গর্ভকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়
অধ্যাপক ডা. আফজালুন্নেসা চৌধুরী
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সন্তান জন্মদান একজন নারীর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দময় মুহূর্ত। প্রত্যেক গর্ভবতী নারী চান একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করতে। এজন্য গর্ভবতী মা ও তার অনাগত সন্তানের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গর্ভকালীন যত্ন অপরিহার্য। গর্ভবতী মায়ের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা এবং গর্ভকালীন ঝুঁকিগুলো প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতার পাশাপাশি নিজে সচেতন হওয়া জরুরি।
* গর্ভাবস্থায় নারীর শারীরিক ও মানসিক জটিলতা
গর্ভবতী নারী বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকেন। এসময় শরীর কখনো সুস্থ থাকে, কখনো অসুস্থ। মনও থাকে বিষণ্ন। গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরে যেসব পরিবর্তন দেখা যায়-
▶ ওজন বেড়ে যায়। বমি বমি ভাব হয়, বিশেষ করে সকালের দিকে।
▶ স্তনের আকার পরিবর্তন হয় ও স্তনের চারপাশ কালো হয়ে যায়।
▶ রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
▶ পেট ভারী হয়ে যায়।
▶ অনেকের উচ্চরক্তচাপ হয়ে থাকে।
▶ জরায়ুর আকার বড় হয়ে যায়। ফলে মূত্রথলিতে চাপ পড়ে ও বারবার প্রস্রাব হয়।
▶ রক্তশূন্যতা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
▶ পায়ে পানি জমে পা ফুলে যায়।
▶ খিঁচুনির ঝুঁকি বেড়ে যায়।
▶ হরমোনজনিত সমস্যায় একজন গর্ভবতী নারী বেশিরভাগ সময়ই মানসিক বিষণ্নতায় ভুগে থাকেন। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় ও কাজকর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। মানসিক অস্থিরতা অনুভব করেন, কান্নাকাটি করেন, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তাও করে থাকেন।
সাধারণত, এ সমস্যাগুলো বেশিরভাগ গর্ভবতী নারীরই হয়ে থাকে। কিন্তু গর্ভাবস্থায় কোনো নারীর যদি যোনিপথে রক্তপাত ও ব্যথা, খিঁচুনি, তীব্র মাথাব্যথা ও চোখে ঝাপসা দেখা, অতিরিক্ত বমি ও একদমই খেতে না পারা, বুকব্যথা বা বুক ধড়ফড় করা, শরীরে পানি জমে শরীর ফুলে যাওয়া, অতিরিক্ত ক্লান্তি এসব জটিলতা দেখা যায়, তাহলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং সমস্যা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
* নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য গর্ভবতী নারীর সঠিক পরিচর্যা
সুস্থ সন্তান জন্মদানের জন্য গর্ভবতী মায়ের সুস্থতা জরুরি। এজন্য গর্ভাবস্থায় নারীর চাই সঠিক পরিচর্যা। এজন্য কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে।
* গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পরীক্ষা
গর্ভাবস্থায় প্রত্যেক নারীর কমপক্ষে চারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত। এতে মা ও গর্ভের শিশুর শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে আগে থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। গর্ভবতী মাকে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এজন্য নির্দিষ্ট সময় পরপর ওজন পরিমাপ করতে হবে। গর্ভাবস্থায় করা যায়, এমন ব্যায়াম করা যেতে পারে। রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। রক্তশূন্যতা আছে কিনা, রক্তে ডায়াবেটিস, হেপাটাইটিস-বি ও সিফিলিসের উপস্থিতি আছে কিনা, তা জানার জন্য নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। গর্ভাবস্থায় তিনবার আলট্রাসনোগ্রাম করা উচিত। এ পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুতে সঠিকভাবে গর্ভধারণ হয়েছে কিনা, শিশুর শারীরিক বিকাশের হার, শিশুর কোনো শারীরিক ত্রুটি আছে কিনা, গর্ভফুল ও গর্ভের শিশুর অবস্থান, একের বেশি বাচ্চা আছে কিনা, বাচ্চা প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ মাসিকের তারিখের সঙ্গে সংগতি আছে কিনা, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। গর্ভবতী মাকে লিভার, কিডনি, হৃৎপিণ্ড ও থাইরয়েড পরীক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া গর্ভাবস্থার ৪ থেকে ৮ মাসের মধ্যে দুই ডোজ টিটি টিকা দিতে হবে। তবে আগে থেকেই টিটি টিকার পূর্ণ ডোজ নেওয়া থাকলে আর টিকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
* খাদ্য হতে হবে সুষম ও পুষ্টিকর
গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য জটিলতা প্রতিরোধে ও গর্ভের শিশুর গঠন ও বিকাশে সুষম খাবার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় অনেকেরই অরুচি হয়। এ ক্ষেত্রে অল্প অল্প করে কয়েকবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, ওজন যেন বেড়ে না যায়। অতিরিক্ত তেল, চর্বি ও চিনিযুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো। এতে ওজন বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি হার্টের নানা রোগ ও ডায়াবেটিস হতে পারে। এড়িয়ে চলতে হবে প্রক্রিয়াজাত খাবার ও অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়। অ্যালার্জি হয় এমন খাবার পুরোপুরি বাদ দিতে হবে। শর্করা জাতীয় খাবার, দুধ, সবুজ শাকসবজি, ফলমূল ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে খাদ্যতালিকায়। ত্বক, রক্তনালি ও হাড় সুস্থ রাখতে ভিটামিন সি ও ভিটামিন ডি খেতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। গর্ভাবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট, আয়রন ট্যাবলেট ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া উচিত। গর্ভবতী মায়ের খাবার রান্নার সময়ও বাড়তি সতর্কতা জরুরি। রান্না করার পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে। মাছ, মাংস, শাকসবজি রান্নার আগে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। সব সময় চেষ্টা করতে হবে টাটকা খাবার খাওয়ার। ফ্রিজে বেশি দিন সংরক্ষিত খাবার না খাওয়া ভালো।
* গর্ভাবস্থায় চাই সঠিক পারিবারিক যত্ন
গর্ভবতী নারীর প্রতি পারিবারিক সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভবতী মাকে সময় দেওয়া, তাকে আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করা পরিবারের দায়িত্ব। এজন্য পরিবারের সদস্যদের উচিত গর্ভবতী মাকে-
▶ হাসি-খুশি রাখা।
▶ পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ করে দেওয়া।
▶ মানসিক চাপমুক্ত রাখা।
▶ পুষ্টিকর ও সুষম খাবার নিশ্চিত করা।
▶ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখা।
▶ মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখা।
▶ অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া।
নারীর গর্ভকালীন যত্ন মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধ করতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন, সাবেক অধ্যাপক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল।