সোনার হরিণ ধরতে প্রাণপাখি যায়!
জীবিকার খোঁজে ‘মৃত্যুপথে’ উগান্ডার খনি শ্রমিকরা

শাবনুর নাহার
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিকে অন্ধকার। ভ্যাপসা গরম, সেই সঙ্গে দম বন্ধ হওয়া ধুলোর কণা। মাথার ওপরে মৃত্যুভয়। যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে সুড়ঙ্গ। শুরুটা সুড়ঙ্গের মতো হলেও কিছুদূর নামার পরই বিস্তীর্ণ ‘গণকবর’। অনেকটা সেরকমই দেখতে। একেবারে সদ্য খনন করা কবরের মতোই। খুঁড়লেই সোনা মিলবে, তেমন ভাগ্য নিয়েও জন্মেনি খরাবিদগ্ধ উগান্ডার পোড়ামাটির এ হতভাগারা! তবু হাতুড়ির পর হাতুড়ি; শাবলের পর শাবল! থেমে থেমেই আবার হাতড়ে হাতড়ে কী যেন খুঁজছে দুহাতে! দিনশেষে কারও হয়তো মিলছেও ছোট ছোট টুকরোর মতো দু-তিন দলা সোনা! ‘পাতালপুরীতে’ লুকিয়ে থাকা ‘মহামূল্যের’ এ সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে ছুটতে ঘাম-দুর্গন্ধে ভরা তামাটে শরীরের খাঁচা ভেঙে সাধের প্রাণপাখিও উড়ে গেছে বেশ কয়েকজনের। তবু ক্লান্তি নেই। শ্বাসরুদ্ধকর সে বদ্ধ গুহায়ই চলছে সোনা উত্তলনের আয়োজন। পরিবারের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দিতে জীবিকার এ মৃত্যুপথই তাদের একমাত্র ঠিকানা। একজন দুজন নয়, দিন ফুটলেই হাজার হাজার মানুষ পা বাড়ায় ১৭ হাজার ৩০৪ বর্গকিলোমিটারের এ মৃত্যুপুরীর পথে। এপি।
উগান্ডার উত্তর-পূর্ব কারামোজা অঞ্চল। রাজধানী কাম্পালা থেকে প্রায় ২৫০ মাইল দূরে অবস্থিত কারামোজা দেশটির সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চল। যেখানে হাজার হাজার কারিগর খনি শ্রমিক মাটি থেকে সোনা উত্তোলন করেই জীবিকানির্বাহ করেন। মারিয়া নাকোরুও তাদের একজন। ক্লান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার কেউ নেই, তাই আমি বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য এ কাজ বেছে নিয়েছি।’ মারিয়া যে জমিতে সোনার জন্য খনন করেন, তা মোরোটোর আঞ্চলিক সদর দপ্তর থেকে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে রুপা জেলায়। ছয় বছর আগে, তার উপরে একটি খনির সুড়ঙ্গ ধসে পড়ে। যার ফলে তার পা ভেঙে যায়। ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হওয়ার পরও দুবেলা খাওয়ার জন্য এ পথেই চলতে হয় মারিয়াকে। যখন ছোট সন্তান মাত্র এক মাস বয়সি, তখন মারিয়ার স্বামী যক্ষ্মায় মারা যান। কেন খনিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি সহজভাবে উত্তর দেন-‘দারিদ্র্য’।
এই প্রত্যন্ত অঞ্চলটিতে সোনার খনিতে কাজ করা একটি সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে। যেখানে একসময় পশুপালন সমৃদ্ধ ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট তীব্র তাপ এবং ক্রমাগত খরার কারণে পশুপালন এখন আর নেই বললেই চলে। উগান্ডা মানবাধিকার কমিশনের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালে কারামোজার ২ হাজারেরও বেশি মানুষ খরার কারণে মারা গেছেন। ফলে জীবিকানির্বাহের জন্য ক্রমেই সোনা উত্তোলনে ঝুঁকছেন শ্রমিকরা। পূর্ব আফ্রিকান গবেষণা তহবিলের ২০১৮ সালের এক জরিপ অনুসারে, কারামোজার ২২ হাজার ৫০০ মানুষ খনি শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন। তবে এত ঝুঁকির পরও খনি শ্রমিকরা প্রতিদিন ১ পাউন্ডের বেশি আয় করেন না। এ বিষয়ে উগান্ডার মেকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের খনিবিষয়ক অধ্যাপক ড. এরিয়া সেরওয়াজা বলেন, আক্ষরিক অর্থে এটি শ্রমিকদের জন্য একধরনের মৃত্যুদণ্ড।
২০২২ সালে যে বছর ২ হাজার মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় মারা গিয়েছিল, সে বছরই উগান্ডা সরকার দেশের মাটিতে অতিরিক্ত ৩১ মিলিয়ন টন সোনার আকরিক খুঁজে পায়। যার বেশির ভাগ খনিজসম্পদ কারামোজায় ছিল। দুবছর আগে ওয়াগাগাই নামে একটি চীনা প্রতিষ্ঠান বুসিয়ায় খনির কাজ শুরু করে। সরকারি হিসাব অনুসারে, আফ্রিকা গোল্ড রিফাইনারি চালুর পর থেকে উগান্ডার সোনা রপ্তানি ক্রমাগত বাড়ছে। কারামোজায় অনুসন্ধানকারীদের আকর্ষণ করার জন্য সোনাই একমাত্র খনিজ নয়। চুনাপাথর, মার্বেল, তামা এবং মূল্যবান রত্নের সন্ধানেও এসেছেন অনেকেই। এর মধ্যে রয়েছে সানবেল্ট মার্বেল অ্যান্ড মাইন ফ্যাক্টরি, যা ২০১৭ সালে কারামোজায় কার্যক্রম শুরু করে। এটিও চীনা ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন। ১০ মিলিয়ন পাউন্ডের এই প্রকল্পটি অপারেশন ওয়েলথ ক্রিয়েশনের সমর্থন পেয়েছে। রুপা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট অনুযায়ী, সানবেল্ট প্রায় এক বর্গমাইল জমিজুড়ে রয়েছে। এ থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা খনিজসম্পদের সুবিধা ভাগ করে নিতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।