কিশোর বয়সে আচরণগত সমস্যা

ডা. সাইফুন নাহার
প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

* কেস স্টাডি
রাফসান (ছদ্মনাম) ১৩ বছর বয়স, ভয় দেখানো, বুলিং এবং শারীরিকভাবে ক্ষতি করার ইতিহাস নিয়ে চিকিৎসকের কাছে এসেছে। অন্যের প্রতি আক্রমণাত্মক এবং ধ্বংসাত্মক আচরণ, মিথ্যা কথা বলা, স্কুল এড়ানো, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া, সিগারেট খাওয়া এসব অভিযোগও আছে তার সম্পর্কে। রাফসানের পরিবারের মানসিক রোগের কোনো ইতিহাস নেই। চিকিৎসক নির্ণয় করেছেন সে ‘কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার’-এ ভুগছে।
কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার কিশোরদের মধ্যে পুনরাবৃত্তিমূলক এবং অবিরাম আচরণগত মানসিক সমস্যা, যা সাধারণত শৈশব বা কৈশোরে শুরু হয়। এ ব্যাধিতে আক্রান্ত শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের নিয়মনীতি অনুসরণ করা এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য উপায়ে আচরণ করা কঠিন। তারা আক্রমণাত্মক, ধ্বংসাত্মক এবং প্রতারণামূলক আচরণ প্রদর্শন করতে পারে। অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে। এ আচরণগুলো প্রায়শই ‘অসামাজিক আচরণ’ হিসাবে গণ্য করা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক এবং অন্য শিশুরা তাদের এসব আচরণকে মানসিক অসুস্থতা মনে না করে তাদেরকে ‘খারাপ’ বা অপরাধী হিসাবে উপলব্ধি করতে পারে। কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত শিশু বা কিশোর একগুয়ে এবং আত্মবিশ্বাসী হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করে। কিন্তু এসব শিশু বা কিশোর প্রায়শই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং ভুলভাবে বিশ্বাস করে যে, লোকেরা তাদের প্রতি আক্রমণাত্মক বা হুমকিস্বরূপ। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার বেশি দেখা যায় এবং অনুপাতটি ৪:১ থেকে ১২:১ এর মতো হতে পারে। সাধারণ জনগোষ্ঠীতে আজীবন বিস্তারের হার ২ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে।
* কেন হয়
মস্তিষ্কের ক্ষতি, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন, অবহেলা, বংশগত কারণ, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, মানসিক আঘাত থেকে এ সমস্যা হতে পারে।
কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত শিশু বা কিশোর-কিশোরীরা নিম্নলিখিত কিছু আচরণ প্রদর্শন করতে পারে-
* মানুষ এবং প্রাণীর প্রতি আগ্রাসন
▶ বুলি, হুমকি দেওয়া বা অন্যকে ভয় দেখানো।
▶ নিষ্ঠুর আচরণের পর আনন্দিত হওয়া।
▶ মারামারি করা।
▶ এমন কোনো অস্ত্র ব্যবহার করা যা অন্যের মারাত্মক শারীরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
▶ মানুষ বা প্রাণীর প্রতি শারীরিকভাবে নিষ্ঠুর আচরণ করা।
▶ অন্যের জিনিস চুরি করা।
▶ কাউকে যৌন ক্রিয়াকলাপে বাধ্য করা।
▶ আক্রমণাত্মক আচরণের আগে ও পরে কোনো অনুশোচনা না হওয়া।
* সম্পত্তি ধ্বংস
▶ ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতির অভিপ্রায় নিয়ে আগুন লাগানো।
▶ প্রতারণা, মিথ্যা বলা, বা চুরি করা।
▶ অন্য কারও বিল্ডিং, বাড়ি বা গাড়িতে প্রবেশ করা।
▶ পণ্য পেতে মিথ্যা বলা।
* নিয়ম লঙ্ঘন
▶ পিতামাতার আপত্তি সত্ত্বেও প্রায়শই রাতে বাইরে থাকা।
▶ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া।
এই আচরণগুলো প্রদর্শন করে এমন শিশু বা কিশোরদের একজন অভিজ্ঞ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত অনেক শিশুদের আবেগীয় ব্যাধি, উদ্বেগ, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, মাদকের অপব্যবহার, এটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার, শেখার সমস্যা বা চিন্তার ব্যাধিগুলোর মতো সহাবস্থানীয় সমস্যাও থাকতে পারে, যা চিকিৎসা করা প্রয়োজন।
গবেষণা দেখা গেছে, কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত কিশোর এবং তাদের পরিবারগুলো প্রাথমিক এবং ব্যাপক চিকিৎসা পান না। ফলে সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হয়। চিকিৎসা ব্যতীত, কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত অনেকে প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে এবং চাকরি অব্যাহত রাখতে সক্ষম হন না।
* চিকিৎসা পদ্ধতি
কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। বিভিন্ন সেটিংসে চিকিৎসা প্রদান করা যেতে পারে। আচরণ থেরাপি এবং সাইকোথেরাপি সাধারণত শিশুর ক্রোধকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে এবং নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।
বুদ্ধি প্রতিবন্ধী তরুণদের জন্য বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। বাড়িতে এবং স্কুলে এ চিকিৎসা নিতে পিতামাতাদের উচিৎ বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া। মাল্টিসিস্টেমিক থেরাপি (এমএসটি)-এর মতো হোম-ভিত্তিক চিকিৎসা প্রোগ্রামগুলো শিশু এবং পরিবার উভয়কেই সহায়তা করার জন্য কার্যকর। যাদের মনোযোগে অসুবিধা হয়, আবেগের সমস্যা বা হতাশা থাকে তাদের চিকিৎসায় কিছু ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে।এসব ক্ষেত্রে আচরণের ধরন পরিবর্তন করতে সময় লাগে, তাই চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি হয়।
লেখক : সাইকিয়াট্রিস্ট্র ও সাইকোথেরাপিস্ট, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, এডিকশন সাইক্রিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।