টার্নার সিনড্রোম
কন্যাশিশুর কম উচ্চতা
অধ্যাপক ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কন্যাশিশুর কম উচ্চতা
টার্নার সিনড্রোম কন্যাশিশুর জন্মগত ত্রুটি। জন্মের পর অন্য শিশুদের মতো এ রোগের শিশুরা স্বাভাবিক বিকাশ লাভ করতে পারে না। এমনকি এ শিশুরা ত্রুটিযুক্ত ডিম্বাশয় নিয়ে বেড়ে ওঠার কারণে সময়মতো তাদের বয়ঃসন্ধি হয় না। প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগেরই সময়মতো মাসিক শুরু হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় এ রোগ তখন নির্ণয় হয়, যখন বয়স হয়ে যাওয়ার পরও উচ্চতা বৃদ্ধি না হলে বা বয়ঃসন্ধি না এলে, এ সমস্যায় শিশুকে অভিভাবকরা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসেন। কম উচ্চতা, ত্রুটিযুক্ত ওভারি, ছোট যৌনাঙ্গ, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ, কিডনি জটিলতাসহ নানা লক্ষণ দেখা দেয়।
* টার্নার সিনড্রোম কী
সাধারণত স্বাভাবিক মানবদেহে ৪৬টি ক্রোমোজম থাকে। কিন্তু টার্নার সিনড্রোমে শিশু ভ্রুণ থেকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ার সময় একটা এক্স ক্রোমোজম হারিয়ে যায় বা পরিবর্তিত হয়। তাই এতে আক্রান্ত শিশুদের ৪৬টির পরিবর্তে ৪৫টি ক্রোমোজম থাকে। অর্থাৎ একটি এক্স ক্রোমোজম অনুপস্থিত থাকে। ফলে শিশু নানা ত্রুটিযুক্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এ শিশুরা বড় হতে থাকে নানা শারীরিক জটিলতা নিয়ে। ত্রুটিযুক্ত ডিম্বাশয়ের কারণে সময়মতো বয়ঃসন্ধি আসে না। অন্য শিশুদের তুলনায় তারা লক্ষণীয়ভাবে কম উচ্চতার হয়।
** লক্ষণ ও উপসর্গ
* খর্বাকৃতি বা বয়সের তুলনায় ঠিকমতো উচ্চতা বাড়ে না।
* হাত-পা ফুলে যায়।
* ঘন ঘন কান পাকা সমস্যা দেখা দেয়।
* ত্রুটিযুক্ত ডিম্বাশয় ও ক্ষুদ্র যৌনাঙ্গ।
* বয়ঃসন্ধি না পাওয়া।
* গলায় ভাঁজ ও ছোট থুতনি।
* ঢেউ খেলানো বা কোঁচকানো ঘাড়। ঘাড়ের আয়তন কম।
* চওড়া বুক বা স্তন যুগলের মধ্যে বেশি দূরত্ব।
* স্তনবৃত্ত স্বাভাবিক অবস্থানে থাকে না।
* বয়স বাড়তে থাকলে পা ও মেরুদণ্ড বেঁকে যায়।
** রোগ নির্ণয়
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বয়ঃসন্ধি না পাওয়া বা মাসিক শুরু না হওয়ার জটিলতা নিয়ে রোগী চিকিৎসকের কাছে আসেন। যদিও লক্ষণ বা উপসর্গ দেখেই চিকিৎসক বুঝতে পারেন, এটি টার্নার সিনড্রোমের কারণে হচ্ছে। তবু নিশ্চিত হতে কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে ক্রোমোজমের পরীক্ষা ক্যারিয়োটাইপিং করা হয়। পাশাপাশি গোনাডোট্রপিন ও সেক্স হরমোনের সঙ্গে জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের আলট্রাসনোগ্রাম করার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়াও জন্মের আগেই টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্ত গর্ভস্থ শিশুকে চিহ্নিত করা যায়। সেক্ষেত্রে সন্তান মায়ের পেটে আসার ১০ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে আলট্রাসনোগ্রাম, সিভিএস টেস্ট ও অ্যামিওসেন্টেসিস টেস্ট করে নিশ্চিত হতে হয়।
* চিকিৎসা
টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুকে ৭ থেকে ১০ বছর বয়সের মধ্যেই গ্রোথ হরমোন থেরাপি দিয়ে উচ্চতা বৃদ্ধির চিকিৎসা দেওয়া হয়। খুব ছোট বয়সে এই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হলে এ থেরাপি বেশি কার্যকর হয়। যত দ্রুত থেরাপি শুরু করা যায়, এতে ততটাই উচ্চতা বৃদ্ধি ও হাড়ের গঠনের উন্নতি সাধন সম্ভব হয়।
* ইস্ট্রোজেনথেরাপি
টার্নার সিনড্রোমের চিকিৎসায় আরেকটি ধাপ হলো-ইস্ট্রোজেনথেরাপি। এ পদ্ধতিতে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাধ্যমে বয়ঃসন্ধিজনিত সমস্যার চিকিৎসা করা হয়। চিকিৎসা ১০-১১ বছরের মধ্যেই শুরু করতে পারলে ভালো হয়। ইস্ট্রোজেনথেরাপি স্তন সমস্যার সমাধান ও জরায়ুর আকার বৃদ্ধি করে। টার্নার সিনড্রোমের রোগীদের মধ্যে খুব অল্প নারী চিকিৎসা ছাড়াই গর্ভধারণে সক্ষম হন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই ত্রুটিযুক্ত ডিম্বাশয় নিয়ে বেড়ে ওঠার ফলে গর্ভধারণ করতে ব্যর্থ হয়। এ ক্ষেত্রে এমব্রায়ো পদ্ধতি সহায়ক হতে পারে। কিন্তু টার্নার সিনড্রোমের রোগীর গর্ভধারণ-সংক্রান্ত জটিলতা খুব বেশি থাকায়, সফলতার হার খুবই কম। এ ছাড়াও টার্নার সিনড্রোমে শিশুর উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসারও প্রয়োজন হয়। এই রোগে শিশুর উচ্চ রক্তচাপ, কান, হাড়ের সমস্যা, কোলেস্টেরল ও থাইরয়েডের চিকিৎসা দরকার পড়ে।
লেখক : মেডিসিন, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল।