Logo
Logo
×

সুরঞ্জনা

পাহাড়ে ম্রো সম্প্রদায়ের প্রথম নারী চিকিৎসক সংচাং ম্রো

Icon

জয়দেব রানা

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পাহাড়ে ম্রো সম্প্রদায়ের প্রথম নারী চিকিৎসক সংচাং ম্রো

সংচাং ম্রো

অদম্য ইচ্ছা থাকলে স্বপ্নপূরণে কোনো কিছু বাধা হতে পারে না। সেটিই যেন এবার সত্যি করে দেখালেন বান্দরবানের ১১ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসাবে বিবেচিত ম্রো জনগোষ্ঠীর কন্যা সংচাং ম্রো। পিছিয়ে পড়া ম্রো জনগোষ্ঠীর মধ্যে আশার আলো দেখাচ্ছেন এ নারী। বান্দরবানের আলীকদমের দুর্গম পাহাড় থেকে উঠে আসা সংচাং ম্রো প্রথম নারী ডাক্তার। ইচ্ছাশক্তি, কঠোর অধ্যবসায় এবং পরিবারের অনুপ্রেরণায় আজ সংচাং ম্রো পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অনুপ্রেরণার এক নাম। ম্রো সম্প্রদায়ের প্রথম নারী ডাক্তার।

সংচাং ম্রো-এর ডাক্তার হওয়ার রাস্তা ছিল সাঁতরে নদী পার হওয়ার মতো। তার শৈশব কেটেছে অভাব ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে। দুর্গম এলাকায় স্কুল থাকলেও শিক্ষক না থাকায় লেখাপড়া করার সুযোগ ছিল না। সংচাং ম্রোর প্রথম শেখা বাবার হাত ধরে। কখনো আঙুলের সাহায্যে ধুলামাটিতে, কখনো গাছের পাতায় বর্ণ লেখার মধ্য দিয়ে। এভাবে গাছের পাতা, মাটি সবটাই যেন সংচাংয়ের লেখার ব্ল্যাকবোর্ড। এভাবে ধীরে ধীরে পাহাড়ের প্রথম ম্রো ডাক্তার হিসাবে অসংখ্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অনুপ্রেরণার এক নাম হয়ে উঠেছে সংচাং।

সংচাং ম্রো-এর ডাক্তার হওয়ার পেছনে অনুপ্রেরণায় ছিলেন তার বাবা কাইংপ্রে ম্রো। পাঁচ সন্তান নিয়ে অভাব-অনটনের সংসার কাইংপ্রে ম্রোর। জুমচাষ ছিল তার বাবার আয়ের অন্যতম মাধ্যম। জুমের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে চলত অভাব-অনটনের সংসার। সন্তানদের পড়াশোনা যেন ছিল বিলাসিতা তৎকালীন পাহাড়ে। পড়াশোনার জন্য আসতে হতো নদী ও পাহাড় পাড়ি দিয়ে ৫-৬ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে সদরে। সদরে থাকা ছিল বড় যুদ্ধ। এরই মধ্যে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মেজো বোন চিকিৎসার অভাবে মারা যান। এ বিষয়টি সংচাংয়ের বাবার মনে গভীর দাগ কাটে। পণ করলেন শত কষ্ট হলেও সন্তানদের শিক্ষিত করবেন। তার অল্প আয়ে পাঁচ সন্তানের শিক্ষার ভার তুলে নেন নিজের কাঁধে। এর জন্য কম কথা শুনতে হয়নি পরিচিতজনদের কাছেও। তবু তিনি অনড় ছিলেন তার সিদ্ধান্তে। সংচাংয়ের বাবার সব কাজে সমর্থন ছিল তার মায়ের। সন্তানদের ভর্তি করিয়ে দেন স্কুলে। সংচাংকে ভর্তি করিয়ে দেন আলীকদমের পার্শ্ববর্তী উপজেলা লামা মিশন নামের একটি হোস্টেলে। এক বছর পর সেই হোস্টেল বন্ধ হয়ে গেলে সংচাংকে ফাদার লুপি (যার হাত ধরে অসংখ্য পিছিয়ে পড়া মানুষ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন) তার পরিচালিত তৈদাং হোস্টেলে ভর্তি করিয়ে দেন। তৈদাং হোস্টেলে থেকে চম্পট প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আলীকদম সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন সংচাং। অষ্টম শ্রেণি পাশের পর ভর্তি হন সাভারের সেন্ট জোসেফ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেন্ট জোসেফ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাশ করেন। এরপর হলিক্রসে ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করলেও পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে আবারও সেন্ট জোসেফ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল নমিতা সিস্টার তার কলেজে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সুযোগ করে দেন।

সংচাং বলেন, ‘বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি বাবা আমাদের পড়াশোনা করাচ্ছেন, যাতে বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে জানতে পারি। কিন্তু বাবা তখনো জানতেন না, ডাক্তারি পড়তে হলে সায়েন্স পড়তে হবে। আর্থিক সংকটের কারণে কলেজের প্রিন্সিপাল নমিতা সিস্টার বিনামূল্যে পড়াশোনার সুযোগ করে দেন আমাকে।’ এভাবে প্রিন্সিপাল ও শিক্ষকদের সহায়তায় চলতে থাকে সংচাংয়ের উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনা। সংচাং উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন এক সময়। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিলেন না ঠিক কী করবেন। তখন বাবার কাছে জানতে চাইলেন। সংচাং বলেন, ‘তখন বাবা আমাকে বাড়িতে ফিরে আসার কথা বলেন। এসে কোনো একটা চাকরি খোঁজার কথাও বলেন। বাবার ধারণা ছিল, উচ্চমাধ্যমিক শেষ হলেই চাকরি পাওয়া যায়। এটাই জীবন। উচ্চমাধ্যমিকে থাকাকালীন টিউশনি করাতাম। সে টাকা দিয়ে থাকার বন্দোবস্ত করলেও বিপাকে পড়তে হয় কোচিং করার টাকা নিয়ে। সে মুহূর্তে আমার বড় বোন সুইসং ম্রো এগিয়ে এসে নিজের জমানো টাকা তুলে দেন আমার হাতে। এরপর নিজেকে দিনরাত এক করে প্রস্তুত করি ভর্তি পরীক্ষার জন্য। মেডিকেলের ফরম পূরণের আগেই আক্রান্ত হই চিকুনগুনিয়ায়। আমাকে সাহায্য করার জন্য কেউ ছিল না। পরীক্ষার তিন দিন আগে বাবার চোখের অপারেশন। পরিবারের সবাই বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত। বাবার অসুস্থতা আরও বেশি অস্থির করে তোলে আমাকে। কঠিন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। নিজেকে খুবই অসহায় মনে হচ্ছিল তখন। ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্র চিনতাম না। এক বড় ভাইয়ের সহায়তায় নিয়েছি। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলে জানতে পারি মেডিকেলে উত্তীর্ণ হয়েছি। সুযোগ পাই রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে পড়ার। তখন মনে হচ্ছিল, পুরো পৃথিবীটা আমি জয় করে ফেলেছি। ফলাফলের খবর বাবাকে জানালে খুবই খুশি হন বাবা।’

এরপর অনেক কষ্টে সংচাং মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এক মাস কেটে যায় বই ছাড়া। কাউকে পেলেন না ভাগাভাগি করে কেনার মতো। এক সিনিয়র ভাই তার প্রথম সেমিস্টারে বইগুলো তুলে দেন সংচাংয়ের হাতে। আরেক দুই ব্যাচ সিনিয়র ভাই তার কেনা কঙ্কালটি দিয়ে যান সংচাংকে। এগুলো কিনতে অনেক টাকা লাগত, যা তার ছিল না। তিনি বলেন, ‘এটি ঈশ্বরের আশীর্বাদ, ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া এটি সম্ভব নয়।’

পড়াশোনা শেষে সংচাং বর্তমানে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে ইন্টার্ন ডাক্তার হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন, নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের সেবা করার। তারা নিজের রোগ সম্পর্কে বোঝাতে পারে না। ডাক্তারও ঠিকমতো তাদের কথা বোঝে না। সংচাং দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘পাহাড়ের মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতে চাই, যাতে কেউ চিকিৎসার অভাবে মারা না যায়। এতটুকু আসার পেছনে আমার পরিবারের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি; বিশেষ করে আমার বাবা-মা। ম্রো জনগোষ্ঠীতে তিন ডাক্তার হলেও নারী ডাক্তার আমিই প্রথম।’ সংচাং ছাড়া পরিবারে তার বড় ভাই ও এক বোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এক ভাই এনজিও কর্মী। আলীকদম ম্রো কল্যাণ ছাত্রাবাসের পরিচালক ও ম্রো সম্প্রদায়ের নেতা ইয়ং লক ম্রো বলেন, ‘প্রথম নারী ডাক্তার সংচাং। পিছিয়ে পড়া দুর্গম এলাকার লোকজনকে আধুনিক চিকিৎসাসেবা দিতে ম্রো নারীদের প্রথম ডাক্তার সংচাং ম্রো অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন। তাকে অনুসরণ করবে পাহাড়ের ম্রো সমাজ। পার্বত্য চট্টগ্রামে আলীকদমকে ম্রোদের রাজধানী বলা হলেও অধিকাংশ ম্রোয়ের বসবাস দুর্গমে। সেখানে শিক্ষার প্রসার এখনো পরিপূর্ণ ঘটেনি। শিক্ষার প্রসার ঘটলে আরও সংচাং তৈরি হতো।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম