অসংক্রামক রোগীদের রোজার প্রস্তুতি

অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রোজার অন্যতম লক্ষ্য মানুষের স্বাস্থ্যগত উন্নতি সাধন। রোজা রাখলে অনেকে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় করেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রোজায় কারও স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে বা রোজা রেখে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে কারও মৃত্যু হয়েছে এমন কোনো ঘটনার কথা শোনা যায়নি। রোজা কষ্টকর ইবাদত এবং রোজার দ্বারা শরীরে চাপ পড়ে বলে অনেকেই রোজা ছেড়ে দেন। শরিয়তের বিধান অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া রোজা পরিত্যাগ করা সম্পূর্ণ অনুচিত। সুস্থ ব্যক্তি তো বটেই, অনেক অসুস্থ ব্যক্তিরও রোজা ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে না।
অতিশয় কষ্ট বলতে অতি বার্ধক্য, চিরস্থায়ী রোগ যা অতীব কষ্টকর, তার জন্য এই মাসে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। পরে কাজা আদায় করলেই চলবে। অবশ্য কী কী অবস্থায় রোজা রাখা যাবে কি যাবে না তার সুস্পষ্ট বিধান শরীয়তে আছে।
গর্ভবতীর যদি গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা হয় অথবা স্তন্যদায়ী মা যদি রোজা দ্বারা তার নিজের বা তার স্তন্যপানকারী শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তবে সেও এ মাসে রোজা না রেখে পরে সুবিধামতো সময়ে কাজা আদায় করতে পারে।
অনেক রোগীই যে কোনো অবস্থায় রোজা রাখতে বদ্ধপরিকর। আবার অনেকেই নিজের মতো অজুহাত তৈরি করে রোজা না রাখার যুক্তি খোঁজেন। আসলে দীর্ঘস্থায়ী রোগেও রোজা রাখা সম্ভব।
রোজার মাসে পেপটিক আলসার রোগীরা খালি পেটে থাকবেন, ডায়াবেটিস রোগীরা কীভাবে রোজা রেখে ইনসুলিন নেবেন, উচ্চরক্তচাপের রোগীরা কীভাবে দু’বেলা বা তিনবেলা ওষুধ সেবন করবে, এ ছাড়া হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের রোগী, কিডনি বা হার্টের রোগী, লিভার, চোখ, কান বা নাকের রোগী, বা গর্ভাবস্থায় রোজা রাখবেন কিনা এসব চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন। কেনো কোনো অসুস্থ ব্যক্তি এমনকি সুস্থ ব্যক্তিরাও দুর্বলতা এবং নানারকম দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনার কারণে রোজা রাখতে গড়িমসি করেন।
আসলে রোজা রাখলে শরীরে তেমন কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে না। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুচিন্তিত অভিমত হলো, রোজা স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি তো করেই না, বরং শরীর ও মনের উন্নতি লাভের সহায়ক। পেপটিক আলসার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগী, যাদের অতিরিক্ত ওজন ও শরীরে চর্বি বা কোলেস্টারলের পরিমাণ বেশি এবং বাত ব্যথার রোগীরাও সরাসরি রোজায় উপকার পান। যারা ধূমপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করেন, রোজায় এগুলো পরিহার করার সুবর্ণ সুযোগ। এর ফলে ক্যানসার, হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ বহু জটিল রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। যারা দীর্ঘমেয়াদি বা অসংক্রামক রোগে ভুগেন, তাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও রোজা রাখতে অনেকেই প্রবল আগ্রহী। তারা যদি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোজার মাসের জন্য ওষুধবিধি ঠিক করে নিতে পারেন, তবে সহজেই রোজা রাখতে পারবেন। এতে রোজা ভাঙার বা রোজা থেকে বিরত থাকার কোনো প্রয়োজন হয় না।
* রুটিন চেকআপ
▶ যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, হাঁপানি, থাইরয়েডের সমস্যা বা অন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগ আছে, তারা রমজান শুরুর আগেই চিকিৎসকের পরামর্শে একটি রুটিন চেকআপ সেরে ফেলুন।
▶ সাধারণত রুটিন চেকআপে রক্তের শর্করা, কিডনির অবস্থা বুঝতে ক্রিয়েটিনিন, প্রস্রাবে অ্যালবুমিন, লিভারের জন্য এসজিপিটি, রক্তের সিবিসি, ইলেকট্রোলাইট, লিপিড প্রোফাইল, ফুসফুসের রোগীদের প্রয়োজনে এক্স-রে, হৃদরোগীদের ক্ষেত্রে ইসিজি করা হয়ে থাকে।
▶ পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ, পুরোনো ওষুধের ডোজ পরিবর্তন বা কোনো নতুন ওষুধের সংযোজন দরকার হলে তা শরীরের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট সময় পাওয়া যায় এতে।
▶ ডায়াবেটিক রোগীরা রমজানে ইনসুলিনের বা খাবার ওষুধের মাত্রা কেমন হবে, তা ভালোভাবে জেনে নিন। রক্তচাপ, হৃদরোগী, হাঁপানি, কিডনি বা লিভার ও অন্য রোগীরা ওষুধের রোজাকালীন ব্যবহারের সময়সূচিও জেনে নিন।
* চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন
▶ চিকিৎসকের সঙ্গে আপনার বিগত বছরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন। এতে তার বুঝতে সুবিধা হবে রমজানে আপনার কোন ধরনের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা আছে; যেমন ডায়াবেটিক রোগীদের বিগত বছরে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছিল কি না কিংবা উচ্চরক্তচাপের রোগীদের রক্তচাপে কোনো পরিবর্তন হয়েছিল কিনা, হৃদরোগীদের শ্বাসকষ্ট বেড়ে গিয়েছিল কিনা ইত্যাদি। গতবারের সমস্যাগুলো এবার কীভাবে এড়ানো যায়, সেই পরামর্শ করুন।
▶ যারা পরিপাকতন্ত্রের সমস্যায় ভোগেন, যেমন পেপটিক আলসার, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, আইবিএস, জিআরডিসহ নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়া দাওয়াসহ ওষুধপত্রের ব্যবস্থা জেনে নিন।
* পরামর্শ
▶ রমজানে আমাদের খাদ্যাভ্যাস অনেকটাই পাল্টে যায়। এতে কারও কারও নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার যাদের ক্রনিক রোগ আছে, তাদের নানা খাবারে নিষেধাজ্ঞা থাকে। রমজানে আমাদের ডাল বা বেসনের তৈরি অনেক খাবার গ্রহণ করা হয়, ভাজাপোড়া খাবারও খাওয়া হয় অনেক। কে কতটুকু খেতে পারবেন, তা নির্ভর করে তার সাম্প্রতিক ক্রিয়েটিনিন, লিপিড প্রোফাইল বা শর্করার রিপোর্টের ওপর।
▶ যাদের আইবিএস, যকৃতের সমস্যা, পেপটিক আলসার, জিইআরডি, কোষ্ঠকাঠিন্য আছে, তারাও খাবার সম্পর্কে জেনে নিন কিসে ভালো থাকবেন। কিডনি ও হৃদরোগীদের অনেক সময় পানির পরিমাণ মেপে দেওয়া হয়। রাতে কতটুকু পানি বা তরল কীভাবে খাবেন, সেগুলো জেনে নিন।
মানুষের রোগের শেষ নাই, ধরনও এক নয়। তাই যে কোনো রোগী যারা রোজা রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অথচ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন, তাদের উচিত ইসলামি জ্ঞানসম্পন্ন ডাক্তার বা আলেম-ওলামার সঙ্গে পরামর্শ করে রোজার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবেন। মনে রাখতে হবে, নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগে কিংবা সামান্য অসুস্থতায় রোজা রাখতে কোনো নিষেধ নাই। বরং রোজা রাখা রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক