এইচএমপিভি : স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন
অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নতুন একটি ভাইরাস আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, নাম এইচএমপিভি বা হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস। করোনা মহামারির পর এ ভাইরাস নিয়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে হইচই আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। কোভিড-১৯ আমাদের মনে অন্যরকম ভয় সৃষ্টি করেছিল। তারপর থেকে কোনো দেশে কোনো ভাইরাস সংক্রমণের কথা শুনলেই আমরা আঁতকে ওঠি। চলতি বছরের শুরুতে চীনে এইচএমপিভি ভাইরাসটি ব্যাপক হারে বাড়ছে। একইসঙ্গে এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও একজন রোগী এ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। যদিও তার অন্যান্য শারীরিক জটিলতাও ছিল। তবে এ ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। বিস্তারিত লিখেছেন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ
* এইচএমপিভি নতুন ভাইরাস নয়
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি বলছে, ভাইরাসটি মোটেই নতুন নয়। ২০০১ সালে প্রথম এ ভাইরাস শনাক্ত হয় নেদারল্যান্ডসে। অনেকের ধারণা, হয়তো অনেক বছর আগে থেকেই এ ভাইরাসের অস্তিত্ব পৃথিবীতে ছিল। এটা একটি আরএনএ ভাইরাস যা প্রধানত শ্বাসতন্ত্রে আক্রমণ করে।
* কতটা ভয়ংকর
এ ভাইরাস নিয়ে অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ এইচএমপিভি ভাইরাস বিজ্ঞানীদের কাছে আগে থেকেই পরিচিত। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ভাইরাসের সংক্রমণের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এটা দ্রুত সংক্রমণশীল, ছোঁয়াচে। তবে ততটা জটিলতর বা প্রাণঘাতী নয়। এ ভাইরাস শীতকালীন স্বাভাবিক সংক্রমণ সৃষ্টি করে এবং আগেও বাংলাদেশে এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ২০১৬ বা ২০১৭ সালের দিকেও এ ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে আমাদের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিদ্যমান।
* এটি কী ধরণের ভাইরাস
নতুন বলে ধারণা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি মোটেও নতুন আবিষ্কৃত ভাইরাস নয়। এটি নিউমোভ্যারিডি গোত্রের ভাইরাস, অনেকটা রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাসের মতো, যা শিশুদের মাঝে প্রায়ই দেখা দেয়। ৫০ বছর ধরেই এ ভাইরাস মানুষকে আক্রমণ করে আসছে। এর শিকার মূলত ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুরা। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের প্রতি ১০ জনের একজন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। বয়স ৬ বছর হওয়ার আগেই বেশিরভাগ শিশু এ ভাইরাসে অন্তত একবার আক্রান্ত হয়।
* কারা বেশি ঝুঁকিতে আছেন
এইচএমপিভি মূলত শিশুদের হয়ে থাকলেও কেউ কেউ আবার বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। যেমন নবজাতক, ৫ বছর বয়সের নিচের শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি, যাদের হাঁপানি, ক্রনিক ব্রংকাইটিস রোগ আছে, যারা স্টেরয়েড গ্রহণ করেন, এমনকি যারা বিভিন্ন ক্রনিক রোগে ভোগেন যেমন উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, লিভার, হার্ট বা কিডনি রোগী বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল, যারা শারীরিকভাবে অসুস্থ এবং গর্ভবতী, তাদেরও ঝুঁকি বেশি।
* কখন ও কীভাবে ছড়ায়
এটি মৌসুমি ভাইরাস। সাধারণত শীতের শুরু থেকে বসন্ত পর্যন্ত বেশি ছড়ায়। ভাইরাসটি অত্যন্ত সংক্রামক এবং বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।
▶ এইচএমপিভি অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাসের মতোই ছড়িয়ে পড়তে পারে, যখন একজন সংক্রমিত ব্যক্তি কাশি, হাঁচি বা কথা বলে, যার ফলে শ্বাসযন্ত্রের ফোঁটা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ফ্লুর মতোই হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ড্রপলেট দিয়ে এ ভাইরাস ছড়ায়।
▶ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক যোগাযোগের মাধ্যমে অন্য ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে কেউ যদি তাদের মুখ, চোখ বা হাত স্পর্শ করে। সংক্রমিত স্থান স্পর্শ করা এবং তারপর মুখ, নাক বা চোখ হাত দিয়ে স্পর্শ করলে সুস্থ ব্যক্তি আক্রান্ত হবেন।
▶ আক্রান্ত ব্যক্তির হাত বা স্পর্শ লেগেছে যেমন দরজার হাতল বা মোবাইল ডিভাইসের মতো এমন বস্তু থেকে, হ্যান্ডশেক বা ব্যবহৃত দ্রব্য ব্যবহারের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে।
▶ বায়ুবাহিত কণা বাতাসে ছড়িয়ে থাকতে পারে, বিশেষ করে জনাকীর্ণ বা বায়ুচলাচলের স্থান যেখানে অবাধ নয় এবং বাতাসের মাধ্যমে শ্বাসনালিতে ছড়াতে পারে।
* উপসর্গ
আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার তিন থেকে ছয় দিনের পর উপসর্গ দেখা দেয়। মূলত এটি শ্বাসতন্ত্রের রোগ। কোভিড ও এইচএমপি ভাইরাসের মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য নেই। তবে কোভিডের মতো এতো জটিলতাও নেই। উপসর্গ সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো, তেমন গুরুতর নয়। যেমন কাশি, নাক বন্ধ হওয়া, সর্দি, জ্বর, গলাব্যথা, কারও ক্ষেত্রে এর সঙ্গে বমি, অরুচি বা ডায়রিয়া হতে পারে। সঙ্গে ত্বকে র্যাশ বা দানা দানা দেখা দিতে পারে। আর দশটা ভাইরাস জ্বরের মতো ৫-৭ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই সেরে যায়, যদি না অন্য কোনো জটিলতা দেখা দেয়। তবে বয়সভেদে লক্ষণ বা উপসর্গ ভিন্নতর হতে পারে।
* প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে লক্ষণ
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এর লক্ষণগুলো প্রায়ই সাধারণ সর্দি বা ফ্লুর মতোই হয়। যেমন অবিরাম কাশি, নাক বন্ধ হওয়া বা নাক দিয়ে পানি পড়া, জ্বর, সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি, ক্লান্তি এবং শরীরের সাধারণ ব্যথা, গলাব্যথা, গুরুতর ক্ষেত্রে শ্বাস নিতে অসুবিধা।
* শিশুদের মধ্যে লক্ষণ
শিশুদের মধ্যে গুরুতর উপসর্গ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এর মধ্যে রয়েছে শ্বাসকষ্ট এবং ক্রমাগত কাশি, উচ্চমাত্রার জ্বর, ডিহাইড্রেশন, বমি, অরুচি বা ডায়রিয়া।
* জটিলতা
যদিও অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হয় না, তবে কিছুক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের অন্যান্য সংক্রমণ বা জটিলতা হতে পারে। যেমন শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া বা অন্য কোনো সেকেন্ডারি ইনফেকশন ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি হয় মধ্যকর্ণের সংক্রমণ। হাঁপানি রোগীর শ্বাসকষ্ট বাড়তে পারে। শিশুদের নিউমোনিয়া বা ব্রংকিওলাইটিস হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল হয়ে উঠতে পারে। তবে সময়মতো চিকিৎসা নিলে এসব নিয়েও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এখন পর্যন্ত শিশু, বয়স্ক মানুষ এবং যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল তাদের মধ্যেই এ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে বেশি দেখা গেছে।
* রোগ নির্ণয়
পিসিআর, অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাসটি দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব।
* চিকিৎসা
নতুন এ ভাইরাসটির জন্য কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। এমনকি এর জন্য কোনো ভ্যাকসিনও বের হয়নি। সতর্কতা অবলম্বন করলেই এ ভাইরাসের উপসর্গগুলো কমানো সম্ভব। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
▶ শরীরকে হাইড্রেট রাখতে বেশি পরিমাণ পানি পান করা উচিত। কুসুম কুসুম গরম পানি পান করা, গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে গড়গড়া করা উচিত।
▶ অন্যসব ভাইরাস জ্বরের মতো জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, নাক বন্ধ হলে এন্টিহিস্টামিন, ডিকনজেসটেন্ট, স্টেরয়েড ড্রপ, বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবারই সেরে ওঠার জন্য যথেষ্ট।
▶ অনেকসময় এ রোগের সঙ্গে নিউমোনিয়া হতে পারে অথবা সেকেন্ডারি কোনো ইনফেকশনও হতে পারে। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টিবায়োটিক প্রয়োজন হতে পারে।
▶ শ্বাসকষ্ট বাড়লে চিকিৎসকের পরামর্শে ইনহেলার বা নেবুলাইজেশন লাগতে পারে। জ্বর ও অসুস্থতা বাড়লে বা দীর্ঘায়িত হলে, অবস্থার অবনতি বা শ্বাসকষ্ট হলে হাসপাতালে দ্রুত যেতে হবে।
* সতর্ক থাকুন
কোভিডকালের পর সারাবিশ্বে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের হার বেড়েছে। তাই রোগ প্রতিরোধে নজর দিতে হবে।
▶ হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। হাঁচি, কাশির সময় রুমাল বা টিস্যু দিয়ে মুখ ঢেকে নিতে হবে এবং ব্যবহারের পর টিস্যুটি যত্রতত্র না ফেলে যথাস্থানে ফেলতে হবে।
▶ ঘরের বাইরে কোথাও গেলে এবং ভিড়ের মধ্যে মাস্ক পরা ভালো। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, যাদের সর্দি-কাশি এবং শ্বাসকষ্টের উপসর্গ রয়েছে তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা খুবই জরুরি। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে।
▶ বাইরে থেকে এসেও রোগী পরিচর্যার পর ভালো করে স্যানিটাইজার বা সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত ধুতে হবে। হাত না ধুয়ে নাকে, মুখে হাত দেওয়া যাবে না।
▶ আক্রান্ত রোগী বা সর্দিজ্বরের রোগী থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা এবং শিশু ও হাঁপানি রোগীদের আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে দূরে রাখতে হবে।
▶ শিশুদের সর্দি-কাশি হলে তাদের কিছুদিন স্কুলে না পাঠানোই ভালো। এতে অন্য বাচ্চারও অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
লেখক : ইমিরেটাস অধ্যাপক।