শিশুকে খাওয়ানোর নিয়ম ও অনিয়ম
অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শিশু কম খাচ্ছে বা একেবারেই খাচ্ছে না, এ নিয়ে মায়েদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তাই মায়েরা, বস্তুত সারা দিন শিশুকে খাওয়ানোতেই ব্যস্ত থাকেন। কোনো কোনো মায়েদের ধারণা, শিশু বুকের দুধ কম পাচ্ছে তাই ওজন বাড়ছে না। দুই-তিন বছরের শিশুর ক্ষেত্রে মায়েদের প্রধান অভিযোগ হচ্ছে, শিশু খেতে চায় না, তাই আগের মতো বাড়ছে না। মনে রাখতে হবে, জীবনের শুরুতে বাচ্চাদের ওজন দ্রুত বাড়তে থাকে এবং তারপর ধীরে ধীরে হয়। সাধারণত শিশুর জন্ম ওজন ৬ মাস পর দ্বিগুণ এবং ১ বছরে তিনগুণ বৃদ্ধি হয়। প্রথম বছরের শেষে দ্বিতীয় বছরে পা রাখলেই শিশুর শারীরিক বৃদ্ধির হার কমে যায়; তখন ওজন বৃদ্ধি কমে এবং উচ্চতা বৃদ্ধির হার বেশি হয়। এ সময় শিশুর প্রতিদিন একই রকমের খাবারের প্রতি অনীহা দেখা দেয়। এ বয়সে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের খাবারের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই শরীরের বৃদ্ধির হার অনুযায়ী খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করা ঠিক নয়।
যদিও কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক অসুস্থতা অরুচিকর অবস্থার জন্য দায়ী। তখন স্বাভাবিকভাবেই অপুষ্টি দেখা দেয়, রক্তশূন্যতা হয় এবং শারীরিক বৃদ্ধিও ব্যাহত হয়। ঘনঘন সংক্রমণ হয়, ফলে খাওয়ায় রুচি আরও কমে যায়। শিশুর রক্তশূন্যতা হলে, অপুষ্টি থাকলে, শিশুর চঞ্চলতা ও সচলতা কমে যায়।
তবে খাওয়ার ব্যাপারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিছু কিছু অনিয়ম ও খাওয়ানোর অভ্যাসই শিশুর না খেতে চাওয়ার বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতিরিক্ত খাওয়ানো, জোর করে খাওয়ানো, ভুলভাবে খাওয়ানো, খাবারে অ্যালার্জি শিশুর খাবারে অনীহা দেখা দিতে পারে। আবার, অনেক সময় বাচ্চার আবদার মেটাতে গিয়ে অসময়ে অন্য কিছু খাইয়ে দেওয়া অর্থাৎ শিশুকে বিস্কুট, ফল, লজেন্স, আইসক্রিম, চকলেট ইত্যাদি খেতে দেওয়া হয়। অন্যদিকে, অনেকে আবার শিশুকে রুটিনমাফিক বা সময় ধরে খাওয়ান, সময় হলেই খাওয়াতে বসে যান, কিন্তু লক্ষ্য করেন না শিশুর পেটে ক্ষুধা আছে কি নেই। অনেকে আবার শিশুর কান্না শুনলেই মনে করেন, ক্ষুধার জন্য কাঁদছে। অথচ শিশুরা অন্য অনেক কারণেই কাঁদতে পারে। কেউ কেউ তার শিশু একবেলা একটু না খেলেই বেশ অস্থির হয়ে পড়েন। কেউবা আবার পেট ভরে খায়নি বলে একঘণ্টা পরই আবার খাওয়ানোর জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন, এজন্য বাচ্চারা বিরক্ত হয়ে খেতে চায় না, কারণ তার পেটে তখন ক্ষুধা থাকার কথা নয়। এসব অভ্যাসই শিশুর খেতে অনীহা সৃষ্টি করে থাকে।
* শিশুর না খাওয়ার অন্যতম কারণ
▶ পুরোপুরি খিদে না লাগলে শিশুরা সাধারণত খেতে চায় না। এছাড়া ক্রমাগত এবং পুনঃপুন জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা খাবারের প্রতি শিশুদের এক ধরনের অনীহা সৃষ্টি করে।
▶ শিশুদের রুটিনমাফিক খাওয়ানো ভালো। কারণ খাবারের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া যখন তখন তার খিদে লাগার কথা নয়। অনেক শিশু স্কুল থেকে ফিরেই বিস্কুট, ফল বা ফলের রস ইত্যাদি খায়। তার এক ঘণ্টা পরই হয়তো দুপুরের খাবারের সময়। তাই সে হয়তো খেতে চাইবে না। কারণ ইতোমধ্যেই তার খিদে নষ্ট হয়ে গেছে। আবার অনেক শিশু সারাদিন ইচ্ছামতো যখন-তখন বিস্কুট, ফল, লজেন্স, আইসক্রিম ইত্যাদি খেয়ে পেট ভরে রাখে। কিন্তু মূল খাবারের সময় তেমন কিছুই খেতে চায় না। এটা খুবই স্বাভাবিক। অতএব, পিতা-মাতার উচিত রুটিনমাফিক পরিমিত সুষম খাবার খাওয়ানোর দিকে খেয়াল রাখা এবং অবেলায় প্রসেসড ও ফাস্টফুড জাতীয় খাবার খেতে না দেওয়া।
▶ খাবারের স্বাদের দিকে খেয়াল রাখুন। শিশুর পছন্দসই খাবার রান্না করুন। শিশু খাবারের যথাযথ স্বাদের খাবার না পেলে খেতে চাইবে না এবং ওই খাবারের প্রতি তার একধরনের বিরক্তি তৈরি হবে।
▶ সময়সূচি অনুযায়ী খেতে দিন। বয়সভেদে শিশুর ক্ষুধা লাগার সময়ে কিছুটা পার্থক্য আছে। শিশুকে সবসময় নিয়ম বা সময়সূচি অনুযায়ী খেতে অভ্যস্ত করে তুলুন। কী খাওয়াচ্ছেন, তার চেয়ে বড় কথা হলো, কখন খাওয়াচ্ছেন। শিশু খেতে চাইছে না বা খাচ্ছে না, এ অজুহাতে তাকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খাবার দেবেন না। একেবারেই খেতে না চাইলে শিশুর ওজন বাড়ছে কিনা খেয়াল করুন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। যখন-তখন খাবার দিয়ে তার খাবারের প্রতি প্রচণ্ড অনীহা সৃষ্টি করবেন না।
▶ বয়স অনুযায়ী খাবারের বিরতির দিকে লক্ষ্য রাখুন। সাধারণত ৬ মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ দুই থেকে তিন ঘণ্টা বিরতিতে দেওয়া উচিত। ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত বুকের দুধের পাশাপাশি সম্পূরক খাবারে অভ্যস্ত করতে হবে। দুই থেকে তিন বছর বয়সি বাচ্চাদের বিরতির এ সময়ে যদি অন্য কোনো খাবার সে না খায়, তবে যথাসময়ে তার ক্ষুধা লাগার কথা।
▶ অযথা জোর করা একদম উচিত নয়। শিশুকে কখনো জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন না।
▶ খাওয়ার সময় টিভি বা কার্টুন দেখানোর অভ্যাস খুবই খারাপ। শিশুদের টিভি বা কার্টুন দেখিয়ে খাবার খাওয়ালে এগুলোয় সে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এমনিতেই বেশি সময় টিভি দেখা শিশুর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তার ওপর টিভি দেখিয়ে খাওয়ালে শিশুর বদহজম হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। কারণ এ সময় টিভিতে মনোযোগ থাকার কারণে পাকস্থলী থেকে প্রয়োজনীয় পাচক রস নিঃসৃত হয় না।
▶ চেষ্টা করুন খাবারে ভিন্নতা আনতে। প্রতিদিন এক ধরনের খাবার না দিয়ে খাবারে ভিন্নতা আনুন। যদি সে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, তবে যা খেতে চায় তা জেনে নিন। তার পছন্দমতো খাবার স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি করে খেতে দিন।
▶ বাইরের খাবারের বিশেষ করে ফাস্ট ফুডের অপকারিতা সম্পর্কে তাকে বলুন। বাইরের খাবার যে একেবারেই দেবেন না তা নয়। তবে তার জন্য আলাদা করে প্রতিদিন বাইরের খাবার ঘরে আনবেন না বা তাকে বাইরে খেতে নিয়ে যাবেন না।
▶ শিশু কৃমি সংক্রমিত কিনা সে দিকটা লক্ষ্য রাখতে হবে। শিশুর কৃমি সংক্রমণ না খাওয়ার একটা অন্যতম কারণ। নিয়মিত পরিবারের সবাইকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো উচিত। শিশুকে কৃমিমুক্ত রাখলে তার খাওয়ার রুচি ঠিক থাকবে। সবসময় সুষম ও পুষ্টিকর খাবার পরিবেশন জরুরি। খাওয়ার রুচির সঙ্গে পুষ্টিকর খাবার পরিবেশন করলে এবং সুন্দর পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রাখা হলে শিশু ঠিকমতো বেড়ে যায়।
লেখক : শিশুরোগ ও শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, সাবেক অধ্যাপক ও পরিচালক, ঢাকা শিশু হাসপাতাল।