
প্রিন্ট: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৪৬ এএম
ট্রাম্পের বিশ্ব পোড়ানো শুল্কে নিজের ঘরেই আগুন
পালটাপালটি এমন শুল্কারোপে বিশ্বজুড়ে মার্কিনিদের জন্য তৈরি করা পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। এটি মূল্যস্ফীতি বাড়াবে

যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনের মনোরম বৈকালিক হাওয়ায় অত্যন্ত ধীরস্থির মস্তিষ্কে ঐতিহাসিক বাণিজ্য যুদ্ধের ‘পাগলা ঘণ্টা’ বাজান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৮৫টি দেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যে বাজার বিধ্বংসী ‘শুল্ক তোপ’ ছোড়েন। বুধবার দেশটির ‘মুক্তি দিবস’র এই ঘোষণা ছড়িয়ে পড়তেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে বিশ্ব শেয়ারবাজার। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অস্থির হয়ে উঠে শ্বিবাজার। ধস নামে মার্কিন শেয়ার বাজারে। আগুন ধরে যায় নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত জনসাধারণের পকেটে। কারণ নতুন শুল্ক আইন বাস্তবায়ন হতেই লাফিয়ে আকাশে উঠে যাবে হাতের নাগালের ভেতরে থাকা দ্রব্যমূল্যও। বিশ্ববাজার পোড়ানো এই আগুন ইতিমধ্যেই কুণ্ডলী পাকাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের ঘরেও। নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য কিনতে হাত পুড়বে মার্কিনিদেরও। বিবিসি।
যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ধনকুবের’ বানাতে বিশ্বজুড়ে যে শুল্কের খক্ষ ট্রাম্প চাপিয়েছেন, তার ধাক্কা সামলাতে হবে মার্কিনদেরও। বিশ্বের যেসব দেশ থেকে নিয়মিত পণ্য কিনে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, ধাওয়া-পালটাধাওয়া প্রতিক্রিয়ায় নিজেদের রপ্তানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে সেসব দেশও। এতে পোশাক থেকে শুরু করে কফি সবকিছুতেই বাড়তি অর্থ গুনতে হবে মার্কিনিদের। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বসেরা ব্র্যান্ডগুলোও তাদের বাজার হারাতে পারে ।
যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেশটিতে প্রবেশ করা শত শত কোটি ডলারের পণ্যে ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। যেসব দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘সবচেয়ে খারাপ’ বলে বিবেচনা করেছেন, সেসব দেশের ওপর তিনি চাপিয়েছেন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কের বোঝা। ৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে তার ওই ঘোষণা। অর্থনীতিবিদরা ট্রাম্পের এ নতুন শুল্ক ঘোষণা ও এর পালটা পদক্ষেপ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা পণ্যের ওপর কোনো কোনো দেশের বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘটনায় সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন। পালটাপালটি এমন শুল্কারোপে বিশ্বজুড়ে মার্কিনিদের জন্য তৈরি করা পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। এটি মূল্যস্ফীতি বাড়াবে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরম পাওয়েল।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার জেরে বিদেশি পণ্যের মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো শুল্কের বোঝা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে বা পণ্যের আমদানি কমিয়ে দিতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। বিদেশি পণ্যের মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো শুল্কের বোঝা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে বা পণ্যের আমদানি কমিয়ে দিতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। এতে যেসব নিত্যপণ্যে মার্কিনদের বাড়তি অর্থ গুনতে হতে পারে, সেসবের উল্লেখযোগ্য হলো পোশাক।
ট্রাম্পের বাড়তি শুল্কের ধাক্কা লাগবে ভিয়েতনাম, চীন ও বাংলাদেশের মতো পোশাক রপ্তানিকারক দেশের ওপর। যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে থাকে, সে তালিকায় প্রথম পাঁচটির তিনটিই হলো এই তিন দেশ। তাদের পণ্যের ওপর ৩৪ থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প।
পোশাক রপ্তানিকারক এই তিন দেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করার অর্থ হলো, টার্গেট ও ওয়ালমার্টের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোসহ পোশাক খাতের পরিচিত আরও কিছু ব্র্যান্ড আর্থিকভাবে চাপ অনুভব করতে পারে। সুলভ মূল্যে পছন্দের পোশাক কিনতে প্রায়ই এসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে থাকেন মার্কিন ভোক্তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গ্যাপ। খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওল্ড নেভি, ব্যানানা রিপাবলিক ও অ্যাথলেটাও পরিচালনা করে থাকে গ্যাপ। বৃহৎ খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গ্যাপের ২১ শতাংশ পোশাকের উৎস ভিয়েতনাম। এছাড়া আরও ৩৭ শতাংশ পোশাক আসে ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ থেকে। এ বিশ্লেষণ ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়ারের ফ্যাশন অ্যান্ড অ্যাপারেল স্টাডিস বিভাগের অধ্যাপক শেং লুর।
আবার এইচঅ্যান্ডএম সস্তা ফ্যাশনের জন্য সুপরিচিত। প্রতিষ্ঠানটি অধিকাংশ পোশাক কিনে থাকে চীন ও বাংলাদেশ থেকে। বুধবার এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন সতর্ক করে বলেছে, নতুন শুল্ক মার্কিন পরিবারগুলো, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর অযৌক্তিক বোঝা চাপাতে পারে। ইতোমধ্যে ট্রাম্প বলেছেন, শুল্ক বোঝা এড়াতে ভিয়েতনাম মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তিতে আসতে কাজ করার জন্য তৈরি। অন্যদিকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে পালটা শুল্ক আরোপ করেছে।
কফি ও আমদানি করা অন্যান্য খাদ্যপণ্য : যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দারা নিত্যদিন যে কফি পান করে থাকেন, তার প্রায় সম্পূর্ণটা আসে দেশটির বাইরে থেকে। এর অর্থ হলো, মার্কিনিরা ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাসাবাড়িতে বা দোকানে গিয়ে কফি পান করতে গেলে এখন থেকে বড়সড় অর্থ তাদের গুনতে হতে পারে, যা তাদের মানিব্যাগে চাপ বাড়াবে।
কফির জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার ওপর নির্ভর করে। দেশ দুটির ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রে নির্দিষ্ট কিছু কফির গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিকারক দেশের একটি ভিয়েতনাম।
সানফ্রান্সিসকো ভিত্তিক কফি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গ্রাফিউর স্বত্বাধিকারী ওয়াল্টার হ্যাস ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, যেদিন শুল্ক কার্যকর হবে, আক্ষরিকভাবে পরদিন থেকেই তার প্রতিষ্ঠানকে এর ধাক্কা সামলাতে হবে। বাড়তি শুল্ক বহাল থাকলে কফির দাম বাড়বে এবং ভোক্তাদের তা পরিশোধ করতে হবে।
একই রকম পরিণতি বরণ করতে হতে পারে অলিভ অয়েলসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য আমদানিকারক মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এসব পণ্য ইতালি, স্পেন, গ্রিসসহ বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো থেকে এসে থাকে। ইইউর পণ্যে ট্রাম্প ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।
জুতা-অ্যাডিডাস থেকে নাইক : যুক্তরাষ্ট্রবাসীর নিত্যদিনের ব্যবহার্য পণ্যের একটি জুতা। জনপ্রিয় ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস থেকে শুরু করে নাইকের জুতা কিনতে সামনের দিনগুলোতে তাদের বাড়তি অর্থ খরচ করতে হবে। দুটি প্রতিষ্ঠানই তাদের বিক্রি করা পণ্যের জন্য এশীয় দেশগুলোর ওপর নির্ভর করে। নাইকের জুতার প্রায় অর্ধেক ও অ্যাডিডাসের ৩৯ শতাংশ তৈরি হয় ভিয়েতনামে।
অধ্যাপক লুর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বেশি জুতা আমদানি করেছে; এর অধিকাংশ এসেছে চীন ও ভিয়েতনাম থেকে। এ পণ্যের ওপর এত দিন শুল্ক ছিল প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। তা এখন প্রায় তিনগুণ বাড়তে পারে।
অ্যালকোহল, ইউরোপীয় ওয়াইন ও বিয়ার : যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াইন সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস দেশগুলোর একটি ফ্রান্স। ইইউর ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করায় ওয়াইন আমদানি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো। দ্য বোরগোগন ওয়াইন বোর্ড বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ওয়াইন রপ্তানিকারক ও ভোক্তা উভয়ের জন্যই ‘এক গুরুতর ধাক্কা’।
ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়তে পারে অ্যালকোহল ও বিয়ারের দামও। আইফোন, মুঠোফোন, টেলিভিশন, ভিডিও গেমিং উপকরণসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যের দামও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়তে পারে বলে জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। যুক্তরাষ্ট্রে এসব পণ্যের বড় রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া।