দীর্ঘদিনের কোমর ব্যথায় চিকিৎসা
‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এ প্রতিপাদ্যে ৭ এপ্রিল ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। মূলত সার্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সবাইকে সচেতন করতে এ দিবস। এ নিয়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন দেশের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
ডা. মোহাম্মদ আলী
প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
কোমর ব্যথা বর্তমান বিশ্বে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বিরাট হুমকি। জীবনে একবারও কোমর ব্যথায় ভোগেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। আগে ভাবা হতো কোমর ব্যথা উন্নত বিশ্বের একটি রোগ এবং যারা শুধু বসে কাজ করেন বা ভারী কাজ করেন শুধু তাদেরই কোমর ব্যথা হয়।
কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল ল্যানসেটের গবেষণা বলছে গতদশকে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের দেশগুলোতে কোমর ব্যথার প্রাদুর্ভাব আগের থেকে কয়েকগুণ বেড়েছে এবং এশিয়া ও আফ্রিকার নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশগুলো কোমর ব্যথা রোগের কেন্দ্রস্থলে চলে আসছে।
প্লাস ওয়ান জার্নাল, এনালস অব মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি জার্নাল ও জার্নাল অব অকুপেশনাল হেলথ প্রকাশিত গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রায় প্রতি ২.৫ জন মানুষের মধ্যে একজন কোমর ব্যথাজনিত সমস্যায় ভুগে থাকেন। বিপুল পরিমাণ মানুষ যেমন কোমর ব্যথায় ভোগেন, ঠিক তেমনি এ সমস্যার চিকিৎসা খরচও অনেক বেশি। কোমর ব্যথার কারণে সারা পৃথিবী বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ ব্যথা সাধারণত তিন ধরনের-স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি। যে ব্যথার বয়স তিন মাস বা তার বেশি তাকে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা বলে এবং কোমর ব্যথার বেশিরভাগ রোগীই দীর্ঘমেয়াদি ব্যথায় ভোগেন।
* চিকিৎসা
দীর্ঘমেয়াদি কোমর ব্যথার চিকিৎসা জটিল। এ ব্যথার জন্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের চিকিৎসা প্রচলিত আছে। তবে নিরঙ্কুশভাবে কাজ করে এমন কোনো একক চিকিৎসা পদ্ধতি দীর্ঘমেয়াদি কোমর ব্যথা ভালো করতে পারে না। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ ধরনের ব্যথার চিকিৎসায় পারসোনালাইজড চিকিৎসা ও সমন্বিত চিকিৎসার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
* পারসোনালাইজড চিকিৎসা কী
আমাদের সবার আঙুলের ছাপ ভিন্ন। একজনের ফিঙ্গার প্রিন্ট বা আঙুলের ছাপের সঙ্গে যেমন অন্যজনের ছাপের মিল নেই, ঠিক তেমনি একেক জনের ব্যথা একেকভাবে শরীরে বাসা বাঁধে এবং তা ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। এখন বিভিন্ন শারীরিক, প্যাথলজিক্যাল ও রেডিওলোজিক্যাল পরীক্ষা ও রোগীর ইতিহাস গ্রহণ করে ব্যথার ধরন নির্ণয় করে যে চিকিৎসা দেওয়া হয় সেটাই পারসোনালাইজ চিকিৎসা। এ ক্ষেত্রে একেকজনের চিকিৎসা হয় একেক ধরনের। যেমন-অনেক রোগী আছেন যাদের বসার চেয়ার পরিবর্তন করে কয়েকটি বিশেষায়িত ব্যায়াম করলেই ব্যথা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে; আবার অনেকের প্রয়োজন হয় ইলেকট্রোথেরাপির। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাইফস্টাইল মোডিফিকেশন বা জীবনধারায় পরিবর্তন প্রয়োজন হয়। এমনই ভিন্ন ভিন্ন চিকিৎসা ভিন্ন ভিন্ন রোগীদের জন্য প্রয়োজন হয়, আর এর সবকিছুই নির্ভর করে রোগ নির্ণয়ের ওপর।
* বাংলাদেশে কোমর ব্যথার চিকিৎসা
এদেশে কোমর ব্যথার চিকিৎসা হচ্ছে মূলত ব্যথার ওষুধ বা পেইন কিলারনির্ভর। এদেশে পেইন কিলার যাকে অনেকে পেইন কিলিয়ার বা ব্যথা পরিষ্কারক নামে ডেকে থাকেন; তা খুবই জনপ্রিয়। ব্যথা হলেই রোগী ফার্মেসিতে গিয়ে ব্যথানাশক কিনে এনে খেতে থাকেন। সাধারণত ব্যথার ওষুধ কাজ না করলে রোগী চিকিৎসকের কাছে যান। তবে বাংলাদেশে কোমর ব্যথা চিকিৎসায় চিকিৎসকরা সবাই মেনে চলবেন এমন ধরনের কোনো নীতিমালা নেই। এদেশে তাই কোমর ব্যথার চিকিৎসা বিভিন্নভাবে করা হয়। অনেক চিকিৎসক ব্যথার ওষুধ বা এনএসআইডি, গ্যাবাজেরিক, মাসল রিল্যাক্স্যান্ট ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে থাকেন। অনেকে সার্জারির ওপর জোর দেন। অনেকে মেশিনের মাধ্যমে ফিজিওথেরাপি, ম্যানুয়াল থেরাপি বা থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কোমর ব্যথা ভালো করতে চান। ২০২২ সালে প্রকাশিত ফিজিওথেরাপি প্র্যাকটিস আ্যন্ড রিসার্চ জার্নালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় বাংলাদেশে কোমর ব্যথার জন্য যেসব চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, উন্নত বিশ্বে তা প্রায় সম্পূর্ণ অচল। এর ফলে কোমর ব্যথা রোগী উপকার তো পানই না বরং রোগী আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন।
* বিশ্ব পরিস্থিতি ও আমাদের সম্ভাবনা
বাংলাদেশ চিকিৎসাসেবা দ্রুত এগিয়ে চলেছে। গতকয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। মানুষের উন্নত ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত হয়েছে বটে কিন্তু তা মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। সত্যি বলতে যারা উন্নত ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা চান তারা এ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর এখনো পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছেন না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়; অনেক চিকিৎসকই দীর্ঘমেয়াদি কোমর ব্যথা চিকিৎসায় সারা বিশ্বে অচল শর্টওয়েভ বা মাইক্রোওয়েভের মতো মেশিন দিয়ে চিকিৎসা করতে চান, যা রোগীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়না। এছাড়া রোগ নির্ণয় না করেই নানা ধরনের অবৈজ্ঞানিক ব্যায়াম বা ম্যানিপুলেশন করে থাকেন। অনেকে আবার বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটারাইজড মেশিনভিত্তিক চিকিৎসা করে রোগী ভালো করতে চান যার কোনোটিই বিজ্ঞানসম্মত বা পারসোনালাইসড চিকিৎসা বলে প্রমাণিত নয়। এসব কারণেই প্রতিমাসে বিপুল পরিমাণ রোগী বাংলাদেশ থেকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার আশায় চলে যান।
* সরকারের করণীয়
অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা তো বটেই, অনেক স্বল্পন্নোত দেশেও কোমর ব্যথার চিকিৎসা চলে সরকার অনুমোদিত নীতিমালার মাধ্যমে। এসব নীতিমালা সাধারণত প্রস্তুত করা হয় ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়াল ও নির্ভরযোগ্য গবেষণার মাধ্যমে। এ নীতিমালাগুলো রোগীর স্বার্থ রক্ষা করে। কম খরচে সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসাগুলো সাধারণত নীতিমালায় অনুমোদন পায় এবং চিকিৎসকরা এ নীতিমালার মধ্যে থেকেই চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে এ ধরনের নীতিমালা এখন সময়ের দাবি। দীর্ঘমেয়াদি কোমর ব্যথার রোগীরা যাতে ব্যবসার উপকরণে পরিণত না হন এবং তাদের শারীরিক ও আর্থিক স্বার্থ যাতে রক্ষা হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশ সরকারের উচিত নীতিমালা প্রণয়ন করা। সে সঙ্গে কোমর ব্যথা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের উন্নত চিকিৎসা প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন যাতে তারা তাদের রোগীর জন্য সেরা চিকিৎসা বেছে নিতে পারেন।
* রোগীরা কী করবেন
রোগীদের সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশেও অনেক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। যথাসম্ভব একজন দক্ষ চিকিৎসক নির্বাচন করে তার পরামর্শমতো চিকিৎসা নিতে হবে। যত্রতত্র ক্ষতিকর ব্যথানাশক ওষুধ, অবৈজ্ঞানিক ব্যায়াম, মেশিনের চিকিৎসা ও ম্যানুপুলেশন করা যাবে না। ইদানীং অনেকই ইউটিউব দেখে নিজেই নিজের চিকিৎসা করা শুরু করেন যা বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই এসব ক্ষেত্রেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
লেখক : কোমর ব্যথাবিষয়ক গবেষক ও চিকিৎসক, লা ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া, কনসালট্যান্ট ও বিভাগীয় প্রধান, ফিজিওথেরাপি বিভাগ, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা।