যাই তবু এগিয়ে
সাহিত্যে নোবেলজয়ী হান কাংয়ের পৃথিবী
সুমন্ত গুপ্ত
প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাহিত্যে নোবেলজয়ী হান কাং। ছবি: সংগৃহীত
জীবন যেন কখনো কখনো চমকে দেয়। হান কাংয়ের জীবনেও এলো সেই চমকে দেওয়া সময়। ২০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার এ লেখক। নিজের সৃষ্টিকর্মে চমকে দিয়েছেন গোটা দুনিয়া। গত ১০ অক্টোবর বুধবার সুইডেনের স্টকহোম থেকে এ বছরের সাহিত্যে নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণা করে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি। হান কাংয়ের লেখায় মানবজীবনের দুঃখ-কষ্টের নানা দিক ও ইতিহাসের সঙ্গে এর সম্পর্ক প্রকাশ পেয়েছে। ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন ও অনুভূতিগুলোকে খুব তীক্ষ্ণ ও কাব্যিকভাবে বর্ণনা করেছেন তিনি। হান কাং হলেন এশিয়ার প্রথম নারী লেখক, যিনি নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। এ স্বীকৃতির মূলে রয়েছে, তার স্বকীয় গভীর ক্ষুরধার ও কাব্যময় গদ্য। যা ইতিহাসের যন্ত্রণাদগ্ধ ঘটনাকে উপজীব্য করে মানব জীবনের ভঙ্গুরতাকে উন্মোচিত করে। আলোর পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে জীবনের নানা উত্থান-পতন, দুঃখ-বেদনার অনুভূতি, ঐতিহাসিক ট্রমা, অদৃশ্য অনুশাসন। তার নিরীক্ষাধর্মী ও কাব্যময় লিখনশৈলী গদ্য সাহিত্যের ভান্ডারে এক অভূতপূর্ব ব্যতিক্রমী সংযোজন, যা তাকে সাফল্যের স্বর্ণ দুয়ারে পৌঁছে দেয়। কোরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গোয়াংজুতে ১৯৭০ সালে জন্ম নেন হান কাং। বাবা হান সুং-ওনও ছিলেন সাহিত্যিক। ফলে বেড়ে ওঠা সাহিত্যিক পরিবেশে। লেখক হিসাবে ততটা সফল ছিলেন না হান সুং-ওন। শৈশব থেকেই বাবাকে আর্থিকভাবে সংগ্রাম করতে দেখেছেন হান। তবে এ নিয়ে দুঃখ থাকলেও ঘরভর্তি বই সে দুঃখে অনেকটাই প্রলেপ দিয়েছিল। হানের বয়স যখন নয় বছর, গুয়াজু ছেড়ে সিউলে চলে আসে তার পরিবার। এর কিছুদিন পর গুয়াজুতে গণতন্ত্রপন্থি ছাত্রজনতার মিছিলে গুলি ছোড়ে সেনারা, মারা যান কয়েকশ মানুষ। ঘটনাটি হানের মনে গভীরভাবে ছাপ ফেলে। লেখক পরিবারে আশৈশব লালিত হওয়ার সুবাদে সঙ্গত কারণেই পারিবারিক আবহের মাঝেই তার মধ্যে এক সৃষ্টিশীল লেখক সত্তা অঙ্কুরিত ও বিকশিত হয়, যা তাকে সাহিত্যিক হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। কোরীয় সাহিত্য নিয়ে ইয়োনসেই ভার্সিটি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হান কাংয়ের সাহিত্যিক হিসাবে প্রথম অভিষেক ঘটে ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ কোরিয় সাময়িকী ‘লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটি’তে ৫টি গুচ্ছ কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে। এরপর ১৯৯৪ সালে তিনি ‘রেড অ্যাঙ্কর’ নামে একটি ছোট গল্পের মাধ্যমে ডেইলি সিউল শিনম্যান সাহিত্য প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার বিজয়ী হয়ে সবার নজর কাড়েন। ১৯৯৫ সালে কারলেকেন টু ইয়েসু (ইয়েসুর প্রেম) নামে তার একটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়। এটি প্রকাশের পর পরই তিনি জিতে নেন হ্যানকুক সেরা লিখিয়ে পুরস্কার। মূলত এটির মাধ্যমে তার গদ্য একত্রিত অবস্থায় প্রথম পাঠকের সামনে আসে। পরে তিনি উপন্যাস লেখায় হাত দেন এবং বছর তিনেকের মধ্যে লিখে ফেলেন জীবনের প্রথম উপন্যাস ব্ল্যাক ডিয়ার। ১৯৯৮ সালে এটি প্রকাশিত হলে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লক্ষ করে তিনি নিজেকে লেখালেখিতে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন এবং গল্প, গদ্য নোবেল-নোবেলা লেখায় মনোযোগী হন। এরপর একে একে বেরোতে থাকে তার অসাধারণ সব সৃষ্টিকর্ম। হান কাংয়ের এ পর্যন্ত ৮টি উপন্যাস, ৫টি উপন্যাসিকা, ১টি কাব্যগ্রন্থ ও ২টি প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। খুব বেশি না লিখেও দক্ষিণ কোরিয়ার নোবেলজয়ী এ কথাশিল্পী আখ্যান রচনায় অনন্য আর নিজস্ব শৈলী সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছেন। দ্য কনভারসেশনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে হান কাং যে কথা বলেন, সেটি হয়তো তার লেখালেখির মূল মন্ত্র। কাংয়ের কথা হলো, মূলত তার উপন্যাস মানব জীবনের যন্ত্রণা আর বেদনা নিয়ে লেখা। মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিক বর্বর আচরণ, অসহনীয় নির্মমতা তাকে খুবই পীড়া দেয়। হান কাং পুরস্কারস্বরূপ পেয়েছেন কোরিয়ান উপন্যাস পুরস্কার (১৯৯৯), কোরিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক টুডেস ইয়াং আর্টিস্ট পুরস্কার (২০০০), ইয়িসাং সাহিত্য পুরস্কার (২০০৫), ডংরি সাহিত্য পুরস্কার (২০১০), মানহাই সাহিত্য পুরস্কার (২০১৪), ওয়ান স্নোফ্লেক মেল্টস উপন্যাসের জন্য হোয়াং সান-জিত সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫), দ্য ভেজিটেরিয়ান ম্যান বুকার ইন্টারনেশনাল প্রাইজ (২০১৬), ইতালির মালাপার্ট পুরস্কার (২০১৭), কিম ইউজুং সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), সান ক্লেমেট পুরস্কার (২০১৯), মেডিসিস পুরস্কার (২০২৩), এমাইল গুইমেট পুরস্কার (২০২৪) এবং সর্বশেষ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে (২০২৪) ভূষিত হন।