
প্রিন্ট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:২০ পিএম
ঈদের খাবার হোক পুষ্টিসম্মত

আখতারুন নাহার আলো
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
দীর্ঘ একমাস রোজা রাখার পর আসে ঈদুল ফিতর। এ দিনে ইচ্ছামতো খাওয়ার স্বাধীনতা পাই বলে, অনেকেই মাত্রাজ্ঞান ছাড়া খাবার খেয়ে থাকেন। ফলে বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
রমজানে আমাদের শরীর একটা নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে চলতে থাকে। এরপর হঠাৎ করে অতিভোজনের ফলে, পাকস্থলির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কারণ, এ সময় পাকস্থলির এনজাইম ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা যেমন-পেটব্যথা, পেটফাঁপা, ডায়রিয়া, বমি, মাথাব্যথা, কোষ্টকাঠিন্য হতে পারে। এ ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী রূপে দেখা দেয় আইবিএস বা ইরিটেবল বাওল সিনড্রোম ও খাবারে অরুচি। এ জন্যই খেতে হবে জেনে-বুঝে। যা কিছুই খাওয়া হোক না কেন, শরীরের কথা মনে রেখেই খাবার খেতে হবে। এ কারণে প্রতিটি বাড়িতেই সব বয়সি এবং সবার উপযোগী করে খাবার তৈরি করা উচিত। যারা ডালডা, ঘি, মিষ্টি খেতে পারেন না, তাদের জন্য উদ্ভিজ তেল ও বিকল্প চিনি দিয়ে খাবার তৈরি করতে হবে। পোলাও-বিরিয়ানি খেতে না পারলে ফ্রায়েড রাইস অথবা পোলাও চালের ভাতের বন্দোবস্ত করতে হবে। ব্যতিক্রমী খাবার হিসাবে চালের রুটি, ছিট পিঠা, খোলা পিঠা, সোজা পরোটা, নানরুটি, নরম খিচুড়ির সঙ্গে তন্দরি চিকেন, মাছ ও মুরগির কোর্মা, কাবাব, চাইনিজ সবজি নতুনত্ব আনতে পারে। এ ছাড়া নানা ধরনের সবজি মিশ্রিত বিফ অনিয়ন, চিকেন ভেজিটেবল, কাজু-চিকেন সালাদ থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে শাসলিকও স্বাস্থ্যসম্মত একটি উপাদান।
ঈদের উৎসব শুরু হয় সুস্বাদু মিষ্টান্ন দিয়ে। বিরতিহীনভাবে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে উচ্চ ক্যালরি সম্পন্ন গুরুপাক খাবার খাওয়া। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রান্না হয়-সেমাই, জর্দা, পুডিং, পায়েস, কাস্টার্ড, ফালুদা, দুধ-লাউ, মিষ্টি পিঠা ইত্যাদি। এ ছাড়াও থাকে পোলাও, বিরিয়ানি, তেহারি, রেজালা, কোরমা, কাবাব, চটপটি, শাসলিক, নডুলস, পাস্তা ইত্যাদি। চিনি, দুধ, দই, কিশমিশ, নারিকেল, পেস্তা, বাদাম, জায়ফল, জয়ত্রী, আলু বোখারা ইত্যাদি রান্নায় ব্যবহার হয়। এগুলো বেশ পুষ্টিসম্মত ও সুঘ্রাণযুক্ত। এতে খাবারের শোভা ও স্বাদ দুটাই বাড়ে। আমাদের অন্ত্রে অনেক সময় জীবাণুর সংক্রমণের জন্য উদ্বায়ু। কোষ্টকাঠিন্য, গাঁজানো, পচন ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। দইয়ে থাকে ল্যাক্টোবেসিলি বুলগেরিকাস নামক ব্যাকটেরিয়া দই এ অসুবিধাগুলো দূর করতে সাহয্য করে। দই প্রোবায়োটিক হিসাবেও কাজ করে। এটি ভালো ব্যাকটেরিয়াকে উদ্দীপ্ত করে পরিপাক ক্রিয়াকে সহজতর করে। কিশমিশে লৌহ ছাড়াও অন্যান্য খনিজ পদার্থ থাকে। যা হৃদরোগী ও কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীদের জন্য ভালো।
ঈদের রান্নায় নারিকেলের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। যেমন-হাতে কাটা চালের সেমাইর জন্য নারিকেল দেওয়া ছাড়াও নারিকেলের দুধ দিয়ে পোলাও, মুরগি ও খাসির মাংস এবং হাঁসের মাংস রান্না করা হয়। চিংড়ি মালাইকারি, নারিকেলের বরফি ইত্যাদি করা হয়। নারিকেল সহজপাচ্য, সুস্বাদু ও ক্যালরিসমৃদ্ধ। কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লাইসেরাইডের সমস্যা থাকলে নারিকেল বর্জন করা ভালো। নারিকেলে আছে ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স ও এমাইনো অ্যাসিড। এর চর্বি সহজেই হজম হয়। নারিকেল ত্বক মসৃণ রাখে ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে সাহায্য করে। বাদামে আছে প্রচুর ভিটামিন ‘ই’, ম্যাগনেশিয়াম, প্রোটিন ও অসম্পৃক্ত চর্বি। যা হৃদরোগীদের জন্য উপকারী।
এ সময় কিছুটা গরম অনুভূত হচ্ছে। ঈদের দিনে ঠান্ডা শরবতের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। তবে কার্বোনেটেড পানীয় না দেওয়াই ভালো। এতে তৃষ্ণার পরিমাণ বেড়ে যাবে। ফলের রস, টক দইয়ের লাচ্ছি, ঘোল, মাঠা দিয়েও আপ্যায়ন করা যায়। আবার আস্ত ফল কেটে দিলেও খারাপ হয় না। ফলের চিনি শরীরকে তরতাজা রাখে। ঈদের রান্নায় বিভিন্নভাবে ফল ব্যবহার করা যায়। যেমন-ফলের চাটনি, আনারস-কমলার জর্দা, কাস্টার্ড, ফ্রুট সালাদ, নারিকেলের ক্ষীর, গাজরের হালুয়া, গাজরের পায়েস, আপেল-নাশপাতির পাই, আম-আনারস-তরমুজের পাই, ফালুদা, কাশ্মিরী পোলাও, শসার রায়তা, পাকা কলার রায়তা, মিল্ক শেক, আনারস-ইলিশ মাছ, আনারস-মাংস, আপেল-মুরগির মাংস ইত্যাদি।
খাবার রান্না করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে অধিক ঝাল, মসলা, ডালডা, ঘির প্রয়োগ না ঘটে। ঝাল ও তৈলাক্ত খাবারের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের চাটনি রাখা যেতে পারে। যাতে খাবারে অরুচি না আসে। পুদিনাপাতা, ধনিয়াপাতা, তেঁতুল, জলপাই, টমেটো, লেবু, কাঁচাআম, আমড়া, আনারস, রসুন, কাঁচামরিচ ইত্যাদি দিয়ে চাটনি তৈরি করা যায়। সালাদ-লেবুর পাশাপাশি রায়তাও পরিবেশন করা যায়। টক দইয়ের রায়তা হজমের সহায়ক।
ঈদের দিনে খাবার যত সুস্বাদু ও বৈচিত্র্যপূর্ণ থাকুন না কেন, মাত্রাজ্ঞান রেখে নিজ নিজ স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাবার খেতে হবে। এ দিনেও সময় মতো বিরতি দিয়ে খাওয়া উচিত। খাবার হবে স্বাস্থ্যসম্মত, সহজপাচ্য এবং পরিবেশিত হবে পরিচ্ছন্ন ও আকর্ষণীয়ভাবে।
লেখক : চিফ নিউট্রিশন অফিসার ও বিভাগীয় প্রধান (অব.), বারডেম। সভাপতি, ডায়াবেটিস নিউট্রিশনিস্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শ্যামলী ও অ্যাডভান্স হাসপাতাল, ঢাকা।