সিনেমার উন্নয়ন নাকি নিজেদের স্বার্থে সমিতি
এফডিসি এখন আর সিনেমা নয়, হয়ে গেছে সমিতিনির্ভর একটি প্রতিষ্ঠান। সিনেমার পরিবর্তে সমিতিই যেন এখন ধ্যান-জ্ঞ্যান। সমিতির নির্বাচন, পিকনিক, ইফতার আয়োজন নিয়েই সংশ্লিষ্টদের ব্যস্ততা। সিনেমার চেয়ে এখন এফডিসিতে সংগঠনের সংখ্যাই বেশি। আগে থেকেই সিনেপাড়ায় ১৯ সংগঠন ছিল, ৮ আগস্ট নতুন সরকার গঠনের পর সামনে এসেছে আরও দুটি সংগঠন। সিনেমাসংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, সংগঠনগুলোর কাজ কী? তাদের পরিকল্পনাই বা কী?
তারা ঝিলমিল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি যে খাদের কিনারায় তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বেশ কিছু বছর ধরেই সিনেমাসংশ্লিষ্টরা ইন্ডাস্ট্রিকে আবার দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে দাবি করলেও, এর কোনো চিত্র দেখা যাচ্ছে না বাস্তবে। এদিকে সিনেমা হলের সংখ্যাও কমছে। নেই নতুন সিনেমা মুক্তির তাগিদ। বিগত কয়েক মাসে এ অবস্থার আরও করুণ দৃশ্য ফুটে উঠেছে।
দেশে আন্দোলন ও বন্যা পরিস্থিতিতে প্রেক্ষাগৃহ কিছুদিন একেবারেই বন্ধ থাকে। তারপর চালু করা হলেও দেখা দেয় দর্শক খরা। এর মধ্যে নেই নতুন সিনেমা মুক্তির খবর। শত সমস্যায় জর্জরিত আজ সিনেমা শিল্প। তবুও এসবে নেই যেন কারও মাথাব্যথা। এফডিসিতে সিনেমাসংশ্লিষ্টরা এখন ব্যস্ত সমিতি নিয়ে। কেউ কেউ ব্যস্ত নতুন দল গঠনে। সিনেমার উন্নয়ন ও নতুন সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণীয় পদক্ষেপ নেই। সমিতি চর্চা করতেই এখন কর্মহীন এফডিসিতে নিয়মিত যাতায়াত করেন সদস্যরা। রাজনৈতিক কার্যকলাপ, গালগপ্প, একে অন্যের ওপর রেষারেষি করা এখন এফডিসির মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বাধীনতার পর এফডিসিতে কাজের পরিধি যত বেশি ছিল, সমিতি আর দল তত কম ছিল। কিন্তু এখন হয়েছে উলটো। সিনেমা কম, সমিতি আর দল বেশি। তবে অনেকেই বলছেন, প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের শিল্পীদের দাবি ও সুযোগ সুবিধার জন্য তাদের নিজস্ব একটি সমিতি থাকা প্রয়োজন। তর্কের খাতিরে এটাকে মেনে নিলেও বাস্তবে দেখা যায় এখানে ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ-এসব কারণেও কিছু সংগঠন গড়ে ওঠে। পাশাপাশি কিছু সংগঠন আছে, যেগুলো রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য গড়ে ওঠে বলে মন্তব্য করছেন সিনে বোদ্ধারা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র অভিনয়শিল্পী বলেন, ‘যেখানে পুরোনো দোকানদারদের (সংগঠন) ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না, সেখানে নতুন আরও কিছু দোকানদার তাদের দোকানের (সংগঠন) পসরা সাজাচ্ছেন। তাতে করে সিনেমার উন্নয়ন কখনোই হবে না। মুখে যতই বুলি আওড়াক সিনেমার উন্নয়নে এসব সংগঠন, মূলত এরা তাদের পকেট ভারী করতেই এরকম দোকান খোলে। তাদের কাছে এখন মুখ্য বিষয় সিনেমা নয়, বরং কীভাবে নেতা হওয়া যায়, নেতৃত্বে গিয়ে কতটা ফায়দা হাসিল করা যায়, এগুলোই তাদের প্রধান চিন্তা।’
এদিকে এফডিসিতে ১৯টি সংগঠন থাকার পরও, দেশের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটি সংগঠনের জন্ম দিলেন সিনেমাসংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে ‘বৈষম্যবিরোধী চলচ্চিত্র স্বার্থ সংরক্ষণ কমিটি’ ও ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন ফোরাম’ নামে সংগঠন দুটি তাদের পরিকল্পনায় কতটা অগ্রসর হতে পেরেছেন তা জানতে যোগাযোগ করা হয়। কমিটি করে কোনো লাভ হয়নি বলে জানালেন ‘বৈষম্যবিরোধী চলচ্চিত্র স্বার্থ সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক বদিউল আলম খোকন। তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চেয়েছিলাম। সেভাবে প্রথম বৈঠকও করেছিলাম। তারপর আর কোনো অগ্রগতি নেই। ভেবেছিলাম সরকারি ফান্ড পাব। সেখান থেকে নির্মাতারা সিনেমা নির্মাণ করবেন। সেটাও হয়নি।’
এরই মধ্যে সরকারের কাছে ২১ দফা পেশ করেছেন ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন ফোরাম’। তবে দফাগুলোর একটিও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি বলেই জানিয়েছেন এর আহ্বায়ক শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘সিনেমার উন্নয়নে সরকারের কাছে ২১টি দফা পেশ করেছি। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে অবশ্যই সিনেমার মোড় ঘুরে দাঁড়াবে। তবে সবার আগে দরকার সরকারের সদিচ্ছা।’ এদিকে এসব সমিতির চাঁদা নামক খক্ষে নবীণ নির্মাতারা ‘বলি’ হচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। নতুন সদস্য হওয়ার জন্য পরিচালক সমিতিতে দিতে হয় ৫৫ হাজার এবং প্রযোজককে সংশ্লিষ্ট সমিতিতে দিতে হয় ১ লাখ ৩ হাজার টাকা। সিনেমার নাম এন্ট্রির জন্য ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। আবার সেন্সরে যাওয়ার আগে বিএফডিসি থেকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে নিতে হয় এনওসি। সব মিলিয়ে প্রায় ২ লাখ টাকা শুধু এ চাঁদার পেছনে যায়। সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন-এই সমিতিগুলোকে চাঁদা দেওয়ায় কতটা উপকৃত হয় সিনেমা শিল্প বা সিনেমাসংশ্লিষ্টরা? এর উত্তর নেই কারও কাছে। সমিতি প্রসঙ্গে এক সময়ের জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘সংগঠন বানালে নেতা হওয়া যায়, তখন একেকজন সংগঠনের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি হয়। তাদের আবার সরকারি সংস্থাগুলো ডাকে। শুধু আমাদের দেশেই নয়। বাঙালিরা বিদেশে গিয়েও সংগঠন করে। দেশের স্বার্থ, দেশের মানুষের স্বার্থ বা যে কাজ করলে দেশ ও দেশের মানুষ উপকৃত হবে, সেদিকে এদের কোনো নজর নেই।’ পরিচালক সমিতির সভাপতি কাজী হায়াৎ বলেন, ‘সমিতি গড়ে ওঠার কারণ হলো, একই গোত্রের কিছু মানুষের ওপর যদি কখনো আঘাত আসে, সে আঘাত সে একা সামলাতে পারে না। তখন সে প্রথম তার পরিবারকে জানায়, তারপর গোষ্ঠীকে জানায়, তারপর সমাজকে জানায়। এতে সবাই একত্র হয়ে অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে পারে। এজন্যই সমিতি গঠিত হয়, যার কারণে এফডিসিতে বিভিন্ন সমিতি গড়ে উঠেছে।’