Logo
Logo
×

দশ দিগন্ত

ষাটের দশকে আফগান নারীদের ঈর্ষণীয় জীবন

হারানো সেই দিন এখন শুধুই স্বপ্ন

কাবুলের একাল-সেকাল: যুক্তরাষ্ট্রেরও এক বছর আগে ১৯১৯ সালে আফগান নারী ভোটাধিকার আইন পাশ করেন আমানুল্লাহ * নেইল পলিশ দেওয়ার কারণে ১৯৯৬ সালে এক নারীর আঙুল কেটে নেয় তালেবান

Icon

জামির হোসেন

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বরাবরই হিজাব-বোরকা পরতেন আফগান নারীরা। সঙ্গে হাইহিল আর মিনি স্কার্টের মতো পশ্চিমা পোশাক পরার স্বাধীনতাও ছিল। নারীদের জীবন ছিল মুক্ত, অবাধ ও আধুনিক। কোনো রকম ভয়-শঙ্কা ছাড়াই তারা রাস্তা-ঘাটে চলাফেরা করতেন। বেনি দুলিয়ে স্কুলে যেত শিশু-কিশোরীরা। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রী আর কর্মজীবী নারীতে গমগম করত রাজধানী কাবুল। নারীরা সিনেমায় যেতেন, খেতেন রেস্তোরাঁয়। নিত্যদিনের বিনোদনে গান-বাজনা ছিল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেখানেও ছিল নারীদের সমান অংশগ্রহণ। এক কথায়, পুরুষের পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তথা জীবনের সব ক্ষেত্রেই অবাধ বিচরণ ছিল নারীদের। আফগানিস্তানের বর্তমান প্রজন্মের কাছে এগুলো এখন ‘রূপকথা’র রসালো কাহিনি মনে হলেও এ গল্প খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। মাত্র ৬০ বছর আগের ‘ইতিহাস’। আফগানিস্তানে তখন পুরোদমে রাজতন্ত্র। রাজতান্ত্রিক শাসনে থেকেও নারীদের এমন ঈর্ষণীয় চালচলন তাক লাগিয়ে দিত পুরো বিশ্বকে। কিন্তু কয়েক দশকের বিরামহীন যুদ্ধ-সংঘাত, বৈদেশিক আগ্রাসন-দখলদারি আর ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান তাদের জীবনকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে। আফগান নারীদের সেই সোনালি দিন এখন শুধুই স্বপ্ন, সুদূর অতীত।

মধ্যযুগ থেকে শুরু করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই আফগানিস্তান আগাগোড়া একটি ধর্মান্ধ দেশ ছিল। নানা কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস নিয়ে চলত পর্বতময় দেশটির মানুষের জীবনযাত্রা। আর এ কুসংস্কার ও বৈষম্যের সবচেয়ে বড় শিকার ছিলেন সমাজের নারীরা। কোনো স্বাধীনতা ছিল না। শিক্ষার সুযোগ তো দূরের কথা, পুরুষদের অনুমতি ছাড়া বাইরেও যেতে পারতেন না। অনেক অল্প বয়সেই তাদের বিয়ে দেওয়া হতো। বাধ্য করা হতো পর্দা-পোশাক পরিধানে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রথম পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। এ সময় আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতায় আরোহণ করেন আমানুল্লাহ খান নামের এক মহান শাসক (১৮৯২-১৯৬০)। শুরু থেকেই নারী অধিকার নিয়ে বেশ সোচ্চার ছিলেন তিনি। তার হাত ধরেই ইউরোপীয় অনেক দেশের বেশ আগেই ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা পান আফগান নারীরা।

যুক্তরাষ্ট্রেরও এক বছর আগে ১৯১৯ সালে আফগান নারী ভোটাধিকার আইন পাশ করেন আমানুল্লাহ খান। শুধু তাই নয়, তিনি ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু করেন। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের জন্য স্কুল খোলেন, বয়স্ক শিক্ষা চালু করেন, যাযাবরদের জন্যও শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করেন। তিনি বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের পছন্দের স্বাধীনতা, উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমান অধিকার এবং নারী নির্যাতনরোধে আইন প্রণয়ন করেন। তিনি দাস প্রথা ও শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করেন এবং সংস্কার কাজের জন্য ৭৬টি ডিক্রি জারি করেন। তার স্ত্রী রানী সোরাইয়া তারজি ছিলেন তার মতোই বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী ও আধুনিক চিন্তা-চেতনার অধিকারী। হিজাবি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরে এক সভায় নিজের হিজাব টেনে ছিঁড়ে ফেলার মতো দুঃসাহসিক কাজ করেছিলেন তিনি। ১৯১৯ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত মাত্র ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন আমানুল্লাহ খান। কিন্তু তার এসব সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড আফগান সমাজে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। মোল্লাতন্ত্র ও বিদেশি শক্তির চোখ রাঙানি সত্ত্বেও পরবর্তী তিন দশকের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ঘরের বাইরে বের হয়ে আসে আফগান নারীরা। অংশ নেয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক তথা জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। পুরুষদের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন দেশ গঠনে। ১৯৫০-৬০-এর দশকে নারীদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। হিজাব ও বোরকার মতো ঐতিহ্যবাহী পোশাকের বিপরীতে মিনি স্কার্ট ও হাইহিলের মতো পশ্চিমা পোশাক হয়ে ওঠে দৈনন্দিন হালফ্যাশন। নানা রং ও ঢংয়ের পোশাক পরেই কোনো ভয় ছাড়াই দলবেঁধে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান ছাত্রীরা। রাস্তাঘাটে চলাফেরা করেন। সিনেমায়-রেস্তোরাঁয় যান। এমনকি ফ্যাশন শোতেও অংশ নেন। ফ্যাশন ম্যাগাজিন গ্লামার ডেজের তথ্য মতে, ১৯৬০-এর দশকের মধ্যে রাজধানী কাবুলের এক-তৃতীয়াংশ নারীই ঐতিহ্যবাহী পোশাক ফেলে পশ্চিমা পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন।

এ সময় কর্মক্ষেত্রেও আফগান নারীদের সমান অংশগ্রহণ দেখা যায়। তোলো নিউজের এক প্রতিবেদন মতে, ১৯৬৪ সালে সংবিধান প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন নারীরা। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত অন্তত তিনজন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়া শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, মেডিকেল চিকিৎসক-নার্স, আইনজীবী, বিচারক, সাংবাদিক, লেখক-কবি প্রভৃতি পেশায় নারীদের সমান অংশগ্রহণ ছিল। চিকিৎসায় ৪০ শতাংশসহ স্কুল শিক্ষকদের ৭০ শতাংশ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ৬০ শতাংশ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ৫০ শতাংশই ছিল

নারী। নারীদের এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত ছিল ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত।

এরপরই আসে তালেবান ঝড়। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ক্ষমতা দখল করে তালেবান। তারপরই নারীদের আচরণ, পোশাক ও চলাফেরার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সরকারি কর্মকর্তারা পিকআপ ট্রাকে করে শহরে ঘুরে বেড়াতেন। যারা আদেশ মেনে চলতেন না তাদের প্রকাশ্যে অপমান ও চাবুক মারা হতো। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে, নেইল পলিশ দেওয়ার কারণে ১৯৯৬ সালে এক নারীর আঙুল কেটে দেওয়া হয়েছিল। পরকীয়া করলে নারীদের পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলা হতো। সমকামিতার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। মেয়েদের স্কুলে পড়া ছিল নিষেধ। যার কারণে নারী শিক্ষকরা বাড়িতে গোপনে মেয়েদের স্কুল শুরু করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নারী চিকিৎসকরা কাজ করতে পারলেও তারা ছিলেন চরম বৈষম্যের শিকার।

মার্কিন আগ্রাসনের মধ্যদিয়ে ২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয় তালেবান। কিন্তু ২০ বছর পর চলতি সপ্তাহে আবার তারা ফিরে এসেছে। এতে অতীতের সেই বিভীষিকাময় জীবনে ফিরে যাওয়ার চরম আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন আফগান নারীরা। অতীতে তালেবান শাসন অবসানের পর নারীরা যেভাবে সমাজের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ শুরু করেছিলেন-এখন তা হুমকির মুখে পড়েছে। চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন দেশটির নারীরা। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের কিছু কিছু জায়গায় তারা পুরোনো আদেশ বাস্তবায়ন শুরু করেছে। কিছু কিছু প্রদেশে নারীদের পুরুষ আত্মীয় ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, পশ্চিম আফগানিস্তানের হেরাতে তালেবান বন্দুকধারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পাহারা দিচ্ছে এবং নারী শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষকদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে দিচ্ছে না। দক্ষিণাঞ্চলের শহর কান্দাহারের এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, নারীদের স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু জেলায় মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব এলাকার নারীরা জানিয়েছেন, ভয়ে এবং তালেবানদের নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা বোরকা পড়তে শুরু করেছেন। রাজধানীর কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের পুরুষ অভিভাবক ছাড়া ছাত্রাবাস থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। অন্তত দুই শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, শহরে কোনো পুরুষ অভিভাবক না থাকায় তারা কার্যত বন্দি হয়ে পড়েছেন। তবে সোমবার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে অবশ্য তালেবান বলেছে, নারীদের ওপর এবার আর আগের মতো কঠোর হবে না তারা। বোরকা পরাও এবার আর বাধ্যতামূলক নয়। হিজাব পরলেই চলবে। সরকারি চাকরিতেও নিষেধাজ্ঞা নেই। বিশ্লষকরা অবশ্য বলছেন, নারীদের প্রতি এ হঠাৎ উদারতা শুধুই ছলচাতুরী। বিশ্বকে ধোঁকা দেওয়ার ছক। ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হলেই আবার ফণা তুলবে ‘তালেবান সাপ’।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম