ব্রেস্ট ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি
ডা. আরমান রেজা চৌধুরী রাকেশ
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নারীদের যেসব ক্যানসার সাধারণত হয়ে থাকে, তার মধ্যে স্তন ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ২০২০ সালে পৃথিবীতে ২.৩ মিলিয়ন নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এ সংখ্যাটা মহিলাদের অন্যান্য ক্যানসারের তুলনায় অনেক বেশি এবং এ কারণেই এ স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হারও বেশি।
স্তন ক্যানসারের মৃত্যুর হার কমানোর প্রধান চাবিকাঠি হলো প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ। মহিলাদের প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট সময়ে নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করা, যেটাকে বলা হয় সেলফ ব্রেস্ট পরীক্ষা। নির্দিষ্ট সময় পরপর স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে স্তন পরীক্ষা করানোকে বলা হয় ক্লিনিকাল ব্রেস্ট পরীক্ষা। মেমোগ্রাফি নামক স্তনের একটি পরীক্ষা আছে, সেই ব্যাপারে সচেতন করে তোলা উচিত। ম্যামোগ্রাফি পরীক্ষাটি সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পরে মহিলাদের করতে উপদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু যদি পরিবারে কারও এ স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থাকে, তাহলে এর আগেও কখনো কখনো চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ম্যামোগ্রাফি পরীক্ষা করা যেতে পারে। স্তন ক্যানসার প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করা গেলে এর চিকিৎসা-পরবর্তী ফলাফল অনেক ভালো। ক্যানসারটি যদি শুধু স্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে চিকিৎসা-পরবর্তী ৫ বছর বেঁচে থাকার হার প্রায় ৯৯ শতাংশ।
স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে কীভাবে জীবনযাপন করতে হবে, সে ব্যাপারেও সচেতনতার প্রয়োজন। স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা, নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করা এবং অ্যালকোহল ও তামাক সেবন সীমিত করার মাধ্যমে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমানো সম্ভব।
পাশাপাশি স্তন ক্যানসার নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও নানা ধরনের ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে। এমনকি অনেক সময় অনেক চিকিৎসকদের মাঝেও এ ব্যাপারে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে থাকে। এখনো বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্তন ক্যানসার ডায়াগনসিস হয় এফএনএসি (FNAC) অর্থাৎ স্তনে যে চাকা বা দলা বা টিউমারটি রয়েছে, সেখান থেকে রস নিয়ে পরীক্ষা করার মাধ্যমে। এটি মোটেই একটা স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষা নয়। কারণ, এ পরীক্ষার মাধ্যমে অনেক সময়ই সঠিক রোগ নির্ণয় করা যায় না। স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য আরও যে মলিকুলার টেস্ট অথবা কেমিক্যাল পরীক্ষাগুলো করা প্রয়োজন, সেগুলো এ ফ্লুইড বা রস থেকে করানো সম্ভব হয় না। এর জন্য প্রয়োজন টিস্যু। আর এজন্যই বেস্ট ক্যানসার অর্থাৎ স্তন ক্যানসার নির্ণয়ের প্রধান উপায় হচ্ছে বায়োপসি করা। স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে বায়োপসির মাধ্যমে খুব সহজেই রোগটি নির্ণয় করা যায়, পাশাপাশি রোগের ধরন সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে এর জন্য যে অন্যান্য মলিকুলার টেস্ট এবং কেমিক্যাল পরীক্ষাগুলো করে রোগটিকে ক্লাসিফাইড করা, সেটাও করা সম্ভব হয় এ বায়োসির স্যাম্পল দিয়ে। অনেক সাধারণ মানুষের মধ্যেই ধারণা রয়েছে, বায়োপসি করলে বোধহয় ক্যানসারটি ছড়িয়ে যাবে। এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত একটি ধারণা। বায়োপসি করার সঙ্গে ক্যানসার ছড়িয়ে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
যে কোনো ক্যানসারের ক্ষেত্রেই স্টেজ বা পর্যায় নির্ধারণের আগে এর চিকিৎসা শুরু করা উচিত নয়। সাধারণত স্তন ক্যানসারের যে চারটি স্টেজ বা পর্যায় রয়েছে, সেগুলোর জন্য আলাদা আলাদা চিকিৎসা পদ্ধতি গাইডলাইনে রয়েছে। কাজেই স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা শুরুর আগে এর পর্যায় নির্ধারণের জন্য যেসব পরীক্ষা করা প্রয়োজন, সেগুলো করে নিয়ে এবং এর মলিকুলার অবস্থান জেনেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত। মলিকুলার টেস্ট বা কেমিক্যাল পরীক্ষার পাশাপাশি পর্যায় নির্ধারণের জন্য যে পরীক্ষাগুলো প্রয়োজন যেমন- সিটি স্ক্যান, এমআরআই, বোন স্ক্যান, পেটসিটি স্ক্যান ইত্যাদি বাংলাদেশেই সম্ভব।
গত এক দশকে বিশ্বে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। প্রতিটি স্তন ক্যানসারের রোগীর টিউমারের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এবং ক্যানসারের পর্যায়ের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা নির্ধারণ করতে হয়। সার্জারির ক্ষেত্রেও নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটেছে। পূর্বে যেখানে ব্রেস্ট ক্যানসারের ক্ষেত্রে পুরো ব্রেস্ট কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো সার্জারির উপায় ছিল না, সেখানে এখন অনেক ক্ষেত্রেই স্তনকে অক্ষত রেখে শুধু টিউমার কেটে সরিয়ে ফেলেও ব্রেস্ট ক্যানসারের সার্জারি করা হয়ে থাকে, যেটাকে বলা হয় ব্রেস্ট কনজারভিং সার্জারি। বাংলাদেশে এসব সার্জারির পাশাপাশি অনকোপ্লাস্টিক ব্রেস্ট সার্জারিও কোনো কোনো জায়গায় সফলতার সঙ্গে করা হচ্ছে।
এছাড়া সিস্টেমিক থেরাপি হিসাবে ব্যবহৃত যেমন কেমোথেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি, হরমোন থেরাপি, ইমিউনো থেরাপির মতো আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা বাংলাদেশেও হচ্ছে। রেডিওথেরাপি ব্রেস্ট ক্যানসারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অংশ। স্তন ক্যানসারে রেডিওথেরাপির ক্ষেত্রে যে নতুন নতুন উদ্ভাবনাগুলো হয়েছে, তার প্রায় ৯০ শতাংশ বাংলাদেশেই সম্ভব। থ্রিডিসিআরটি, আইএমআরটি অর্থাৎ ইনটেনসিটি মডিউলেটেড রেডিয়েশন থেরাপি, ভিম্যাট অর্থাৎ ভলিমেট্রিক মডিউলেটেড আর্ক থেরাপি- এসব রেডিও থেরাপির ব্যবস্থা বাংলাদেশেই আছে। একটা সময় যেখানে সব স্তন ক্যানসারের রোগীকে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় সপ্তাহ রেডিও থেরাপির চিকিৎসা নিতে হতো, সেখানে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন বাংলাদেশেই তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে রেডিও থেরাপির চিকিৎসা প্রদান সম্ভবপর হচ্ছে। পাশাপাশি কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এক সপ্তাহের মধ্যেও রেডিওথেরাপির চিকিৎসা শেষ করার যে সর্বাধুনিক উদ্ভাবনা, সেই পদ্ধতিতেও চিকিৎসা করা হচ্ছে।
আসুন এ স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাসে বেস্ট ক্যানসার সচেতনতা নিয়ে শুধু কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে এটিকে নিয়ে আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করি। প্রতিটি নারীকে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, স্ক্রিনিং করানো এবং চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া উচিত।
লেখক : ক্যানসার বিশেষজ্ঞ, সিনিয়র কনসালটেন্ট, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা।