শিশুর ডায়রিয়া হলে কী করবেন
অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সহজ কথায় বলতে গেলে ঘন ঘন বা সাধারণত ২৪ ঘণ্টায় ৩ বার বা তারও বেশিবার পাতলা পায়খানা হওয়াকে ডায়রিয়া বলে। মলে পানির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়া ডায়রিয়ার আবশ্যিক শর্ত। শুধু মায়ের দুধ পান করে, এমন শিশু অনেক সময় দিনে ৫-১০ বার পর্যন্ত পায়খানা করতে পারে যা পেস্টের মতো সামান্য তরল, একে ডায়রিয়া বলা যাবে না। তবে অনেকবার পাতলা পায়খানা, বারবার বমি, অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত, খাদ্য বা পানীয় গ্রহণে অনীহা, পায়খানায় রক্ত, চোখ বসে গেছে এবং যদি ৩ দিনের মধ্যেও অবস্থার উন্নতি না হয় তাহলে শিশুকে শিশুচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। বিস্তারিত লিখেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী
* ডায়রিয়ার ধরন
▶ তীব্র ডায়রিয়া : হঠাৎ শুরু হয়ে কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিন স্থায়ী হয়। তবে কখনো ১৪ দিনের বেশি নয়।
▶ দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া : শুরু হওয়ার পর ১৪ দিন বা তারও বেশি সময়, কখনো কয়েক মাস ধরে চলতে থাকে।
▶ জলীয় ডায়রিয়া : মল খুবই পাতলা হয়, ক্ষেত্রবিশেষে একেবারে পানির মতো। মলে কোনো রক্ত থাকে না। আমাশয় বা ডিসেন্ট্রি-মলে রক্ত থাকে যা চোখে দেখা যায়।
* ডায়রিয়ার কারণ
কতকগুলো রোগজীবাণু খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে ডায়রিয়া ঘটায়। আমাদের দেশে এগুলো হচ্ছে- ভাইরাস-রোটাভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া-ই-কোলাই, সিগেলা, ভিবরিও কলেরা, প্যারাসাইট-এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা ও জিয়ারডিয়া।
* জীবাণু কীভাবে খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে
খাদ্য বা পানীয় বস্তু, অপরিষ্কার হাত, গ্লাস, চামচ, বাসনপত্র বা সচরাচর ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিসপত্র, মল, মাছি ইত্যাদির মাধ্যমে।
* ডায়রিয়ার পরিণতি
তাৎক্ষণিক পরিণতি হচ্ছে পানিস্বল্পতা এবং সময়মতো চিকিৎসা না পেলে মৃত্যু। পরবর্তীতে অপুষ্টি এবং রাতকানা, অন্যান্য রোগ।
* ডায়রিয়া হলে কীভাবে পানিস্বল্পতা নির্ণয় করবেন
ডায়রিয়াকালীন শিশুর শরীর থেকে পানি ও জলীয় অন্যান্য পদার্থ বেরিয়ে যাওয়ার কারণে দেহে পানিস্বল্পতা দেখা দেয়। ডায়রিয়ার তীব্রতা এ পানিস্বল্পতার পরিমাণ বিভিন্ন স্তরের হতে পারে। শিশুর অবস্থা লক্ষ্য করে এবং শিশুর পেটের চামড়া ধরে ছেড়ে দিয়ে এই স্তরগুলো নির্ণয় করে শরীরে পানি-ঘাটতির সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়।
* পানিস্বল্পতা নেই কীভাবে বুঝবেন
▶ অবস্থা ভালো ও সজাগ।
▶ চোখ স্বাভাবিক ও পানি থাকবে।
▶ মুখ ও জিহ্বা ভেজা থাকবে।
▶ স্বাভাবিকভাবে পানি পান করবে।
▶ পেটের চামড়া ধরে ছেড়ে দিলে সেটা দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে।
* ‘পানিস্বল্পতা নেই’ স্তরের রোগীর চিকিৎসা, পানিস্বল্পতা প্রতিরোধ
▶ প্রয়োজনমতো খাবার স্যালাইন বা লবণ-গুড়ের শরবত : শিশুর বয়স যখন ২ বছরের কম, প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ৫০-১০০ মি.লি. (আধা-১কাপ) প্রতি ১-২ মিনিটে ১ চামচ হিসাবে খাওয়াতে হবে। বয়স ২ বছর থেকে ১০ বছরের মধ্যে হলে, প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর যতটুকু খেতে চায় চুমুক দিয়ে আস্তে আস্তে খেতে দিতে হবে। যদি বমি করে তবে ৫-১০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এরপর আবার খুব আস্তে আস্তে প্রতি ২-৩ মিনিট পরপর ১ চামচ করে খাওয়াতে হবে।
▶ শিশু যতটুকু খেতে পারে ততটুকু অন্যান্য তরল খাবার খাওয়ানো যেতে পারে। যেমন-ভাতের মাড়, পানি, ডাবের পানি কিংবা শুধু পানি।
* কিছু পানিস্বল্পতা তা কীভাবে বুঝবেন
▶ অস্থির খিটখিটে হবে।
▶ চোখ বসে যাবে ও পানি শুকিয়ে যাবে।
▶ মুখ ও জিহ্বা শুকনো থাকবে।
▶ তৃষ্ণার্ত থাকবে ও আগ্রহভরে পানি পান করবে।
▶ পেটের চামড়া ধরে ছেড়ে দিলে সেটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়।
* কিছু পানিস্বল্পতা স্তরের রোগীর চিকিৎসা
প্রথম ৪ ঘণ্টায় প্রয়োজনমতো খাবার স্যালাইন দিতে হবে। বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। প্রতি ১ ঘণ্টা পর পর রোগীকে পরীক্ষা করা এবং পানিস্বল্পতার স্তর নির্ণয় করে সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
* চরম পানিস্বল্পতা কীভাবে বুঝবেন
▶ অবসন্ন, নেতিয়ে পড়া, অজ্ঞান কিংবা ঘুমঘুম ভাব থাকবে।
▶ চোখ বেশি বসে যাবে ও শুকনো দেখাবে।
▶ মুখ ও জিহ্বা খুব শুকনো থাকবে।
▶ পানি পান করতেও কষ্ট হবে কিংবা একেবারেই পারবে না।
▶ পেটের চামড়া ধরে ছেড়ে দিলে অত্যন্ত ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে।
* ‘চরম পানি স্বল্পতার’ দ্রুত চিকিৎসা :
দ্রুত শিরায় স্যালাইন দিতে পারলে উত্তম। শিশুর প্রতি কেজি ওজনের জন্য ১০০ মিলি কলেরা স্যালাইন (যদি না থাকে নরমাল স্যালাইল) প্রয়োজন হবে। রোগী পান করতে সক্ষম হওয়া মাত্র খাবার স্যালাইন ও ৫ মিলি/কেজি/ঘণ্টা হিসাবে দিতে শুরু করুন।
* প্যাকেট স্যালাইন শরবত তৈরির পদ্ধতি
ডায়রিয়ায় খাবার স্যালাইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি বানাতে আধা লিটারের চেয়ে বেশি পানি ধরে এমন একটি পাত্র এবং আধা লিটার পানি মাপা যায় এরকম একটি গ্লাস বা অন্য কোনো পাত্র পানি দিয়ে ভালো মতো পরিষ্কার করে নিন। স্যালাইন প্যাকেটের উপরের অংশ কেটে সবটুকু গুঁড়া স্যালাইন তৈরির জন্য পরিষ্কার পাত্রের মধ্যে এমনভাবে ঢেলে নিন যাতে প্যাকেটের মধ্যে দানা না থাকে। পাত্রে আধা লিটার পানি ঢেলে নিন। স্যালাইন ভালো করে গুলে নিন যাতে কোনো তলানি না থাকে। সাধারণত সঠিকভাবে তৈরি করা স্যালাইনের স্বাদ হয় চোখের পানির মতো, নিজে খেয়ে দেখে নিন তৈরি করা স্যালাইনের স্বাদ কেমন হলো।
* যেটার প্রতি গুরুত্ব দেবেন বেশি
▶ ডায়রিয়া হলে পুষ্টিহীনতা যাতে না হয় সেজন্য শিশুকে প্রচুর খাবার দেওয়া প্রয়োজন।
▶ বুকের দুধ চালিয়ে যেতে হবে এবং ঘন ঘন খাওয়াতে হবে। শিশু অন্য দুধে অভ্যস্ত হলে তাই খাওয়াতে হবে প্রতি ঘণ্টা পরপর।
▶ টাটকা খাবার : যে বয়সের জন্য যে খাবার স্বাভাবিক তা-ই খাওয়াতে থাকুন। উপযোগী খাদ্য-ডাল, ভাত, শাকসবজি, ডিম, মাছ, মাংস অথবা এসবের খিঁচুড়ি। খাবারের সঙ্গে ১ বা ২ চামচ তেল মেশান।
▶ টাটকা ফলের রস : কলা বা পেঁপে চটকিয়ে দিন। ৩-৪ ঘণ্টা পরপর দিনে অন্তত ৬ বার খেতে দিন। খাদ্য নরম করে রান্না করুন যাতে সহজে হজম হয়।
* শিশুর ডায়রিয়া হওয়া এড়াতে
ডায়রিয়া প্রতিরোধে অতি গুরুত্বপূর্ণ ৭টি বিষয় মেনে চললে এর প্রকোপ অনেক কমে যায়। সেগুলো হলো-
▶ হাত ধোয়া ও অন্যান্য ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা পালন।
▶ সাবান ও যথেষ্ট পরিমাণ পরিষ্কার পানি দিয়ে পরিবারের সবাইকে ভালো মতো হাত ধোয়ার অভ্যাস করাতে হবে।
কখন হাত ধুতে হবে-
▶ শিশুকে খাওয়ানোর আগে
▶ পায়খানা করার পরে
▶ শিশুর পায়খানা পরিষ্কার করার পরে
▶ রান্না করার আগে
▶ খাবার পরিবেশন করার আগে
▶ অন্যান্য ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা যেমন-শিশুর ও নিজের নিয়মিত নখ কাটা, প্রতিদিন গোসল, বাচ্চাকে দুধ দেওয়ার আগে স্তন পরিষ্কার ইত্যাদি পালন করা।
▶ জন্মের প্রথম ৬ মাস পর্যন্ত শিশু শুধু বুকের দুধ খাবে। বুকের দুধ খাওয়ালে শিশুর ডায়রিয়া হয় না, কারণ বুকের দুধ জীবাণুমুক্ত শিশুরোগ প্রতিরোধকারী। বোতলে দুধ খাওয়ালে ডায়রিয়া বেশি হয়। কারণ বোতল সব সময় পরিষ্কার রাখা কখনোই সম্ভব নয়।
▶ ৬ মাস বয়স হওয়ার পর শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার পরিবারের সবাই যা খায় তা নরম করে পরিবেশন করে খাওয়াতে হবে।
▶ নিরাপদ পানি ব্যবহার করা : সাধারণত টিউবওয়েলের পানি বা ফোটানো পানি নিরাপদ। টিউবওয়েলের কাছে গোসল, ধোয়ামোছা বা মলমূত্র ত্যাগ করা যাবে না। পায়খানা অবশ্যই টিউবওয়েলের ১০ মিটার দূরে ও নিচুতে হতে হবে ও পশুর নাগালের বাইরে রাখা উচিত। পরিষ্কার পাত্রে পানি সংগ্রহ করা উচিত। মূল পাত্র থেকে পানি তোলার জন্য ব্যবহৃত মগ আলাদা থাকা দরকার।
▶ শিশুর বয়স ৯ মাস পূর্ণ হলেই হামের টিকা দিতে হবে। হাম আক্রান্ত শিশু সহজেই ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়।
▶ স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তৈরি করতে হবে এবং বাড়ির ছোটবড় সবাইকে পায়খানায় মলত্যাগ করতে হবে। পায়খানায় যেন মাছি না ঢুকতে পারে এবং মল যেন ডোবা, পুকুর, নদী বা ব্যবহার করার পানির সঙ্গে না মেশে, এরূপভাবে পায়খানা তৈরি করতে হবে।
▶ বাচ্চাদের মল দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। ছোট শিশুদের পায়খানা বড়দের মতোই রোগ ছড়াতে পারে, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি। তাই শিশু পায়খানা করার পরপরই তা তুলে নিয়ে বড়দের ল্যাট্রিনে ফেলতে হবে। পায়খানা করার পর শিশুদের পরিষ্কার করে সে পানিও ল্যাট্রিনে ফেলতে হবে।