আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রিসিশন মেডিসিন এবং ফার্মাকোজেনেটিক্স
সরকার এম শাহীন
প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রিসিশন মেডিসিন হলো ডিএনএ বা জিনের সমন্বয়ে চিকিৎসা পদ্ধতির আধুনিক রূপ। অর্থাৎ নির্ভুলভাবে ওষুধের সুপারিশ, সঠিক মাত্রা, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ পরিহার, অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসার খরচ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে চিকিৎসা হলো প্রিসিশন মেডিসিন। বর্তমানে প্রচলিত প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতিতে ‘সবার জন্য একই নিয়ম’ পদ্ধতিটি প্রচলিত, যা সাধারণত ওষুধের নির্দেশিকা ও অন্যান্য রোগীর চিকিৎসাতত্ত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত। রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে একজন মানুষের নিজস্ব জেনেটিকস, বিপাক এবং অন্যান্য পার্থক্যের কারণে, এ ট্রায়াল অ্যান্ড এরর অ্যাপ্রোচ সবার জন্য কার্যকর নাও হতে পারে। এ পদ্ধতির মূল লক্ষ্য, একজন রোগী প্রথাগত ওষুধের পরিবর্তে রোগীর নিজস্ব জেনেটিক মেকআপ, মলিকুলার প্রোফাইল এবং তার ব্যক্তিগত তথ্য বিবেচনা করে, রোগনির্ণয় এবং সে অনুসারে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
* ডিএনএ বা জিনের প্রভাব
জিন মানবদেহের বংশগতির বাহক। এটি আমাদের দেহের কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা ডিএনএর সমন্বয়ে গঠিত উপাদান। জিন বাবা-মা থেকে সন্তানদের মাঝে প্রবাহিত হয় এবং পরে বংশপরম্পরায় এ ধারা অক্ষুণ্ন রাখে। মানুষের নিজস্ব গতি, প্রকৃতি, দৈহিক গঠন, বেড়ে ওঠা, উচ্চতা, চোখের রং, এমনকি রোগ-বালাইসহ যাবতীয় তথ্য বহনকারী উপাদান হিসাবে কাজ করে এ জিন। তবে মানবদেহে জিন প্রবাহের এ পদ্ধতি কিন্তু ১০০ ভাগ সঠিক নিয়ম অনুসরণ করে না। পদ্ধতিগত এ ত্রুটিকে ডিএনএ ভ্যারিয়েশন বা মিউটেশন বলা হয়। ডিএনএ মিউটেশনের হার ০.০১ শতাংশ। বাকি ৯৯.৯৯ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকে। একজন মানুষের সঙ্গে অন্যজনের ডিএনএর ০.০১ শতাংশ মিউটেশন বা পরিবর্তনের জন্যই এ জগতের প্রতিটি মানুষই আলাদা। এ কারণেই প্রত্যেক মানুষ তার একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বহন করে। প্রিসিশন মেডিসিন পদ্ধতিতে রোগ-নিরাময়ের নির্দেশিকা তৈরিতে জিন বিন্যাস বা জিনোটাইপিং যে পদ্ধতি ফলো করা হয় তার অন্যতম একটি পদ্ধতির নাম ফার্মাকোজেনেটিক্স।
* প্রিসিশন মেডিসিন এবং ফার্মাকোজেনেটিক্স
রোগী ওষুধ গ্রহণের পর ওষুধের কার্যকারিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং বিপাক প্রক্রিয়ায় এক ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ বিষয়টি জিনগত প্রভাব বা তারতম্যের কারণে হয়ে থাকে। ফার্মাকোজেনেটিক্স ওষুধের কার্যকারিতা এবং জিনের এ আন্ত-পারস্পরিক সম্পর্ক নিশ্চিত করে, যেমন-কিছু কিছু জিন শরীরকে নির্দেশনা দেয় কীভাবে ওষুধ ব্যবহার করতে হবে বা ভেঙে ফেলতে হবে। ওষুধ ভেঙে ফেলার বিপাকীয় প্রক্রিয়াটি সবার জন্য কিন্তু একই নিয়ম মেনে চলে না। ব্যক্তি বিশেষে কারও জন্য এ প্রক্রিয়া ‘দুর্বল’ (ধীর) থেকে ‘স্বাভাবিক’ (মাঝারি) থেকে ‘অতিদ্রুত’ (দ্রুত) হয়ে থাকে। এর মানে, একই ওষুধ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি ভিন্নভাবে বিপাকীয় প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। রোগীর জিনগত তফাত এবং বৈশিষ্ট্যের তারতম্যের জন্য, কিছু ওষুধ একজনের বিপাকীয় প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তুলতে পারে এবং তার জন্য স্বাভাবিক ডোজ কার্যকর নাও হতে পারে, ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। ফার্মাকোজেনেটিক্স পরীক্ষা নির্দিষ্ট জিনের বৈচিত্র্য মূল্যায়ন করে ওষুধের বিপাকীয়করণের হারকে প্রভাবিত করে।
* ফার্মাকোজেনেটিক্স কীভাবে কাজ করে
ফার্মাকোজেনেটিক্স পরীক্ষায় একজন ব্যক্তির ডিএনএ বা জিন বিশ্লেষণ করে তার জেনেটিক প্রোফাইল বা ধরন, যেমন- ডিএনএ ভ্যারিয়েশন বা মিউটেশন জাতীয় রূপগুলো শনাক্ত করা হয়, এবং সেসঙ্গে বিপাকীয় প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে কোন ধরনের ওষুধ এবং ওষুধের সঠিক ডোজ কী হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করে থাকে। এ টেস্টিং পদ্ধতিতে রোগীর ক্লিনিক্যাল প্রয়োগের জন্য যে চিকিৎসা নির্দেশিকা অনুসরণ করা হয়, সেটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।
* প্রিসিশন মেডিসিনের অগ্রযাত্রা
একবিংশ শতাব্দীতে ফার্মাকোজেনেটিক্স ও প্রিসিশন মেডিসিন ওষুধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে উদিয়মান একটি উদ্ভাবন যা চিকিৎসাসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার এ অগ্রযাত্রা ইতোমধ্যেই বেশ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। শিশু এবং তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে কানাডার প্রথম প্রমাণভিত্তিক ফার্মাকোজেনেটিক টেস্টিং পদ্ধতি গত কয়েক বছর ধরে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কাজ করছে। গবেষণামূলক এ গ্রুপটি, শিশু ও যুবকদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন-বিষণ্নতা, উদ্বেগ অথবা স্নায়ুবিক বিকাশজনিত রোগ, অটিজম, অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার, এডিএইচডি, ওসিডি এবং উদ্বেগ স্পেকট্রাম আক্রান্ত শিশুদের ফার্মাকোজেনেটিক্স পরীক্ষা পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে ইতোমধ্যেই দুই হাজারের বেশি রোগীর চিকিৎসাসেবা সম্পন্ন করেছে। যুবক এবং শিশুদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত ওষুধের (যেমন- অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস, অ্যান্টিসাইকোটিকস) বর্তমান ব্যবহার একটি ট্রায়াল-অ্যান্ড-এরর প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা ওষুধ গ্রহণকারীদের সুস্থতার এবং তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক খরচের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে। এ ট্রায়াল-অ্যান্ড-এরর প্রক্রিয়াটি আংশিকভাবে ফার্মাকোজেনেটিক পরীক্ষা প্রয়োগের মাধ্যমে এড়ানো যেতে পারে, পাশাপাশি ওষুধের কার্যকারিতা উন্নত করার এবং অনুপযুক্ত ওষুধের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত অসুস্থতা, মৃত্যুহার এবং অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানোর ঝুঁকি এড়াতেও সক্ষম।
* পরিশেষে
ফার্মাকোজেনেটিক্স ও প্রিসিশন মেডিসিন পদ্ধতির সঠিক ব্যবহারের মাধমে চিকিৎসা জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন-নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডারগুলো, ক্যানসার, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো জটিল রোগগুলোর চিকিৎসায় যথাযথ ব্যবহারের সমূহ সম্ভাবনা রাখে। বাংলাদেশে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নে দেশের জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও চিকিৎসাসেবীর অর্থনৈতিক খরচের বোঝা কমানোসহ ইতিবাচক প্রভাব ও ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : গবেষক, নিউরোজেনেটিকস অ্যান্ড প্রিসিশন মেডিসিন, ডিপার্টমেন্ট অব সাইকাইয়াট্রি,ফার্মাকোলজি অ্যান্ড মেডিকেল জেনেটিকস, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগেরি, কানাডা।