Logo
Logo
×

সুরঞ্জনা

কন্যাশিশু : পরিবারের আলো

৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। ‘কন্যাশিশুর স্বপ্নে গড়ি আগামীর বাংলাদেশ’

Icon

রুকাইয়া সাওম লীনা

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আবহমান কাল থেকে কন্যাশিশু বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। এ বৈষম্যের শুরু যেন মাতৃগর্ভ থেকেই। জন্মের পর মৃত্যু পর্যন্ত এ বৈষম্যের বাধা পেরিয়েই তাকে কাটাতে হয় এক জীবন। সমাজ বদলেছে, সভ্যতা বদলেছে, বদলেছে পৃথিবী। মানুষ আরও আধুনিক হয়েছে; কিন্তু চিন্তা-চেতনায় কতটা আধুনিক বা মুক্তচিন্তার অধিকারী হতে পেরেছে মানুষ, তা এক বিরাট প্রশ্ন। যেখানে পৃথিবীতে নিজের যোগ্যতায় কন্যাশিশু সর্বত্র আলো ছড়াচ্ছে, সেখানে কন্যাশিশুর প্রতি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা আসলে কতটুকু বদলেছে! ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। আসুন, এ নিয়ে আমাদের সমাজের কিছু চিত্র দেখি।

কেস স্টাডি এক

রুনু পেশায় একজন শিক্ষিক! প্রথম সন্তান কন্যাশিশু হওয়ায় তিনি খুব দুঃখ পেলেন! কিন্তু যখন দ্বিতীয় কন্যাসন্তান হলো, তখন তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না! জন্মের পর ছয় দিন তিনি কন্যাশিশুটিকে কোলেও নিলেন না, তার মুখও দেখলেন না! কন্যাশিশুটি পৃথিবীর আলো দেখল বটে, কিন্তু স্বয়ং মায়ের মমতার আলোয় আলোকিত হতে পারল না!

কেস স্টাডি দুই

গল্পটি সোহানীর বা তার কন্যার তিতলিরও বলা যেতে পারে। তিতলি যখন ভূমিষ্ঠ হলো পৃথিবীতে, হাসপাতালে মায়ের পাশে ছিল তার নানা-নানু। তার বাবাকে যখন জানানো হলো তার আগমন বার্তা, বাবা এলেন না সন্তানকে দেখতে। আর তাকে জন্ম দেওয়ার অপরাধে তার মা পেল সাতদিন পর ডিভোর্স লেটার!

কেস স্টাডি তিন

স্বামী, শাশুড়ি, দেবরের চাপে বারবার গর্ভপাত করানো হয় নিরাকে। কারণ কন্যাশিশু চায় না পরিবার। শেষবার ডাক্তার জানান, দুই-তিন বছরের মধ্যে আপনার আর গর্ভধারণের সম্ভাবনা নেই। নিরা খুব হতাশ হলেন। বছরখানেকের মধ্যে যখন আবার গর্ভধারণ করলেন, খুশিতে তখন আত্মহারা নিরা। আবারও বাদসাধলেন তার শাশুড়ি ও দেবর। এবার নিরা গর্ভপাত করতে রাজি হলো না। তখন তার ওপর শুরু হলো মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। রাতদিন বলতে লাগলেন, ‘তোমার তো মেয়ে হবে। কালো হবে, মোটা হবে, বিয়ে দিতে পারবে না।’ যদিও এবার তার ছেলেই হয়েছিল। মেয়ে হবে শুধু এ কারণে নিরার প্রতি তার শ্বশুরবাড়ির মানসিক অত্যাচার ছিল অকল্পনীয়।

কন্যাশিশু নিয়ে এমন চিত্র পরিবার ও সমাজ থেকে শুরু হয়। কন্যাশিশুকে পরিবারের বোঝা মনে করা হয় অনেক পরিবারে। কন্যাশিশুকে পরিবারের ওয়ারিশ বা অংশীদারই ভাবা হয় না!

উল্লেখ্য, প্রতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশে যাতে নারীরা ভেদাভেদ বা বৈষম্যের শিকার না হন, সেদিকে লক্ষ রেখে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০০ সালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কন্যাশিশু দিবস পালনের আদেশ জারি করে। আদেশে বলা হয়, শিশু অধিকার সপ্তাহের (২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর) মধ্যে একটি দিন অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর কন্যাশিশু দিবস হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২৪ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘কন্যাশিশুর স্বপ্নে গড়ি আগামীর বাংলাদেশ’।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোয় ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছরের ১১ অক্টোবর পালিত হয় আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। এদিকে প্রতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শিশু সপ্তাহ পালন করা হয়। এ শিশু সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে পালন করা হয় জাতীয় কন্যাশিশু দিবস।

তবু আশা রাখি একদিন মানুষের বোধোদয় হবে: ডা. ফওজিয়া মোসলেম

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘জাতিসংঘের শিশু সনদ আইন আমরা বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছি। সেখানে কন্যাশিশু বা পুত্রশিশুকে আলাদা করে দেখা হয়নি। সব শিশুর জন্যই সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। সব শিশুই যেন তার অধিকারগুলো পায় তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। তারপরও কন্যাশিশু যে তার সব অধিকার ভোগ করতে পারছে এ কথা বলা যাবে না। শিশুর জেন্ডার শনাক্তকরণের পরবর্তী ধাপে শিশুর প্রতি ব্যবহার পরিবর্তিত হয়ে যায়। যদিও সেটা হওয়ার কথা নয়। সেটা আমাদের চাওয়া নয়। আমরা চাই, প্রতিটি শিশু সে কন্যাশিশু হোক বা পুত্রশিশু হোক, তার অধিকার সমভাবে নিশ্চিত করতে হবে। সমান ব্যবহার করতে হবে সবার সঙ্গে। কন্যাশিশুর বেলায় আরও তিনটি অধিকারের কথা আমি বলব, যা নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজন। এক. বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করা, দুই. বাল্যবিয়ে রোধ করা, তিন. কন্যাশিশুর ওপর সহিংসতা প্রতিরোধ করা। এগুলো পরিবার থেকে নিশ্চিত করতে হবে। তারপর সমাজ-রাষ্ট্র থেকেও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিবারেও কন্যাশিশু নিরাপদ নয়, সে বিভিন্ন সহিংসতার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করে। বাড়িতে একজন অতিথির আগমনকে আমরা যেভাবে স্বাগত জানাই, পুত্রসন্তান হলে আমরা যেভাবে নতুন শিশুটিকে স্বাগত জানাই, কন্যাশিশুকেও পরিবারের স্বাগত জানাতে হবে। উত্তরাধিকারী হিসাবে তাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তবেই কন্যাশিশুর জন্য আমরা একটি সুন্দর পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র দিতে পারব। ওপরের ঘটনাগুলো জেনে আমার একটি ঘটনা মনে পড়ল। ঘটনাটি ১৯৬৭ বা ৭০-এর আগের। আমার মেজ জা-এর সন্তান প্রসবের সময় আমার নোনাশ সে ঘরে উপস্থিত ছিলেন। আমার জা কন্যাসন্তান প্রসব করেছেন, এটি দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার নোনাশ কামরা থেকে মন খারাপ করে বের হয়ে এলেন। এ থেকে বোঝা যায়, ২০২৪ সালে এসেও কন্যাশিশু সম্পর্কে আসলে আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এসব দেখে আমি একটা কথা ভেবে পাই না, কন্যাশিশুকে যদি এভাবে দেখা হয়, তাহলে পৃথিবীতে কন্যাসন্তান ছাড়া পুত্রসন্তানই বা কীভাবে জন্মগ্রহণ করবে? তাতে বা আমাদের প্রকৃতির এ জীবনচক্রই বা কীভাবে চলবে? তবু আশা রাখি, একদিন মানুষের বোধোদয় হবে। ঘরে ঘরে সবাই কন্যাশিশুকে স্বাগত জানাবে।’

আমি তো বলি আমি নারী, সারা পৃথিবী আমার যুদ্ধক্ষেত্র: গীতা দাস

নারীপক্ষের সভানেত্রী গীতা দাস বলেন, ‘আমি তো বলি; আমি নারী, সারা পৃথিবী আমার যুদ্ধক্ষেত্র। তাই যখন কন্যাশিশুর কথা আসে, তখন বলতেই হয় আমাদের দেশসহ উপমহাদেশের কোনো দেশেই কন্যাশিশু তাদের সত্যিকারের অধিকার পায় না বা ভোগ করতে পারে না। যদিও আমরা আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছি, তবুও এখনো বেশিরভাগ পরিবারেই শিশু জন্মের পর দেখা হয় সেটি ছেলে শিশু নাকি কন্যাশিশু; সে হিসাবে তাদের আলাদাভাবে ট্রিট করা হয়। জন্মের পর খুব কম কন্যাসন্তানের ভাগ্যেই পরিবারের স্বাগতম জোটে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় অনাড়ম্বর। অন্যদিকে কন্যাশিশুর জন্য পরিবেশ পরিস্থিতি অতটা নিরাপদ নয়, যা আমরা প্রতিদিনের সংবাদপত্র বা খবরে দেখতে পাই! কোনটা পুত্রশিশু বা কন্যাশিশু, সন্তান মাত্রই সন্তান, পুত্র হোক বা কন্যা হোক, সবার জন্য আমাদের আয়োজন সমান হবে, সেটাই কাম্য। পুত্রসন্তান জন্মের মধ্য দিয়ে যেমন সম্পত্তিতে তার অধিকার জন্মায়, ঠিক একই রকমভাবে কন্যাসন্তান জন্মের পরও যদি সম্পত্তিতে অধিকার নিশ্চিত হয়, তবেই পুত্র-কন্যাসন্তানের বিভেদ ঘুচে যাবে। তারা সমঅধিকার নিয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বড় হবে। সম্পত্তিতে অধিকারের অনিশ্চয়তার জন্য কন্যাশিশু ও তার মাকে কী পরিমাণ মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক চাপে থাকতে হয়, তার একটি ছোট্ট উদাহরণ দিই। তখন আমি নরসিংদীতে থাকি। একদিন জানলাম পাড়ায় একজন মারা গেছেন। কীভাবে মারা গেছেন এটি জানতে গিয়ে জানলাম, সনাতনধর্মাবলম্বী নারীটি তার সপ্তম কন্যাশিশুর জন্ম দেওয়ার খবর শোনে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেছেন! আসলে আমরা জ্ঞানবিজ্ঞান বা প্রযুক্তিতে যতটা আধুনিক হতে পেরেছি, চিন্তা-চেতনায় এখনো ততটা হতে পারিনি।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম