রংপুরের রং শতরঙে রঞ্জিত শতরঞ্জি
মাহবুব রহমান
প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রায় ৭০০ বছর আগে রংপুরের ‘শতরঞ্জির’ পথচলা শুরু। এটি রংপুরের আভিজত্যের প্রতীক হিসাবে দেখেন রংপুরের মানুষ। এ শতরঞ্জি মূলত একটি ‘কারুপণ্য’জাতীয় পণ্য। নিখুঁত হাতের মাধুরী মিশিয়ে যে বুননে ফুটে ওঠে এর কারুকাজ, তার প্রধান কারিগর গ্রামের নারীরাই। পুরুষরা মূলত এ পণ্যের বাজারজাতসহ অন্যান্য কাজের জোগান দিয়ে থাকেন। শুরুতেই বাড়িতে বসেই কাজ করতেন গ্রামীণ কারু শিল্পীরা। সেখান থেকে বাজারজাত করা হতো। এর ব্যবহার ছিল আভিজাত পারিবারিক ঐতিহ্য হিসাবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ২০২১ সালের ১৭ জুন রংপুরের শতরঞ্জি বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এ শতরঞ্জি এখন বাংলাদেশের প্রধান হস্তজাত উৎপাদিত রপ্তানিমুখী কারুপণ্য। বিশ্বের প্রায় ৭২টি দেশে এর রপ্তানি হয়ে থাকে। আর এর প্রধান রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রংপুরেরই ‘কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া রংপুরের নিসবেতগঞ্জ গ্রামেই ছোট-বড় কারখানা রয়েছ ৪টি, আর বাড়িতে বসে কাজ করেন এমন পরিবার রয়েছে ১৫টির অধিক। বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান রংপুরের পায়রাবন্ধ গ্রামের শতরঞ্জির বাজারতাজকরণের জন্য কয়েকজন উদ্যোক্ততা কাজ করছেন।
শতরঞ্জির তৈরির দেশের বৃহৎ নারীবান্ধব কারখানা গড়ে উঠেছে রংপুরের রবার্টসনগঞ্জে। প্রায় ৮ লাখ বর্গফুটের বিশাল এক কারখানা। সাততলা ভবন। দিনে-রাতে দুই শিফটে এখানে কাজ করেন প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক। আর এদের ৮০ ভাগ শ্রমিকই নারী। এ কারখানার প্রধান উদ্যোক্তা সফিকুল আলম সেলিম। এ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের আরও ৭টি কারখানা রয়েছে কুড়িগ্রামের উলিপুর, রংপুরের পীরগাছা, লাহিড়ীরহাট, পদাগঞ্জ ও রীরচরণ গ্রামে। সব মিলে এসব কারখানায় এখন পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কাজ করেন ২০ হাজার শ্রমিক। এদের মধ্যে ১৭ হাজার শ্রমিকই নারী।
নব্বইয়ের দশকে হাতেগোনা কয়েকজন পুরোনো কারিগরকে সংগঠিত করে নতুন করে যাত্রা শুরু হয় রংপুরের শতরঞ্জির। আজ সেই পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের ৭২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। যা এখন অবিশ্বাস্য মনে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে হস্তশিল্প রপ্তানি বাণিজ্যে শিল্প খাতে ৮০ শতাংশ রপ্তানি করে থাকে কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড থেকে। তাই একটানা ১২ বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া জাতীয় রপ্তানি ট্রফির স্বর্ণপদক পেয়ে আসছে।
শতরঞ্জি তৈরির জন্য মূলত কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হয় সুতা, পাট, উলজাতীয় সুতাসহ তন্তুজাতীয় পণ্যের আঁশ থেকে প্রস্তুতকৃত সুতা। এসব দিয়ে মেঝেতে বিছিয়ে নকশা অনুযায়ী বা তাঁতে এর বুনন করা হয়। মোগল সম্রাটের আমলে এর গোড়াপত্তন হয় রংপুরে। মোগল শাসন আমলে মোগল সম্রাটের বা রাজরাজড়ার দরবারে শতরঞ্জির ব্যবহারের প্রচলন ছিল। রাজাদের দরবারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আসরে, রংমহলে গানের আসরে এমনকি দাবা খেলার জন্য এ শতরঞ্জির আসন পাতা ছিল ঐতিহ্যের প্রতীক।
রংপুরের নিসবেতগঞ্জের শতরঞ্জির কারিগর সুলতানা বেগম (৩৫), মেনোকা খাতুন (৪০), আসুরা বেগম (৩৬) এ রকম আরও প্রায় দেড় শতাধিক নারী শ্র্রমিক কাজ করেন সেখানে অবস্থিত চারুসী, রংপুর হেন্ডিক্রাপ্ট, শতরঞ্জি পল্লি লিমিটেড, সপ্তবর্ণা শতরঞ্জি কারখানায়। এ ছাড়া বাড়িতে বসেও কাজ করেন অনেকেই।
মেনোকা খাতুন জানান, তিনি এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানালেন সুলতানা বেগম ও আসুরা বেগম। তাদের আভাবের সংসারে এখন কিছুটা সচ্ছলতা ফিরেছে শতরঞ্জি কারাখানায় কাজ করে। তিনি জানান অনেকেই তাদের গ্রামে নিজ নিজ বাড়িতে বসে শতরঞ্জি তৈরি করে নিজেদের পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন।
কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড কারখানায় কাজ করেন নারী শ্রমিক সুর্বণা বেগম (৩২)। তিনি থাকেন কারখানার পাশে গড়ে ওঠা মেসে। বাড়ি লালমনিরহাট জেলার ভোটমারী গ্রামে। তার সঙ্গে সেখানে ৫টি মেসে আরও থাকেন আঁখি মনি (২৫), মর্জিনা খাতুন (২২), মোসলেমা বেগমসহ (২৮) প্রায় ৫০ জন নারী শ্রমিক। তারা জানান, কোথাও কোনো কাজের সন্ধান না পেয়ে তারা এখন সেখানে কাজ করছেন। পরিবেশ বেশ ভালো। তাদের ভাষায় এ কারখানা নারীবান্ধব কারখানা। সেখানে প্রায় ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক কাজ করেন। দিনে রাতে কারখানা চালু থাকে। কাজের পরিবেশ নিরাপদ। তারা মূলত সবাই শতরঞ্জি তৈরির কাজ করেন। কেউ তাঁতে শতরঞ্জির বুননের, কেউ সুতা রং করা, নকশা করা, সুতা পুঁটলি বাঁধা, চরকায় সুতা গোছানো, কাটিং করা, প্যাকেটজাত করা, লেবেল লাগানোসহ প্রায় সব কাজই করেন নারী শ্রমিকরা।
মর্জিনা খাতুন (২২) তার জীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আর্থিক সংকটের কারণে লেখাপড়া শিখতে পারিনি। বাবা দিনমজুরি করে আমাদের সংসারে ৫ ভাইবোনের খরচ জোগাতে পারেননি। তাই লেখাপড়া বেশি দূর করা হয়নি। এক সময় জানলাম কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড কারখানায় নারী শ্রমিকদের জন্য লেখাপড়া বেশি লাগে না। তারা শুধু কাজের জন্য সক্ষমতা আছে কিনা সে যোগ্যতা থাকলেই কাজ দেন। আমি সে কথা শুনে এখানে এসে কাজ করছি। আমার অভাব দূর হয়েছে এখন। সংসার নিয়ে ভালো আছি।’