও তাদের উৎসবের মধ্য দিয়ে। ভোটার-উপস্থিতি নিয়ে সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। আর যাই হোক, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চাই না, আমরা চাই প্রশ্নাতীত নির্বাচন। নির্বাচন হয় জনগণের টাকায়, যার সঠিক ব্যয় ও ব্যবস্থাপনা কাম্য।
বর্তমান সরকার ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় পনেরো বছরের বেশি। এ সময়ে দেশের উন্নয়ন নিয়ে সরকার উচ্চকণ্ঠ ও প্রগল্ভ। কিন্তু আসলে হয়েছে প্রবৃদ্ধি; উন্নয়ন এখনো হয়নি। উন্নয়ন হলো সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি। বৈষম্য জিইয়ে রেখে সামগ্রিক উন্নয়ন করা দুষ্কর। তবে প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের পূর্ব শর্ত, যা অর্জনে সরকার ধন্যবাদার্হ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সারা বছরই সীমিত বিত্তের/বিত্তহীন মানুষকে নাকাল করেছে। বাজার-ব্যবস্থাপনায় সরকার কাঙ্ক্ষিত পারঙ্গমতার পরিচয় দিতে পারেনি।
সর্বোপরি, দেশ বিপন্ন হয়েছে শাসন-শৃঙ্খলার অভাবে। শাসকের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু শাসন জনজীবনে স্বস্তি দিতে পারেনি। ব্রিটেনের বিশৃঙ্খল অবস্থায় ক্ষুব্ধ হয়ে বিচারপতি স্যার জন ফর্টেস্কু লিখেছিলেন ‘Governance of England’ (1476)। টিউডর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ৭ম হেনরি (১৪৮৫-১৫৩৯) শাসন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। প্রায় শতবর্ষী মাৎস্যন্যায়ের পর বাংলায় শান্তি-স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন গোপাল (৭৫০-৭৮১)। বাংলাদেশে প্রয়োজন একজন ৭ম হেনরি বা একজন গোপাল। আমরা এমন নেতৃত্বের জন্য অপেক্ষমাণ।
বিদায়ী বছর দুটো যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অসুস্থ ছিল-রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর গাজা যুদ্ধ। ইউক্রেনে রাশিয়া আক্রমণকারী। ইউক্রেন সমান লড়াই করছে। কিন্তু হামাসের উসকে দেওয়ার পর (৭ অক্টোবর) গাজায় যুদ্ধনীতি লঙ্ঘন করে ইসরাইল একপক্ষীয় সন্ত্রাস করছে; সঙ্গে আছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ব শান্তি রক্ষায় যাবতীয় উদ্যোগ সত্ত্বেও জাতিসংঘ একটি অকেজো প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে হলে জাতিসংঘের খোলনলচে পালটাতে হবে; প্রয়োজন গণতন্ত্রায়নের। যুদ্ধহীন পৃথিবী নিশ্চিত করতে হলে জাতিসংঘকে যা করতে হবে, তার সামর্থ্য প্রতিষ্ঠানটির থাকতে হবে। অসুস্থ পৃথিবীতে শান্তি-সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে বড়দিন (২৫ ডিসেম্বর) চলে গেল। আমরা চাই ২০২৪ সালের প্রতিটি দিন যেন ‘বড়দিন’ হয়।
মানুষের এত ব্যত্যয়-বিচ্যুতি ২০২৩ সালে, তবুও আশা থাকছে, ২০২৪ সাল যেন আমাদের জন্য শান্তি-সম্প্রীতির বার্তা বয়ে আনে। কারণ ‘মানুষ তবু ঋণী পৃথিবীরই কাছে’ (জীবনানন্দ)। যে পৃথিবীর কাছে মানুষের এত ঋণ, তাকে তো ‘বাসযোগ্য’ করতেই হবে (সুকান্ত)। এমন আশা দুর্মর, মানুষ আশা নিয়েই বেঁচে থাকে। হতাশা তো জীবনশক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সুতরাং গিরিশচন্দ্র সেনের মতো বলি-
‘সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা, আশা তার একমাত্র ভেলা।’
লেখক : চেয়ার অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)