
প্রিন্ট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:১১ পিএম
ঈদ ভ্রমণে স্বাস্থ্য সচেতনতা

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
ঈদ ভ্রমণে স্বাস্থ্য ঝুঁকির খুঁটিনাটি জানা থাকলে ভ্রমণটি হতে পারে আনন্দময়। যাত্রাপথে, বিশেষ করে যারা দূর-দূরান্তে যান, তাদের রাস্তাঘাটে পোহাতে হয় দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনা। তারপরও বাড়ি ফেরার আনন্দে মন থাকে মাতোয়ারা। অনেকেই ভ্রমণ করেন বাস, ট্রেন অথবা লঞ্চে। সবাই চায় নির্বিঘ্নে আর নিরাপদে ঘরে ফিরতে। তবে যাওয়া-আসার ঝামেলায় অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। শিশু ও বয়স্কদের পক্ষে লম্বা যাত্রাপথের ধকল সহ্য করা কঠিন হয়। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে শরীর খারাপ হতেই পারে। তাই যাত্রাপথে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। ঈদ ভ্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়াটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
* ব্যাগ গোছান
গোছগাছের ব্যাপারটির সঙ্গে কোথায় যাওয়া হচ্ছে এবং কতদিন থাকতে হবে তার সঙ্গে জড়িত। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ বাচ্চা বা বয়স্কদের জন্য যা যা দরকার, তা সঙ্গে রাখা উচিত। যতটা সম্ভব অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাদ দেওয়া ভালো।
* গরম ও হিট স্ট্রোক
এবার ঈদ হচ্ছে গরমের মৌসুমে। ভ্রমণের সময় প্রচণ্ড গরমে হিট স্ট্রোক হতে পারে, তাই ট্রাভেল ব্যাগে পানি রাখতে হবে। শরীরে লবণশূন্যতা হতে পারে, তাই ভ্রমণ শুরুর আগে খাবার স্যালাইন সঙ্গে রাখা ভালো। ভ্রমণের সময় বাইরের খাবার এবং পানীয় কোনোভাবেই গ্রহণ করা ঠিক হবে না। গ্রামে গিয়ে রোদে অপ্রয়োজনীয় ঘোরাফেরা পরিহার করুন। প্রচণ্ড রোদে হাঁটাচলার সময় ছাতা ব্যবহার করুন।
* পরিধেয় পোশাক
ভ্রমণের সময় হালকা, আরামদায়ক ও সহজে বাতাস চলাচল করতে পারে এমন পোশাক পরা উচিত। টাইট কাপড়-চোপড় পরিহার করাই ভালো। এতে ভ্রমণ হয়ে উঠবে আরামদায়ক। নরম জুতা বা স্যান্ডেল পরা উচিত। একেবারে নতুন জুতা পরে কোথাও রওনা হবেন না, এতে পায়ে ফোস্কা পড়তে পারে। মেয়েদের হাইহিল পরিহার করে ফ্ল্যাট জুতা পরা উচিত।
* যানবাহনে সতর্কতা
জানালা দিয়ে মাথা বা হাত বের করবেন না। অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে বাস, ট্রেন বা লঞ্চে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকুন। বাস বা ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করা খুবই বিপজ্জনক, তাই ছাদে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকুন।
* খাবার নিয়ে সতর্কতা
বাইরের খাবার কোনোভাবেই গ্রহণ করা ঠিক হবে না। ঘরের তৈরি খাবার ও পানির বোতল সঙ্গে নেওয়া উচিত। প্রয়োজন অনুযায়ী বিশুদ্ধ পানি পান করুন এবং বাচ্চাদেরও পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করাবেন। ভ্রমণে খাদ্য ও পানিবাহিত রোগ-প্রতিরোধের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে।
* প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ফার্স্ট এইড বক্স
ঈদের সময় জরুরি ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রসহ ফার্স্ট এইড বক্স নেওয়া উচিত। কারণ কোনো কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক সময় ওষুধ পাওয়া যায় না। জ্বর, মাথা বা শরীর ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, পেটের পীড়ার জন্য মেট্রোনিডাজল, পেটে গ্যাস, পেটফাঁপা, বুক জ্বলার জন্য অ্যান্টাসিড, ল্যান্সোপ্রাজল বা ওমিপ্রাজল, সাধারণ সর্দি কাশির জন্য অ্যান্টি-হিস্টামিন, ডায়রিয়ার জন্য ওরাল স্যালাইন ইত্যাদি সঙ্গে রাখুন। এ ছাড়াও তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, স্যাভলন ইত্যাদি সঙ্গে রাখুন। হাত কেটে গেলে কিংবা শিশুরা খেলতে গিয়ে শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে এগুলোই সহায়ক হবে। নোটবুকে আপনার পরিচিত চিকিৎসক ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফোন নম্বর ও ঠিকানা লিখে রাখলে ভালো হয়।
* যারা দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছে
যারা বিভিন্ন রোগে ভোগেন, যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, বাতরোগ, অ্যাজমা বা অ্যালার্জি, তারা অবশ্যই ঈদ ভ্রমণে প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে নিতে ভুলবেন না। অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের রোগীরা সঙ্গে ইনহেলার রাখুন। ডায়াবেটিক রোগীরা ইনসুলিন বা ট্যাবলেট সঙ্গে রাখবেন এবং লজেন্স, সুগার কিউব সঙ্গে নেবেন। প্লেনে ভ্রমণ করলে ঘন ঘন পা ম্যাসাজ করতে হবে, না হলে পায়ে রক্ত জমাট বেঁধে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস নামক অসুখ হতে পারে। পায়ে রক্তজমা প্রতিরোধকারী মোজা পরতে পারেন। যাদের ওজন বেশি তারাও এটা পরতে পারেন।
* মোশন সিকনেস
অনেকেই বাসে বা যানবাহনে উঠলে মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব এমনকি বমি হয়, যাকে বলে ভ্রমণ-জনিত মোশন সিকনেস। এ সমস্যা প্রতিরোধে স্টিমেটিল বা ভার্গন ট্যাবলেট ভ্রমণের আধা ঘণ্টা আগে খেয়ে নেবেন। এ ছাড়া বাস বা ট্রেনে চলাকালে বাইরের দিকে তাকিয়ে না থেকে চোখ বন্ধ রাখুন, ঘুমিয়েও নিতে পারেন। যাত্রাপথে অনেকে বই পড়ে সময় কাটান। অভ্যাসটা ভালো, কিন্তু যারা মোশন সিকনেসে ভোগেন, তারা ভ্রমণের সময় বই পড়া পরিহার করুন। কারণ যানবাহনের দুলনির সঙ্গে বই পড়ার ফলে মাথা ঘোরা শুরু হতে পারে, পরে বমিও হতে পারে।
* শিশুদের জন্য বাড়তি সতর্কতা
ট্রেনে, বাস কিংবা লঞ্চে ভ্রমণের সময়ে শিশুরা সব সময়েই জানালার ধারের সিটটি পছন্দ করে। এ কারণে হঠাৎ করে অতিরিক্ত বাতাসের মুখোমুখি হতে হয়। ফলে শিশুরা অনেকে ঠিক ভ্রমণের পর পরই আক্রান্ত হয় সর্দি-জ্বর কিংবা সাধারণ কাশিতে। এ ছাড়াও বাইরের পানীয় এবং খাবার খেয়ে বমি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। তাই তারা যাতে যাত্রাপথে বাইরের খাবার না খায়, সে ব্যাপারে সজাগ থাকুন। একেবারে ছোট দুগ্ধপোষ্য শিশু নিয়ে ভ্রমণ না করাই উচিত। বের হতে হলে তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করে নিতে হবে। চলার পথে শিশুকে অবশ্যই ধরে রাখবেন, ট্রেন, বাস বা লঞ্চ থেকে নিচে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। লক্ষ্য রাখবেন কোনো বাচ্চা যেন জানালা দিয়ে হাত বাইরে না রাখে। এ বিষয়ে সতর্ক হোন।
* বয়স্কদের জন্য সতর্কতা
দীর্ঘ ভ্রমণ বয়স্কদের জন্য কষ্টসাধ্য। বিভিন্ন রোগসহ অনেকেই বাতজ্বর বা আরথ্রাইটিসে ভোগেন। তাদের জন্য বাসে বা ট্রেনে ওঠাও সহজ নয়, সেসময় তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। যাত্রাপথে যেন তারা একই ভঙ্গিতে বেশিক্ষণ বসে না থাকে এবং মাঝেমধ্যে যানবাহনের মধ্যেই যেন কিছুক্ষণ চলাফেরা করেন, সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখুন। তা না হলে বাতের ব্যথা বাড়তে পারে, এমনকি পায়ে পানি জমে পা ফুলেও যেতে পারে।
* গর্ভাবস্থায় ভ্রমণে করণীয়
গর্ভবতীরা অতিরিক্ত ঝাঁকি হয় এমন পথে ভ্রমণ যথাসম্ভব পরিহার করুন। প্রথম তিন মাস ও সম্ভাব্য ডেলিভারির ২-৩ মাস আগে ভ্রমণ এড়িয়ে চলাই ভালো। যাদের আগে গর্ভপাতের ইতিহাস আছে তাদের গর্ভাবস্থায় ভ্রমণ করা উচিত নয়। বিশেষ করে শেষ তিন মাস যে কোনো গর্ভবতীর ভ্রমণ নিষেধ। গর্ভাবস্থায় একা ভ্রমণ না করা উচিত। নিরাপদ মাতৃত্বের স্বার্থে কোনো ধরনের বিপদের ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না।
* অজ্ঞান পার্টি থেকে সাবধান
যাত্রাপথে মলম পার্টি ও ছিনতাইকারীর আনাগোনা বেশি থাকে, তাই সতর্ক থাকুন। যানবাহনে অপরিচিত কেউ খাদ্য বা পানীয় দিলে খাবেন না। এ ধরনের খাবার খেয়ে অনেকেই বড় দুর্ঘটনায় পড়েছেন। কাজেই এ বিপদ এড়াতে সচেতন থাকবেন। অন্য সময়ের চেয়ে ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ বাড়ে। এজন্য সফরে সতর্ক ও সাবধান থাকতে হবে, কোনোভাবেই অসতর্কভাবে চলাফেরা করা যাবে না। ঈদের আনন্দ যেন দুঃখ বয়ে না আনে, ঈদযাত্রা যেন পরিণত না হয় বিষাদময়, সেদিকেও সবাইকে মনোযোগ দিতে হবে, যত্নবান ও সতর্ক থাকতে হবে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিকার নয় প্রতিরোধ সর্বদা উত্তম।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক।