এক যুগের সাধনা একদিনে শেষ
৬৫ বছরে প্রথম স্থগিত ‘সিন্ধু সন্ধি’
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ বেশ পুরোনো। ১৯৪৭ সাল-আজ থেকে প্রায় ৭৭ বছর আগে। দেশভাগের পর থেকেই বিবাদ শুরু হয় দেশ দুটিতে। কার অধিকার থাকবে সিন্ধু নদীতে-এ নিয়েই চলে তুমুল লড়াই। টানা ১২ বছর তর্ক-বিতর্কের পর অবশেষে ১৯৬০ সালে পানি ভাগাভাগির চুক্তিতে বসে দুই দেশ। এরপর থেকে আর কখনো বড় কোনো মতভেদ দেখা যায়নি ভারত-পাকিস্তানে। দুই দেশের মধ্যে ১৯৬৫ (দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ), ১৯৭১ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ) এবং ১৯৯৯ (কার্গিল যুদ্ধ) সালে ৩টি যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া সত্ত্বেও অক্ষুণ্ন ছিল চুক্তিটি। কিন্তু মঙ্গলবার হঠাৎ করেই জঙ্গি হামলায় রক্তাক্ত হয়ে ওঠে কাশ্মীর। নিমিষেই ভেস্তে যায় পুরোনো পরিকল্পনা। এ হামলার জেরে ফুলেফেঁপে উঠে ভারত। একের পর এক কড়া পদক্ষেপ নেয় দেশটি। এরই মধ্যে বুধবার ৬৫ বছর ধরে চলা সেই পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিতের ষোঘণাও দেয় ভারত সরকার। এক যুগের সাধনার চুক্তি শেষ হয়ে যায় একদিনেই। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এনডিটিভি, রয়টার্স।
সিন্ধু চুক্তি কি? : সিন্ধু চুক্তি একটি যুগান্তকারী পানিবণ্টন চুক্তি। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত হয় চুক্তিটি। করাচিতে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
কী রয়েছে সিন্ধু চুক্তিতে? : এই চুক্তিটি সিন্ধু অববাহিকার পাঁচটি নদীকে দুটি দেশের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছে। ভারত পূর্ব দিকের তিনটি নদী রবি, বিয়াস ও শতদ্রু পেয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান পেয়েছে পশ্চিমের তিনটি নদী সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাব। এই চুক্তির ফলে সামগ্রিকভাবে সিন্ধু এবং তার উপনদীগুলোর মোট পানির ওপর পাকিস্তানের অধিকার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। বাকিটুকু ভারতের। পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশের অর্থনীতি এই পানির ওপরেই নির্ভরশীল।
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, এই চুক্তি সিন্ধু নদী ব্যবস্থার সুষ্ঠু ও সহযোগিতামূলক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কাঠামো তৈরি করেছে। যা ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই কৃষি, পানীয় জল এবং শিল্পের জন্য অপরিহার্য। চুক্তি অনুযায়ী, ভারত বা পাকিস্তান নিজেদের প্রয়োজনে ওই পানি ব্যবহার করলেও কোনো অবস্থাতেই পানিপ্রবাহ আটকে রাখতে পারবে না।
কেন এই চুক্তি? : এই সিন্ধু নদীর উৎপত্তি তিব্বতে। ভারত এবং পাকিস্তানের ওপর দিয়ে এর একটা বড় অংশ প্রবাহিত হয়েছে। কিছুটা রয়েছে আফগানিস্তান ও চীনেও। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় ভারত ভাগের পর এই সিন্ধু নদী দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার মূল কারণ হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালে ভারত সাময়িকভাবে পাকিস্তানে সিন্ধুর পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এই বিষয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জে অভিযোগ জানায় পাকিস্তান। রাষ্ট্রপুঞ্জ সিদ্ধান্ত নেয় তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় এই বিষয়টির মীমাংসা করা হবে। এগিয়ে আসে বিশ্বব্যাংক। ১২ বছর ধরে আলোচনার পর ১৯৬০ সালে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তি বদল নিয়ে টানাপোড়েন : ১৯৬০ সালের পরে দুই দেশের বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সিন্ধু চুক্তির পুনর্মূল্যায়নের কথা ২০২৩ সালে ইসলামাবাদকে জানিয়েছিল নয়াদিল্লি। যদিও, ইসলামাবাদের তরফে তখন সাড়া মেলেনি। এর আগে ২০১৬ সালে পাকিস্তান অভিযোগ তুলেছিল, ভারত কিষেণগঙ্গা এবং রাতলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল ইসলামাবাদ। যদিও ‘নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক’ জানিয়ে দেয়, পাকিস্তানের প্রাপ্য পানি আটকাতে নয়, ভারত নিজেদের প্রয়োজনেই কিষেণগঙ্গা এবং রাতলে প্রকল্প নির্মাণ করেছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, ১৯৪৭-৪৮ সালে সিন্ধুর পানি নিয়েই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন সরকার কাশ্মীর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সিন্ধুর পানির কারণেই। যদিও, ১৯৬৫ ও ৭১-এর যুদ্ধের সময় সিন্ধু চুক্তিতে হাত দেয়নি কোনো দেশই। এমনকী, কার্গিল যুদ্ধের সময়েও দুই দেশের মধ্যে এই চুক্তি বজায় ছিল। তবে এবার ভারতের মাটিতে প্রবেশ করে নাগরিকদের বেছে বেছে নৃশংসভাবে হত্যা করায় কড়া পদক্ষেপ নিল ভারত। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই চুক্তির সাময়িক স্থগিতাদেশ একাধিক জটিলতা তৈরি করতে পারে। কারণ পাকিস্তানে পানির মূল উৎসই এই নদীগুলো। কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় কমপক্ষে ২৬ জন পর্যটক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অনেকেই। এ হামলার দায় স্বীকার করেছে সন্ত্রাসী সংগঠন কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট।
