জীবনযুদ্ধ
বড়লেখার মেয়ে : হার মানেনি যারা
আব্দুর রব
প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সফল জননী আনোয়ারা বেগম
স্বামী ছিলেন বড়লেখার তেলিমেলি গ্রামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তার সামান্য আয়ে কীভাবে ছয় সন্তানকে মানুষ করবেন-এ চিন্তায় আনোয়ারার রাত কাটত প্রায় নির্ঘুম। অভাব-অনটনের কারণে বড় দুই ছেলে ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারেনি। স্বামী প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে যাওয়ায় জীবিকার তাগিদে অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে তাকেই যেতে হতো। সেখানে মেয়েদের উচ্চপদে চাকরি, শিক্ষকতা, মানুষের সঙ্গে ভালো আচার-আচরণ দেখে স্বপ্ন দেখতেন, তার মেয়েরাও যদি লেখাপড়া করে এভাবে বড় পদে চাকরি করতে পারত তবে জীবনের সব দুঃখ ভুলে হাসতে পারতেন।
এভাবেই উদ্বুদ্ধ হলেন আনোয়ারা। ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তিনি স্বামীর পাশাপাশি যখন যে কাজ পেয়েছেন তা-ই করেছেন বিনা দ্বিধায়। আনোয়ারার দৃঢ় মনোবলের কাছে অভাব হার মানে এক সময়। তিনি ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন সমাজে। আনোয়ারার বড় ছেলে মো. আব্দুল কাইয়ুম এখন সফল ব্যবসায়ী। মেজো ছেলে আব্দুল আহাদ কাতার প্রবাসী। সেজো ছেলে আব্দুল খালেদ অনার্সসহ মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে বড় পদে বাংলাদেশ রেলওয়েতে কর্মরত। চতুর্থ সন্তান সার্ফিয়া বেগম বিএ পাশ করে স্থানীয় আজিমগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হয়েছেন। পঞ্চম সন্তান লুৎফা বেগমও বিএ পাশের পর স্থানীয় রনোচান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের চাকরি বেছে নিয়েছেন। কনিষ্ঠ সন্তান শারমিন বেগম বিসিএস ৪০তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেছেন। কঠিন পরিস্থিতির মাঝেও আনোয়ারা বেগম তার সন্তানদের মানুষ করতে জীবনযুদ্ধে যে লড়াই চালিয়ে গেছেন এবং সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন তা নারীদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করেন অনেকে। তার এ সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসাবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কারও অর্জন করেন আনোয়ারা।
মালেমহান দেবীর সাফল্যের চমক
মৌলভীবাজারের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম মালেমহান দেবীর। পিতা-মাতা ছিলেন শারীরিকভাবে অসুস্থ ও দুর্বল। মায়ের পায়ে সমস্যা আর বাবা দুর্বলতাজনিত কারণে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারতেন না। তারা ছিলেন দুই ভাইবোন। দরিদ্রতাই যাদের নিত্যসঙ্গী, লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। ছোটবেলা থেকেই তার ভেতর একজন উদ্যোক্তা হওয়ার গুণাবলি প্রকাশ পেতে থাকে। অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালীন তার বাবা সম্পূর্ণরূপে অকেজো হয়ে পড়লে সংসারের হাল ধরেন মা। তিনি রাত জেগে কাজ করতেন। মায়ের পাশাপাশি ছোট্ট মালেমহান সব ধরনের কাজে হাত লাগান। এ সময় তিনি তার মায়ের কাছ থেকে তাঁতের কাজ শিখেন। মহাজনের কাছ থেকে ছোট ছোট কাজের অর্ডার নিতেন। ছোট বলে মহাজন সব সময় কাজ দিতেন না। স্বল্প মজুরিতে কাজ করে তিনি নিজের ও ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ মেটাতেন। ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর মায়ের কানের দুল বিক্রি করে সুতা ও ভালো তাঁতযন্ত্রের ব্যবস্থা করেন। এরপর নতুন ডিজাইনের ওড়না বানিয়ে প্রচুর সাড়া পান মালেমহান। একই বছর তিনি একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দুটি তাঁত মেশিন কেনেন। এখান থেকেই তার ঘুরে দাঁড়ানোর যাত্রা শুরু। আশপাশে প্রচুর চাহিদা থাকায় তিনি ওড়না নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে থাকেন। পাশাপাশি তিনি ডিগ্রি পরীক্ষা দেন ও পাশ করেন। তিনি নিজের তৈরি কাপড় ছাড়াও পাশের গ্রাম থেকে কাপড় সংগ্রহ করে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি শুরু করেন। তার রোজগারের টাকায় কাঁচা ঘর ভেঙে দালান বাড়ি ওঠে এক সময়। বাড়িতে টিউবওয়েল ব্যবস্থা করেন। ক্রয় করেন আবাদি জমি। ছোট ভাইকে সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ভর্তি করেন। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি তিনি ২০ জন তাঁতিকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন। মালেমহান ‘কাঞ্চনকন্যা’ নামে এখন এলাকার এক পরিচিত মুখ।
সাহসী নারী শিল্পী বেগম
দূরদর্শিতা, আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও সঠিক পরিকল্পনায় এগিয়ে চললে যে কোনো বড় বিপর্যয়ও বাধা হতে পারে না। এমন ধারণা নিয়ে সামনে এগিয়ে চলা জীবনযুদ্ধে সফল একজন নারী শিল্পী বেগম। দরিদ্রতা তার চলার পথকে করে কণ্টকময়। শিল্পী বেগমের বয়স যখন তিন মাস, তখন তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। শিল্পী বেগমের মা তাকে নিয়ে নানাবাড়ি এসে আশ্রয় নেন। নানার পরিবারেও ছিল না সচ্ছলতা। নানা শিল্পীর মাকে অন্যত্র বিয়ে দেন। ছোট্ট শিল্পীর জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। নানি তাকে লালনপালন করতে থাকেন। তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। অভাবের কারণে নানা-নানি ছোটবেলায়ই তাকে মানুষের বাসায় কাজে পাঠাতেন। কিন্তু অদম্য শিল্পী বেগম গোপনে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। একটু বড় হলে তার নানা পাশের গ্রামের এক ব্যক্তির সঙ্গে শিল্পীর বিয়ে দেন। সে প্রায়ই শিল্পীকে মারধর করত, নির্যাতন করত। স্বামীর নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতেন। এ সময় তার গর্ভে এক পুত্রসন্তান আসে। স্বামী তাকে এ সময় তালাক দিয়ে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে চলে যায়। ছোট্ট একটি সন্তান নিয়ে সম্পূর্ণরূপে সহায়-সম্বলহীন অসহায় জীবন শুরু করেন শিল্পী। এমন পরিস্থিতিতেও তিনি ভেঙে পড়েননি। দৃঢ় মনোবল নিয়ে শক্ত হাতে সবকিছু সামলে সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টা চালান। নেন সেলাই প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সেলাই কাজ করে কোনো রকমে ছেলেকে নিয়ে সংসার চালাতে থাকেন। এ সময় তিনি বিয়ানীবাজারের স্থানীয় এক সমবায় অফিসে বিপণন কর্মকর্তা পদে কাজ পান। এখানে কাজ করে তিনি স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন। তার উপার্জিত জমানো টাকায় ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছেন। বর্তমানে তিনি একজন সুখী ও স্বাবলম্বী নারী। জীবনের সব গ্লানি, কালিমা, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে তিনি স্বমহিমায় সামনে এগিয়ে চলেছেন। কোনো বাধাই তাকে রুখতে পারেনি। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা শিল্পী বেগম এখন স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে অবহেলিত নারী সমাজের প্রতীক।