Logo
Logo
×

একুশের বিশেষ আয়োজন

ক্লিওপেট্রা, সম্রাট সিজার ও বাঙালির বইমেলা

Icon

সাইফুর রহমান

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ক্লিওপেট্রা, সম্রাট সিজার ও বাঙালির বইমেলা

ফাইল ছবি

একজন মানুষের জীবনে তিনটি জিনিস প্রয়োজন বই, বই এবং বই। এ উক্তিটি করেছিলেন বিশ্ববরেণ্য রুশ লেখক লিও তলেস্তয়। সচেতন মানুষ মাত্রই অবগত আছেন তার এ উক্তিটি বর্তমান সময়ে কতটা প্রনিধানযোগ্য। বইয়ের কথা উঠলেই প্রসঙ্গক্রমেই চলে আসে বইমেলার কথা। বইমেলা নিঃসন্দেহে আমাদের জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ।

কারণ, এ উৎসবটি মানুষের মনে সাধারণত বই পড়ার গুরুত্ব ও আগ্রহ জাগ্রত করে একই সঙ্গে বই পঠনে পাঠকের হৃদয়ে প্রথিত হয় জ্ঞানের আলো। ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁক দারিদা যথার্থই বলেছেন-‘একটি ভালো বই পড়া মানে হচ্ছে বিগত শতাব্দীর মহৎ লেখকের সঙ্গে আলাপ করা।’ বইপড়ার গুরুত্ব যে কতটুকু সেটি ইতিহাসের আলোকে দু-একটি ঘটনার মাধ্যমে অনুধাবন করা যেতে পারে। বড় বড় সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীরা মাথা গুঁজে বই পড়বেন সেটা অতিস্বাভাবিক বিষয়।

কিন্তু, যখন রাজাগজা, সম্রাট, বণিক ও রাজনীতিবিদরা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রন্থপাঠ করেন তখন বুঝতে হবে বইয়ের মধ্যেই নিহিত আছে পৃথিবীর প্রায় সব সমস্যার সমাধান। দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার ছিলেন একজন নিবিষ্ট পাঠক। দার্শনিক এরোস্টোটল ছিলেন তার শিক্ষক। সে কারণেই বোধকরি বইয়ের গুরুত্ব তিনি কিশোর বয়সেই উপলব্ধি করেছিলেন। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট জীবনে বহু বই পড়েছেন। কী কী বই পড়েছেন তিনি সে বিষয় নিয়ে পৃথক একটি প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে।

তবে যে বইটা তিনি বারবার পড়তেন সেটা ছিল হোমারের ইলিয়ড। আলেকজান্ডার পারস্য জয় করেছিলেন ৩৩৪ খ্রিষ্টপূর্বে। তো হয়েছে কি যেদিন ভোরে পারস্য সম্রাট দারিয়ুসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা সেদিন সকালে পারমিনিয়ন নামে তার এক সেনাপতি আলেকজান্ডারের তাঁবুতে গিয়ে দেখতে পেলেন যে তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পারমিনিয়ন তাকে ডেকে তুলে বললেন-একি আলেকজান্ডার, তুমি দেখছি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছ। অথচ দুশ্চিন্তায় সারা রাত আমাদের ঘুম নেই! পারমিনিয়নের কথার প্রতিউত্তরে আলেকজান্ডার মৃদু হেসে বললেন-এ যুদ্ধে জয় আমাদের সুনিশ্চিত।

পারমিনিয়ন বললেন-সেটা কীভাবে? পারস্যের আড়াই লাখ সৈন্যের বিরুদ্ধে আমাদের সৈন্য সংখ্যা মাত্র পঞ্চাশ হাজার। আলেকজান্ডার অম্লান বদনে বললেন-ইলিয়াডের সব যুদ্ধকৌশল আমার মুখস্থ। পারস্য সম্রাট দারিয়ুস নিশ্চয়ই হোমারের ইলিয়ড পড়েনি।

সম্রাট দারিয়ুসের পরিত্যক্ত শিবির ও অঞ্চল থেকে যেসব মহামূল্যবান জিনিসপত্র আনা হয়েছিল তার মধ্যে একটি অদ্ভুত সুন্দর ছোট বাক্সও ছিল তিনি তার সতীর্থদের জিজ্ঞেস করলেন এর মধ্যে কি উপযুক্ত জিনিস রাখা যেতে পারে। বিভিন্ন জিনিসপত্রের নাম প্রস্তাব করা হলো। কিন্তু তিনি বললেন যে, মহাকাব্য ‘ইলিয়ড’ই হচ্ছে প্রকৃত উপযুক্ত বস্তু যা এর মধ্যে রাখা সবচেয়ে উত্তম হবে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন আলেকজান্ডারের যুদ্ধ পরিচালনার বিষয়ে মহাকবি হোমারের এ মহাকাব্যটি ভীষণভাবে আলেকজান্ডারকে সাহায্য করেছিল।

মুঘল সম্রাট বাবর, হুমায়ুন ও আকবর এরা সবাই বই পড়তেন। আকবর ছিলেন অক্ষর জ্ঞানহীন তবুও উপলব্ধি করেছিলেন বইয়ের গুরুত্ব। তিনি জানতেন রাষ্ট্র চালাতে জ্ঞানের বিকল্প নেই। এ জন্য তার সংগ্রহশালায় ছিল প্রায় ২৪০০০ হাজার বই। তিনি নিজে পড়তে জানতেন না বলে অন্যকে দিয়ে পড়াতেন আর নিজে শুনতেন বইয়ের ভেতরকার সেসব মর্মকথা। সম্রাট হুমায়ুনও বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসতেন। তার জীবনের সবচেয়ে প্রধান শত্রু শের শাহ যখন তাকে তাড়া করে ফিরছেন বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে তখনো তিনি বই পড়া থেকে নিজেকে বিরত রাখেননি।

হাতির পিঠে ছিল তার চলন্ত গ্রন্থাগার। তিনি যেখানেই যান সঙ্গে থাকে তার বইয়ের সংগ্রহশালা। তার ধারণা বই দুঃসময়ে তাকে শক্তি ও প্রেরণা জোগাবে। বই থেকেই তিনি পেতে পারেন আত্মরক্ষা ও বিজয়ের সূত্র। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নেরও ছিল বইয়ের দারুণ নেশা। ভালোবাসতেন সোনার কৌটা থেকে নস্যি নিতে। গরম জলে স্নান করতে আর পছন্দ করতেন ফরাসি এসেন্স। একই সঙ্গে দুরন্ত নেশা ছিল বই পড়ার। সতীর্থরা যখন সুরা আর সুন্দরী সঙ্গে মত্ত তখন কর্সিকা দ্বীপ থেকে আগত অর্ধ ফরাসি ও অর্ধ ইতালিয়ান এ কিশোরটি ডুবে যেত বইয়ের মধ্যে।

একবার তিনি ফ্রান্স থেকে মিশরে যাচ্ছিলেন যুদ্ধাভিযানে। বেশকটি জাহাজে তার সৈন্যসামন্ত সঙ্গে জাহাজ বোঝাই বই। হঠাৎ আকাশ ভেঙে ঝড় উঠল। সমুদ্রে দৈত্যাকৃতির বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল জাহাজে। জাহাজগুলো যেন তখন কলার মোচার মতো অসহায় ও ছন্নছাড়া হয়ে ভাসছে সমুদ্রে। মাঝি-মাল্লাদের মধ্যে কেউ কেউ ছুটে এলো নেপোলিয়নের কাছে এমন বিপদে কী করণীয় সেটা জানতে। তারা দেখতে পেল এমন বিপদেও লণ্ঠন সামনে রেখে একাগ্রচিত্তে বইপাঠে নিমগ্ন নেপোলিয়ন। তারা চেঁচিয়ে বলতে লাগল-‘মহামান্য সম্রাট আমাদের জাহাজগুলো সব ডুবতে চলেছে।

এ মুহূর্তে আমাদের কী করণীয় দয়া করে পরামর্শ দিন।’ নেপোলিয়ন ঈষৎ হেসে বললেন-‘বইয়ের মধ্যে আমি সেই উত্তরটিই খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি যা এ মুহূর্তে আমাদের বাঁচার জন্য প্রয়োজন।’ তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন-‘দেখো যা কিছু ঘটছে সবই প্রাকৃতিক। এখানে আমাদের কারোরই কিছু করার নইে। ঝড় থেমে গেলে সমুদ্র এমনিতেই শান্ত হয়ে যাবে। তাহলেই আমরা বাঁচতে পারব।’

আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, আমাদের এ ভারতবর্ষে বইমেলার সংস্কৃতি খুব একটা পুরোনো নয়। আসলে আমার এ কথাটা ঠিক হলো না। সমগ্র পৃথিবীতেই বইমেলার সংস্কৃতি খুব একটা বেশি দিনের নয়। এর প্রধান কারণ ১৫ শতকে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের আগে বই সাধারণত পশুর চামড়া, প্যাপিরাস পাতা কিংবা পাথরের ফলক প্রভৃতি জিনিসপত্রে লেখা হতো। এ জন্য বই সে সময় এতটা সুলভ ছিল না। কিন্তু ১৪৫০ সালে জার্মান আবিষ্কারক জোহানেস গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করার ফলে মুদ্রণশিল্পে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে।

পরবর্তীকালে ছাপা হতে থাকে লাখ লাখ বই। ভারতবর্ষে মুদ্রণযন্ত্রের আগমন ঘটে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দ্য গামার হাত ধরে। তিনি ১৫০২ সালে তার দ্বিতীয় দফা ভারত অভিযানের সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসেন জার্মানদের আবিষ্কৃত মুদ্রণযন্ত্র।

ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্যিকভাবে বই ও সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য গোয়াতে ছাপাখানা স্থাপন করেন পর্তুগিজরা ১৫৫৬ সালে। বঙ্গে ছাপাখানা স্থাপিত হতে লেগে যায় আরও দুশ বছর। ১৭৭৮ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হলো ছাপাখানা। ঢাকায় প্রথম মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হয় ১৮৪৮ সালে। তবে পূর্ববঙ্গ বা বর্তমানের বাংলাদেশে সৃজনশীল প্রকাশনার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে।

১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে এন্ডুজের ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয় ন্যাথানিয়েল ব্রাসে হ্যালহেডে রচিত ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’। বাংলা প্রদেশে বাংলা অক্ষরে (ইংরেজি অক্ষরেও) ছাপা প্রথম বই হলো এটি। মুদ্রাকর ছিলেন ইংরেজ চালর্স উইলকিন্স। বাংলা হরফ তৈরি করেছিলেন তিনি পঞ্চানন কর্মকারের সহায়তায়। এভাবেই হ্যালহেড, উইলকিন্স আর পঞ্চানন কর্মকার বাংলা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে আছেন। ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে জেমস্ আগাস্টাস হিকি বাংলায় প্রথম সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’ ছেপেছিলেন।

বাংলাদেশের অমর একুশে বইমেলা সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় বাংলাদেশে বইমেলার বীজ বপন করা হয় ১৯৬৫ সালে। এটি শুরু হয় খুব ছোট্ট পরিসরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরা চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এ ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাসাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। এ বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে অন্যরা অণুপ্রাণিত হোন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি; এ সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসাবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজনে প্রভুত অবদান রেখেছিলেন।

কিন্তু এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমি চত্বর থেকে পর্যায়ক্রমে তা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে।

ন্যাশনাল বুকট্রাস্ট ১৯৬৯ খ্রি. মুম্বাই শহরে যে বইমেলার আয়োজন করে সেটাই সম্ভবত ভারতে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় গ্রন্থ মেলা। এ বুক ট্রাস্টের উদ্যোগে দিল্লিতে শুরু হয় প্রথম বিশ্ব বইমেলা। মাদ্রাজে ১৯৭৪ সালে একই উদ্যোগে বইমেলার উদ্ভব হয়। পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা ময়দান এখন প্রতিবছর শীতকালে কলকাতা বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়।

কলকাতা বইমেলা ১৯৭৫ খ্রি. শুরু হওয়ার পর প্রতি বছর সমান উৎসাহ ও সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হচ্ছে। তবে এ বইমেলা কলকাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এখন হাওড়া বর্ধমান বাকুঁড়া, পুরুলিয়া প্রভৃতি জেলায় বিস্তার লাভ করেছে।

এখানে উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন যে, আধুনিক সময়ের বইমেলার বীজ প্রথিত করতে বটতলার সাহিত্য ও বই ফেরিওয়ালাদের অবদানও নেহায়েত কম নয়। প্রথমেই একটু আলোচনা করা যাক বটতলার সাহিত্যের কথা-এক সময় বটতলার সাহিত্য মানেই নাকি বোঝাত নিচু শ্রেণির মানুষের সাহিত্য। বইগুলো কোনো নামকরা প্রকাশনী থেকে ছাপানো হতো না। বইয়ে কোনো লেখকের পরিচয় দেওয়া থাকত না, একজন অখ্যাত, অজ্ঞাত কেউ সবার অগোচরে নিজের মনের কথাগুলো লিখে রাখত। সেখানে থাকত গ্রাম-বাংলার মানুষের জীবনচিত্র। আসলে এসব লেখক কখনো নিজের প্ররোচনার জন্য লিখতেন না, তাই সব লেখায় তাদের মনের কথাগুলো খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠতে পেরেছিল। অনেকে মনে করেন পুঁথি সাহিত্য হচ্ছে এ বটতলার সাহিত্যের অংশ।

বটতলার সাহিত্য বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন আজেহর আলি তার ‘বটতলার সাহিত্য’ নামক বইটিতে। শোনা যায়, বউবাজারের এক অশ্বত্থ গাছের তলা ছিল চার্নক সাহেব ও অন্যান্য বণিকদের বিশ্রাম নেওয়ার বৈঠকখানা। বাজারের কাছে শিয়ালদহ-বউবাজারের মোড়ের মাথায় এ অশ্বত্থের ছায়ায় বসে জব চার্নক কয়েকটি গ্রামকে কলকাতা শহরে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই অশ্বত্থ গাছটা আজ নেই, কিন্তু বৈঠকখানা নামটা রয়েছে এবং তার সঙ্গে অক্ষুণ্ন রয়েছে এ অঞ্চলের সেই ঐতিহাসিক বাণিজ্য ধারা। বউবাজারের এ অশ্বত্থ গাছের মতো সেকালের কলকাতায় আর একটি বিখ্যাত বটগাছ ছিল শোভাবাজারে।

বাংলাদেশের অনেক দীর্ঘায়ু বটগাছের মতো, শোভাবাজারের বটগাছের একটা বাঁধানো চাতাল ছিল। সে বাঁধানো বটতলায় কবিগানের আসর জমত প্রায়, নিধুবাবুর টপ্পা সুরে বটতলার পরিপার্শ্ব সরগরম হয়ে উঠত। শুধু তা-ই নয়, ছাপার অক্ষরে নবযুগের বাঙালির সাহিত্য সাধনার উদ্বোধনও হয় এ বটতলার আশপাশের ছাপাখানায়। বাঙালি হিন্দু-মুসলমান প্রকাশক যারা এ উদযোগপর্বে প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তাদের বংশধররা আজও হয়তো কেউ কেউ জীবিত আছেন এবং পুরুষানুক্রমে সেই প্রকাশকের ব্যবসায়ই করছেন। কিন্তু কলকাতার সম্ভ্রান্ত পাঠকরা আজ তাদের কোনো খোঁজই রাখেন না।

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই বটতলার অভিযান শুরু হয়েছে বলা চলে। ১৮১৮-২০ সালের মধ্যে বটতলার প্রথম ছাপাখানা করেন বিশ্বনাথ দেব। তার আগে কলকাতায় অবশ্য আরও চার-পাঁচটি ছাপাখানা হয়েছিল এবং লং সাহেব বলেন যে, তার মধ্যে দেশি লোকের অন্তত চারটি প্রেস ছিল। এ চারটি প্রেসই হয়তো ‘হিন্দুস্থানি প্রেস’, ‘বাঙালি প্রেস’, ‘সংস্কৃত প্রেস’ ও ‘বিশ্বনাথের প্রেস’। সে যা-ই হোক, প্রেসের অবস্থা কিন্তু তখন খুব শোচনীয় ছিল। কারণ বাংলা হরফ নির্মাতা পঞ্চানন কর্মকারের ছেনিকাটা বাংলা অক্ষর তখনো খুব উন্নত হয়নি। ১৭৯৮ সালের গোড়ার দিকে পঞ্চানন যে প্রথম বাংলা টাইপ-ফাউন্ড্রি কলকাতায় স্থাপন করেন (শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা ভারতবর্ষে এই হলো প্রথম দেশীয় ভাষায় টাইপ ফাউন্ড্রি), তা ছাড়া আর কোনো টাইপ-ফাউন্ড্রি তখন হয়েছিল কিনা সন্দেহ। হলেও, পঞ্চাননের অক্ষরের চেয়ে বাংলা ছাপা অক্ষরের যে আরও উন্নতি হয়েছিল তা মনে হয় না। বটতলার ছাপাখানায় বাংলা বই এ অক্ষরেই ছাপা হতো।

এবার আলোচনা করা যাক বই ফেরিওয়ালাদের কথা। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে বইমেলা শুরুর আগে বহু প্রকাশক ও বই ব্যবসায়ীরা বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও ইস্টিমারে বই ফেরি করে বিক্রি করতেন। এভাবে তারা বইয়ের বাজার তৈরিতে প্রভুত অবদান রেখেছিলেন। এদের মধ্যে অনেক বিখ্যাত লেখক, প্রকাশকও ছিলেন। এদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় গজেন্দ্র কুমার মিত্র ও সুমথনাথ ঘোষের কথা। সেসব বিষয় বিস্তারিত লেখা আছে গজেন্দ্রকুমার মিত্রের কাকভূষন্ডীর আলাপচারিতায়।

গজেনবাবু (গজেন্দ্রকুমার মিত্র) ও সুমথবাবু (সুমথনাথ ঘোষ) ছিলেন বাল্যবন্ধু। দুজনে একই ক্লাসে পড়তেন বালিগঞ্জের জগদ্বন্ধু স্কুলে। গোড়ার দিক থেকে নয়। গজেনবাবুর বাল্যকাল কেটেছে কাশিতে। কলকাতার শহরতলী ঢাকুরিয়া অঞ্চলে তারা চলে এলেন কাশি থেকে নানা স্থান ঘুরে। সেই সময় তিনি ভর্তি হন জগদ্বন্ধু স্কুলের ক্লাস এইটে। তখন বলা হতো থার্ড ক্লাস। সুমথবাবুও একই ক্লাসে পড়তেন। সেই থেকেই দুজনের বন্ধুত্বের শুরু। সুমথবাবু আজন্ম ঢাকুরিয়ার অধিবাসী।

দুজনের কারোরই সাংসারিক অবস্থা সচ্ছল ছিল না, কলেজে পড়তে পড়তেই ভাগ্যান্বেষণের চেষ্টা চলেছে-সেই সঙ্গে সাহিত্যচর্চাও। দুজনে মিলে পত্রিকাও বের করেছেন। সুমথবাবুর বেশি উৎসাহ ছিল ছবি আঁকায়। পরে পুরোপুরি তিনিও সাহিত্যচর্চায় নেমে পড়েন। তাদের প্রথম ছাপা পত্রিকার নাম ছিল ‘বিজয়’।

প্রায় বিনা মূলধনের পত্রিকা। ‘বিজয়’ পত্রিকাও বন্ধ হতে বিলম্ব হলো না। অতএব, কী করা! দুই বন্ধুতে নানা পরামর্শ-পরিকল্পনা চলে। এরই মধ্যে বড় বড় স্কুল পাঠ্যপুস্তক-প্রকাশকদের হয়ে মফস্বল শহরের গ্রামের স্কুলগুলোয় ক্যানভাসিং করেন দুজনে। কিন্তু সেও বড়জোর মাসখানেকের কাজ বছরে। পরে স্কুল লাইব্রেরিতেও বিভিন্ন প্রকাশকের নানা ধরনের সাধারণ বই বিক্রির চেষ্টা হতো-তাতে সামান্য কিছু আসতও। তবে সেও কতই বা।

এই যখন অবস্থা তখন দুই বন্ধু ঠিক করলেন, বাংলার বাইরে নতুন-পুরোনো ভালো ভালো বই নিয়ে গিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করলে কেমন হয়! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। তারা দুজনে টাঙ্ক বোঝাই করে নতুন পুরোনো বাংলা বই নিয়ে বিহারের কতকগুলো শহরে অভিজাত বাঙালির বাড়ি বাড়ি হাজির হলেন। অভাবনীয় সাড়া পাওয়া গেল।

এ সাড়াতেই ভরসা পেলেন দুই বন্ধু এবং ফেরি করে বিক্রি করতে লাগলেন বই।

এবার বিখ্যাত সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যালের কথা বলি। তিনিও ফেরি করে গ্রামে-গঞ্জে বই পত্রিকা এগুলো বিক্রি করতেন। তিনি তার বিখ্যাত উপন্যাসোপম আত্মজীবনী-‘বনস্পতির বৈঠকে’ লিখেছেন-‘সেই সপ্তাহ থেকেই আমি ‘বিচিত্রা’ ফিরি করতে আরম্ভ করেছিলুম। আমি হকার, এ আমার গৌরব। আমি ঝাড়ুদার, সেও আমার গৌরব। আমি মেহনতি শ্রমিক, আমি ওয়ার্কার সব ধরনের কাজই আমার পক্ষে শ্রদ্ধেয়। ‘বিচিত্রা’ ফিরি করতে আরম্ভ করলুম শিয়ালদা ও নৈহাটির মাঝখানে ট্রেনে ট্রেনে ডেলি-প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে। বিকাল পাঁচটা থেকে রাত আটটা। দাঁতের মাজন, হজমি গুলি, বাতের তেল, মাথা ধরার মালিশ, আমাশার ওষুধ, চানাচুর-এদের ফেরি করছে যারা, আমি তাদেরই সঙ্গে বেচছি একখানা ‘বিচিত্রা’, দাম এক আনা। কী আনন্দ আমার-যখন এক আনা ফেলি পকেটের মধ্যে। বাড়ি ফেরবার আগে একখানা ‘বিচিত্রা’ নিয়ে যান মশাই! বন্ধুগণ, বাঙালি হলো সাহিত্যপ্রিয়, সাহিত্য তাদের মরণ-বাঁচনের বিষয়। এ কাগজে নতুন জীবনের স্বাদ পাবেন। নারী জাগরণের খবর পড়ুন। এ কাগজে ব্রিটিশ শাসনের কঠোর সমালোচনা দেখবেন! বায়োস্কোপের সব খবর আছে। দাম মাত্র এক আনা!’

মনে মনে প্রতিজ্ঞা ছিল, আট-দশখানা ট্রেনে অন্তত পঞ্চাশখানা কাগজ বেচে তবে বাড়ি ফিরব। পঁচিশ পার্সেন্ট কমিশন, সুতরাং প্রতি কাগজে আমার নিজস্ব এক পয়সা থাকবে। এই করে যদি মাসে উনিশ-কুড়ি টাকা পাই, তবে আমার পয়সা খায় কে? বাড়িতে প্রতি মাসে অন্তত পনেরো টাকা ঠিকই দিতে পারব!

বই নিঃসন্দেহে আমাদের মধ্যে সৃজনশীলতা, মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা ও মানবতাবোধ তৈরি করে। বইমেলা একদিকে যেমন একটি উৎসব ঠিক তেমনি এ উৎসবে মিলন ঘটে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের। লক্ষ, সহস বই থেকে পাঠক তার রুচি মাফিক বই সংগ্রহ করারও একটি সুবর্ণসুযোগ ঘটে এ বইমেলায়। নানা রং ও বর্ণের সুন্দর সুন্দর মলাটে বইগুলো যেন পাঠকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। যদিও ইংরেজিতে একটি কথা আছে-ডোন্ট জাজ দ্য বুক বাই ইটস কভার। তারপরও আমরা কিন্তু সুন্দর একটি প্রচ্ছদ দেখে বিমোহিত হই। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত প্রকাশক ও লেখক সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা-‘কলেজ স্ট্রিটে সত্তর বছর’ বইটিতে প্রচ্ছদ নিয়ে একটি ঘটনার কথা পড়েছিলাম। সেটি হঠাৎ মাথায় এলো বলেই বলছি। আধুনিক ও চমৎকার প্রচ্ছদের গোড়াপত্তন করেছিলেন কলকাতার ত্রিবেণী প্রকাশন। ভানুবাবু তার বইটিতে লিখেছেন- আনন্দবাজার পত্রিকার ডেভেলপমেন্ট অফিসার কানাইলাল সরকার তার দুই বন্ধুকে নিয়ে প্রকাশনা শুরু করলেন-ত্রিবেণী প্রকাশন নামে।

এদের বইয়ের মলাটে বৈচিত্র্য ছিল নানা রকম। একটি বইয়ের কথা মনে আছে-সমুদ্রসৈকতের পটভূমিতে রচিত বইয়ের কাহিনি। প্রচ্ছদে নিচের দিকে সমুদ্রের ঢেউ ও বেলাভূমি। বেলাভূমির ছবিতে আঠা দিয়ে সত্যিকার বালি ছড়ানো। পাঠক হাত দিয়ে বালির স্পর্শ পেয়ে শিহরিত হতেন।

সভ্যতার সূচনালগ্নে বইয়ের গুরুত্ব ছিল, বর্তমানে আছে আমার ধারণা ভবিষ্যতেও থাকবে। যদিও প্রাচীনযুগে বইমেলা ছিল না কিন্তু বইমেলার পরিবর্তে লাইব্রেরি ছিল। মিশরের রানি ক্লিওপেট্রার নাম আপনারা নিশ্চই শুনেছেন। তিনি ছিলেন জ্ঞানতাপসী। মোট ৭টি ভাষায় তিনি অনর্গল কথা বলতে পারতেন। চিকিৎসা, জোতির্বিদ্যা, গণিতশাস্ত্র এমন কোনো বিষয় নেই যা তার অজানা ছিল। বইয়ের প্রতি ছিল তার ভীষণ অনুরাগ। একবার তাদের সংগ্রহশালাটি আগুনে পুড়ে পায়। এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন বিশিষ্ট গবেষক ও পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

তিনি তার লাইব্রেরি নামক প্রবন্ধে আমাদের জানাচ্ছেন- টলেমিরা সব দেশের বই-ই সংগ্রহ করতেন; মিশরের বইও তারা সংগ্রহ করতেন, হিব্রুদের বইও সংগ্রহ করতেন। তারা বড় বড় পণ্ডিত দেখে লাইব্রেরির অধ্যক্ষ নিযুক্ত করতেন। কেউ কেউ বলেন সেখানে ৪ লাখ বই ছিল, কেউ বলেন সেখানে ৭ লাখ বই ছিল। জুলিয়াস সিজার যখন আলেকজেন্দ্রিয়ার নৌকার বহরগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেন, তখন সেই আগুনে ওই বড় লাইব্রেরিটিও পুড়ে যায়। সিজারের পর ক্লিওপেট্রার পরম বন্ধু মার্ক এন্টনি এ ক্ষতি পূরণের জন্য ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি করেন কী-তুরস্কের পার্গামম নামে এক জায়গায় এক বিশাল লাইব্রেরি ছিল, সেটাই তুলে এনে ক্লিওপেট্রাকে উপহার দেন। এ উপহার পেয়ে ক্লিওপেট্রার দুঃখ নিশ্চয়ই কিছুটা প্রশমিত হয়েছিল।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম