Logo
Logo
×

সুরঞ্জনা

নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ সনদ দিবস

বৈষম্য কমেছে কতটুকু?

Icon

লীনা দিলরুবা শারমিন

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আজকাল অধিকাংশ চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে ‘ওমেন আর এনকারেজড টু অ্যাপ্লাই’ লেখা একটি সুন্দর অভ্যাস হয়ে উঠেছে। এ কথার পেছনে আধুনিক চিন্তার প্রকাশ ও নারীর অবকাঠামোগত উন্নয়নের উদ্দেশ্য অবশ্যই থাকে, কিন্তু তাতে কতটুকু সামগ্রিক চিন্তা প্রতিফলিত হয়, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আপনি যদি ছয় মাসের গর্ভবতী নারীকে চাকরি পরীক্ষা দিতে দেখেন এবং একমাত্র তার মেধা বা যোগ্যতার ভিত্তিতে বিচার করে তাকে মূল্যায়ন করতে পারেন, শুধু সে ক্ষেত্রেই সাম্য চর্চা করা হবে।

নারীর প্রতি একটি বড় ধরনের বৈষম্য হচ্ছে অর্থনৈতিক ও আইনি অধিকারের বৈষম্য। বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী পৈতৃক সম্পত্তির অংশ কাগজে-কলমে তো দূরে থাক, স্বাভাবিক ভোগদখলেও পান না। বাবা, স্বামী, সন্তান নানা স্তরে তিনি অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকেন এবং বলাইবাহুল্য, তার এক জীবনে নিজের সহজ প্রয়োজন ও শখের জন্যও অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকাকে নিয়তি বলে মেনে নেন। অথচ, তার বাবার সম্পদ ও স্বামীর সম্পদে তার যে অধিকার আছে, সেটি তাকে না বুঝিয়ে দেওয়া হয়, না বুঝে নেওয়ার মতো আইনি অভিজ্ঞতা, না সেই জ্ঞান বা সাহস থাকে। আমার যে অঞ্চলে বাড়ি, সেখানে মেয়েরা বাবার সম্পত্তি নিলে সেটিকে খুব নিচু স্তরের কাজ হিসাবে দেখা হয়।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে-এ অঞ্চলে মেয়েরা যদি জানেও বাবার সম্পত্তি সম্পর্কে, স্বামীর সম্পত্তি সম্পর্কে তাদের একেবারেই ধারণা থাকে না। তাই, এ স্বামীর মৃত্যুতে মালিকানা বদলের কথা শোনা ছাড়া কিছুই আর পরিবর্তিত হয় না। সম্পদ ছেলেদের মধ্যে ভাগ হয়। না তার মধ্যে মায়ের অধিকার থাকে, না বোনের। স্ত্রীর কথা তো একই চক্রে বাদ। প্রতিদিনের দুমুঠো ভাত থেকে শুরু করে এই যে ক্রমাগত চলতে থাকা বৈষম্য তাতে আমাদের দেশ, উপমহাদেশ এমনকি বিশ্বজুড়ে মেনে এবং মানিয়ে নিতে নিতে এক সময় নারীরা এটাকেই বাস্তবতা এবং জীবনের নিয়ম বলে মেনে নেন। খেয়াল করে দেখবেন, যে বাচ্চা মেয়েটি তাকে তার ভাইদের থেকে ভিন্নভাবে দেখা নিয়ে প্রশ্ন করে, এক সময় সে নিজেও এ ঘটনাকে মেনে নেয় এবং ব্যক্তিগত জীবনে একই চর্চা করে এবং সেটিকে সঠিক মনে করেই করে।

বাংলাদেশের নানা স্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য এমনভাবে মিশে আছে যে নারী নিজেও তার এ বৈষম্য সম্পর্কে জানেন না। পরিবারে মায়ের অসুখ আর বাবার অসুখের চিত্র ভিন্ন। ভাইয়ের শিক্ষা আর বোনের শিক্ষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। রাজনৈতিক, জাতীয়তা, যৌনতা, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, বিয়ে, পারিবারিক জীবন, সব ক্ষেত্রেই বৈষম্য বিরাজমান। দুঃখ হচ্ছে, একশ্রেণি তাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া বৈষম্য সম্পর্কে অজ্ঞাত, একশ্রেণি বৈষম্য সম্পর্কে জেনে কোণঠাসা, আবার একশ্রেণি বৈষম্য চর্চারত।

হাজার বছর ধরে চলতে থাকা এ বৈষম্য বিলোপের লক্ষ্যে জাতিসংঘ নানা সময় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ১৯৭৫ সালকে ‘বিশ্ব নারী বর্ষ’ হিসাবে ঘোষণা করা এবং ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণবিষয়ক সনদ Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women বা সংক্ষপে CEDAW (সিডও) বা গ্রহণ করা? শুধু নারীর অধিকারসংক্রান্ত এটিই এখন পর্যন্ত একমাত্র সনদ।

১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সনদটি কার্যকর হতে শুরু করে। আর ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ এ সনদে স্বাক্ষর করে? ইউএনডিপি প্রকাশিত নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ কনভেনশন অনুসারে এ পর্যন্ত মোট ১৬১টি দেশ এ চুক্তিপত্র বা সনদে স্বাক্ষর করেছে।

মোট ৩০টি ধারার এ সনদের প্রথম ১৬টিতে বৈষম্য চিহ্নিত করা এবং বাকি ১৪টিতে তা লোপ করার জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ সনদে বলা হয় নাগরিক অধিকার ও আইনি সমতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে নারী তার ব্যক্তিগত জীবন ও সমাজে পুরুষের সমপর্যায়ে সব সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। নারীর প্রজনন ভূমিকাকে সামাজিক ভূমিকা হিসাবে গণ্য করতে হবে যেন প্রজননের কারণে নারীকে কোণঠাসা না করা হয়। সেই সঙ্গে তার এ অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি নানা ধরনের আচার-প্রথা, সংস্কার ও বিধি যা নারীর জেন্ডার ভূমিকা নির্ধারণ করে, তা বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। পরিবার ও সমাজে শুধু মানুষ হিসাবে নারীকে গণ্য করা এবং পুরুষের ক্ষমতা ভিত্তিতে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার প্রতিই এ সনদে জোর দেওয়া হয়েছে।

এবার বাস্তবতার দিকে তাকিয়ে দেখলে কিছু উন্নয়নের পাশাপাশি অনেকখানি শুভংকরের ফাঁকিই থেকে যায়।

লেখক : জনযোগ বিশেষজ্ঞ, আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম