
প্রিন্ট: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২১ এএম

জাফর আহমেদ
প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের পাথরাইল গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কাঞ্চন রাজবংশী। দিনের গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে সুতা সাজাতে চরকার সামনে বসে পড়েন। ২০ বছর কেটে গেছে চরকায় সুতা কাটার কাজে। আগে নিজ বাড়িতেই তাঁত থাকলেও পাল্লায় ছিটকে পড়েছেন। এখন আর বাড়িতে তাঁত নেই। এখন পাশের বাড়ির মহাজন বাদল রাজবংশীর বাড়ির সুতা কেটে দেন কাঞ্চন। টাঙ্গাইল শাড়ির কাজ করে সপ্তাহে উপার্জন প্রায় ৫০০ টাকা। এ নারীর মাসে দুই হাজার টাকা উপার্জনে সংসার চালাতে পুরুষের অনেকটা স্বস্তি এসেছে।
তিনি বলেন, ‘পরিবারের অসচ্ছলতার জন্য এ বয়সে আমাকে চরকা ঘোরাতে হয়।’ কাঞ্চনদের মতো অনেকেই আছেন যাদের চরকা ঘোরার সঙ্গে ঘোরে জীবন-জীবিকার চাকা।
একই গ্রামের দ্বীপা সরকারকে দেখা গেল আরও কঠোর জীবন সংগ্রাম করতে। তার স্বামী বিষ্ণ ছোট ভাই কৃষ্ণকে নিয়ে তানা সাজাতেন। কৃষ্ণ একটি চাকরিতে চলে যাওয়ার পর কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর স্ত্রী দ্বীপা সরকার যোগ দেন স্বামীর কাজে। পুরুষের মতো তানা সাজিয়ে যাচ্ছেন দ্বীপা। দ্বীপা বলেন, ‘আমি কাজে যোগ না দিলে আমার স্বামী একা এ কাজ করতে পারতেন না। তখন কাজটি বন্ধ হয়ে যেত। এজন্য স্বামীর সঙ্গে এ কাজ করছি।’
কৃষ্ণার স্বামী বিষ্ণ রাজবংশী বলেন, ‘এটা একার কাজ নয়। আমার ছোট ভাই চাকরিতে যাওয়ার পর তানা সাজানোর কাজ বন্ধ করতে চেয়েছিলাম। আমার স্ত্রীর সহযোগিতায় এখন কাজ করছি। দুজনের উপার্জনে পরিবারও ভালো চলছে।’
এ এলাকার অনেকেই আবার বেছে নিয়েছেন শাড়ির ওপরের বুটি পরিষ্কার করা। প্রথম দিকে কাঁচি দিয়ে হাতে বুটি কাটলেও এখন বাজারে এসেছে বুটি কাটার ইলেকট্রনিক মেশিন। যার মাধ্যমে দ্রুত কাজ হচ্ছে। স্বপ্না, আদুরী, সুমি রাজবংশীকে দেখা গেল কাপড় কাটতে। দিনে ৩০০-৪০০ টাকা উপার্জন করতে পারেন এসব কর্মীরা। পুরুষের উপার্জনের সঙ্গে যোগ হয়েছে তাদের উপার্জন। এতে একদিকে নারীরা হচ্ছেন স্বাবলম্বী, অন্যদিকে পরিবার চলছে সহজেই।
সরেজমিন দেখা যায়, সুতা রঙের কাজেও অনেকেই শ্রম দিচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকেই নারী। দেখা মিলল সাথী বেগমের। তিনি জানান, নিয়মিত সুতা-রঙের কাজ করছেন। এতে তার পরিবারে ফিরে এসেছে সচ্ছলতা।
ব্যবসায়ী ও তাঁতসংশ্লিষ্টরা জানান, শাড়ির রাজধানী বলা হয় টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লিকে। বল্লা-রামপুরসহ জেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় তাঁতের শাড়ি তৈরি হলেও দেলদুয়ার উপজেলার চণ্ডী-পাথরাইল ও এর পাশের এলাকা তাঁতপল্লি নামে পরিচিত। এ অঞ্চলের উৎপাদিত সুতি, আধা রেশম (হাফ সিল্ক), সফট সিল্ক, জামদানি, গ্যাস-মার্চেন্ডাইজড, টুইস্টেড সুতি, ড্যাগু ও বালুচরি শাড়ি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এ শিল্প দেশের অন্যতম পুরোনো কুটিরশিল্প। এখানকার মানুষের রুজি-রোজগারের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে এ শিল্প।
করোনার ধাক্কার পাশাপাশি সুতার দাম বৃদ্ধির কারণে অধিকাংশ তাঁতি পেশা বদল করে ভিন্ন পেশায় চলে যান। তখন হুমকির মুখে পড়ে এ শিল্প। তখন এ শিল্পের নানা কাজে জড়িয়ে পড়েন পরিবারের নারীরা। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ নারীকর্মী নানাভাবে এ পেশায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। তাঁতের শাড়ি পুরুষ বানালেও পুরো জোগান আসছে নারীর হাত থেকে। তানা সাজানো, সুতা গোছানো, শাড়ি ভাঁজ, শাড়িতে মাড় দেওয়া, চরকায় সুতা বা নকশা কেটে নারী-শিশুরাও তাঁতনির্ভর অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, টাঙ্গাইল শাড়ির কদর থাকলেও তাঁতিদের স্বার্থরক্ষায় নেই সরকারি-বেসরকারি কোনো পদক্ষেপ। শিল্পায়নের প্রভাবে এ শিল্প এখন অনেকটা রুগ্ণ। ক্রমশ হারাচ্ছে ঐতিহ্য। খটখট শব্দে মুখরিত তাঁতপল্লির চিত্র একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে পালটে গেছে। কারিগরের অভাব, লভ্যাংশের অসম বণ্টন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাঁতশিল্পে এখন দুর্দিন। যেসব প্রান্তিক তাঁত শিল্পীদের শ্রমে-ঘামে একটির পর একটি সুতার বুননে ফুটিয়ে তোলে নারীর সৌন্দর্য, সময়ের বিবর্তনে তারাই আজ ভালো নেই।
একদিকে কারিগররা পেশা বদল করেছেন, অন্যদিকে কারিগরের অভাবে উৎপাদন কমে গেছে। পাথরাইলের জগন্নাথ রাজবংশী, শচীন রাজবংশী, গুপিনাথ রাজবংশী ব্যবসা ছেড়ে বাড়িয়েছেন দেনা। এদের মতো ছিটকে পড়েছেন অসংখ্য শাড়ি ব্যবসায়ী। জগন্নাথ রাজবংশীর ৫২টি তাঁত ছিল; শচীনের ২০টি; গুপিনাথের ছিল ১০টি তাঁত। তারা অন্য তাঁতির পত্তনি (ইজারা) দিতেন। জগন্নাথ রাজবংশী ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়ে পৈতৃক ভিটে-বাড়ি বিক্রি করেছেন। নিজের বাড়িতে নিজেই এখন ভাড়াটিয়া। ৪টি তাঁত অন্যের কাছ থেকে পত্তন নিলেও সচল রয়েছে একটি। কারিগরকে পারিশ্রমিক দিয়ে সপ্তাহে ৬০০ টাকা উপার্জন হয়। সাংসারিক খরচ সপ্তাহে হাজার থেকে ১২০০ টাকা। প্রতি সপ্তাহে ৫০০-৬০০ টাকা ধারদেনা করেন। বছর শেষে দেনা পরিশোধ করতে বিভিন্ন এনজিওর দ্বারস্থ হন। শচীন রাজবংশীর ১১ শতাংশের ভিটে-বাড়ি থেকে এখন ৩ শতাংশ আছে। পত্তন নিয়ে দুটি তাঁত বসালেও সচল আছে একটি। এক সময় সেই দাপুটে ব্যবসায়ী বৃদ্ধ বয়সে নিজেই বসেছেন শাড়ি বানানোর পিঁড়িতে। গুপিনাথের ছিল ১১ শতাংশের ভিটে। ব্যবসার দেনা পরিশোধ করতে এখন ভিটেহারা।
তাঁতি শচীন রাজবংশী বলেন, টাঙ্গাইল তাঁতশিল্পের অবস্থা ভালো না। কারিগর পাওয়া যায় না। হস্তচালিত তাঁতে উৎপাদন খরচ বাড়লেও বাড়েনি কারিগরদের মজুরি। ফলে কারিগররা চিত্তরঞ্জন ও পাওয়ার লুমের দিকে ঝুঁকছেন। আমরা মহাজনদের কাছ থেকে সুতা, তানা এনে কারিগর দিয়ে শাড়ি বানিয়ে মহাজনদের দিই। আমরা শুধু মজুরি পাই। লাভ-লোকসান মহাজনদের। এদিকে পবন দাসের মতো অনেকেই হস্তচালিত তাঁত বন্ধ করে শুরু করেছেন পাওয়ার লুমের কারখানা। তিনি বলেন, কারিগরের অভাব থেকেই মূলত পাওয়ার লুম শুরু। পাওয়ার লুমের তাঁত বিদ্যুৎচালিত। ফলে অল্প কারিগরে বেশি উৎপাদন হয়।
টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাট্রির পরিচালক শাড়ি ব্যবসায়ী পলাশ বসাক জানান, টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের শুরু থেকেই নারীদের ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে নারীদের ভূমিকা আরও বেশি। তাঁতশিল্পের মন্দা অবস্থার কারণে অনেকেই পেশা ছেড়েছেন। ফলে জোগান দেওয়া লোকের অভাবে তাঁতশিল্প হুমকির মুখে ছিল। নারীরা এ কাজে সম্পৃক্ত হওয়ায় এখন অনেকটা সহজ হয়েছে। সুতা কাটা থেকে শুরু করে বুটি কাটা পর্যন্ত কমপক্ষে ৪০ ভাগ কাজ নারীদের মাধ্যমে হচ্ছে। এতে নারীও স্বাবলম্বী হয়েছেন। পরিবারেও সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।
টাঙ্গাইল তাঁতপল্লির শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক তাঁত কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পাওয়ার লুম ও ইন্ডিয়ান শাড়ির আমদানি কমিয়ে দেশীয় শাড়ি রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। একইসঙ্গে শাড়ি তৈরির প্রধান কাঁচামাল সুতার দাম কমাতে হবে।