Logo
Logo
×

একুশের বিশেষ আয়োজন

ঘর নেই দরজা পাবে কোথায়

Icon

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঘর নেই দরজা পাবে কোথায়

স্বাধীন দেশে বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে, কিন্তু হয়েও ঠিক হলো না, ফাঁক রয়ে গেল কোথাও। আগে হয়নি, হওয়া সম্ভব ছিল না; কেননা আগে রাষ্ট্র ছিল অবাঙালিদের অধীন। তাই রাষ্ট্রভাষা কখনো ছিল সংস্কৃত, কখনো ফার্সি তারপর ইংরেজি, সব শেষে করতে চেয়েছিল উর্দু। বাংলা এই প্রথম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে হলেও গৃহীত হয়েছে।

কিন্তু তবুও সবাই জানি আমরা এবং মানিও, যে বাংলা এখনো রাষ্ট্রভাষা হয়নি। তার মানে কী? রাষ্ট্রের ওপর কি বাঙালির কর্তৃত্ব এখনো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভ হয়নি? আসলেই তাই। এতসব ঝড়-ঝঞ্ঝা, রক্তপাত, উত্থান, যুদ্ধ, রাষ্ট্রের ভাঙাভাঙি সত্ত্বেও রাষ্ট্রের ওপর বাঙালির নিজের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়নি। যারা অধিপতি তারা চেহারায় ও বংশ পরিচয়ে যতই বাঙালি হন না কেন, ভাষায় ও আকাঙ্ক্ষায় বাঙালি নন, কিংবা থাকছেন না।

পাকিস্তান ছিল একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্র ভেঙেছি। আমাদের নতুন রাষ্ট্রের আর যাই হোক পুরাতন রাষ্ট্রের মতো হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু পশ্চাৎমুখো গতিতে আমরা আবার সেখানেই চলে গেছি, যেখান থেকে শুরু করেছিলাম। অবিকল নয়, অবিকল প্রত্যাগমন ঘটছে না কখনো, ঘটার উপায় নেই। কিন্তু অনেকটাই বটে।

একাত্তরে পাকিস্তানের বাঙালি আমলাতন্ত্র কোন পক্ষে ছিল? ব্যক্তিগতভাবে কোনো কোনো আমলা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই ছিলেন। কেউ কেউ চলেও গিয়েছিলেন মুজিবনগরে, বিশেষ করে তারা যারা কর্তব্যরত ছিলেন সীমান্তের কাছাকাছি শহরগুলোতে; কিন্তু এরা ব্যতিক্রম; বেশির ভাগ আমলাই, এবং আমলাতন্ত্র তো বটেই, ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষেই। সেটাই স্বাভাবিক। কেননা সে আমলাতন্ত্র তো পাকিস্তানি রাষ্ট্রেরই অংশ, তারই বশংবদ এবং সেই অবস্থানে তার বাঙালি-অবাঙালি বিভাজনটা ছিল অবাস্তব, বাঙালি আমলাতন্ত্র বলে আলাদা কিছু ছিল না, সবটাই ছিল পাকিস্তানি।

পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের পেছনে বেতন-ভাতা ছিল। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ না মোটেই। বেতন-ভাতার চেয়ে বেশি ছিল উপরি, আরও ছিল ক্ষমতার অংশভাগ। অন্ধকারে বিদ্যুতের মতো জ্বলজ্বল করত ক্ষমতার অহংকার, শীতের দিনে উষ্ণ পোশাকের মতো সুখ দিত তাদেরও যারা ছিল ভদ্র কিসিমের, আর যারা উগ্র ও উদ্ধৃত তারা তো ছোক ছোক করত সর্বদাই, হুঙ্কার দিত থেকে থেকে, হামলা করত নিরাপদ বোধ করলে। এমনকি বায়ান্নতেও তো দেখেছি আমরা উচ্চশিক্ষিত বাঙালি আমলা গুলি চালানো থেকে মিথ্যা প্রেসনোট লেখা পর্যন্ত সব কাজই করেছে।

ঘৃণা ভরে করেছে সব সময় এমন যে বিশ্বাস করবে সে সাহস হয় না। অনেক সময়তো মনে হতো জনগণের নিপীড়নের কাজ বেশ উপভোগ করেছে। উর্দি পরিহিত হোক কি-না হোক, রাষ্ট্রের সেবা করেছে তারা খুব সুন্দরভাবে। আমি একজন কবিকে জানি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৃঢ়ভাবে জাতীয়তাবাদী হয়েছেন, একাত্তরেও ছিলেন অনেকটা, প্রকাশ্যে না হলেও; কিন্তু বায়ান্নতে যিনি ছিলেন উলটোদিকে। তার মহকুমায় গুলি পর্যন্ত হয়েছিল, তারই হুকুমে। সে নিয়ে বলছিলেন যখন গলার স্বরে তখন আত্মধিক্কার শুনতে পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। আমলাতন্ত্র মানুষকে মানুষ রাখে না। ইতর করে ছাড়ে।

পাকিস্তান হওয়ায় এ আমলাতন্ত্রের একদফা লাভ হয়েছে। আমলারা পদন্নোত হয়েছেন। আগের তুলনায় একটি, দুটি, তিনটি, হয়তো তার চেয়েও বেশি ধাপ ভাঙতে পেরেছেন তারা, লম্ফ দিয়ে। তারচেয়েও বড় কথা ব্রিটিশ সিংহরা সরে যাওয়া দেশি প্রাণীরা সিংহ হয়ে বসেছে। সেটা কম কথা নয়। কেউ আবার বাঘ হয়েছে, কেউ কেউ। তাই বা কম কিসে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা প্রথম থেকেই ছিল বেসামরিক আমলাতন্ত্রের হাতে, পরে সামরিক আমলাতন্ত্র যখন ক্ষমতা দখল করে নিল তখনো তাদের কোনো অসুবিধা হলো না; হঠকারী ছোট ভাইটির সঙ্গে বিজ্ঞ বড় ভাইয়ের মতো মিলে মিশে সব কিছু নিজের ও সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে অতিপরিচ্ছন্নভাবে ব্যবহার করতে থাকল। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এও প্রমাণিত হলো যে, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আমলাতন্ত্রের কোনো বিরোধ তো নেই, প্রশ্নই ওঠে না থাকার, উলটো যা আছে তা হলো নিবিড় আঁতাত।

লক্ষ করার বিষয় যে, আমলাতন্ত্রকে নিরপেক্ষ মনে করা হয়, যার দরুন যখনই দেশে ‘বিপ্লব’ হয়, সে বিপ্লব সামরিক অভ্যুত্থানই হোক কি মধ্যবিত্তের অভ্যুত্থানই হোক [১৯৭৫-এর কিংবা ১৯৯০-এর] তখন নিরপেক্ষ উপদেষ্টা দেখা যায় খুঁজে পাওয়া যায় ওই আমলাতন্ত্রের মধ্যেই। বিভ্রম সৃষ্টিতে আমলাতন্ত্র অতুলনীয়।

বায়ান্নতে বাঙালিদের যে আন্দোলনের শুরু তা পাকিস্তান নামক ওই যে রাষ্ট্র যেটি অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী ও কাঠামো তো আমলাতন্ত্রী তাকে ভাঙার লক্ষ্যেই এগিয়েছে। ক্রমাগত। অন্যতম রাষ্ট্রভাষা থেকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষাই গন্তব্য স্থির হয়ে গেছে, অনেকেরই অজান্তে-কিন্তু খুবই স্বাভাবিকভাবে। কেননা বায়ান্নতে যার সূচনা হয়েছে সে তো অন্য কিছু নয়, সে হলো সামন্তবাদী ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে পরিত্যাগ করে ভাষাভিত্তিক আধুনিক ও ইহজাগতিক জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ। ওই জাতীয়তাবাদ পাকিস্তান রাষ্ট্রকে মানবে কেন, তাকে না ভেঙে তার পক্ষে এগোনোর উপায়ই বা কী?

আমলাতন্ত্র সাতচল্লিশে মুনাফা করেছে, বায়ান্নতেও বিপদে পড়েনি; কিন্তু একাত্তরে কিছুটা পড়েছিল, অর্থাৎ তার একাংশ পড়েছিল। তবে পুষিয়ে নিয়েছে। যারা মুজিবনগরে গেছেন, কিংবা ‘প্রমাণ’ হাজির করতে পেরেছেন যে গিয়েছিলেন, তারা অন্য আমলাদের ছাড়িয়ে গেছেন, উন্নতিতে। আর যারা যাননি তারাও মুনাফা পেয়ে গেছেন। সেই সাতচল্লিশের মতোই।

প্রায় অবিকল। সাতচল্লিশে ব্রিটিশভক্ত আমলাতন্ত্র ক্ষমতা পেয়ে গেল, বাহাত্তরে পাকিস্তানভক্ত আমলাতন্ত্র প্রথমে ক্ষমতার কাছাকাছি রইল, পরে অতিদ্রুত তারাই ক্ষমতার আসল চালক হয়ে দাঁড়াল। একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান সামরিক আমলাতন্ত্র ও তার বড় ভাই বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে। সেই লরেলহার্ভির কায়কারবার, যদিও কৌতুকের অর্থে নয়। রাষ্ট্র স্বাধীন। আমলাতন্ত্র তাই আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় স্বাধীন। ধন্য বাঙালি, তুমি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলে।

বায়ান্নর পর পশ্চিম পাকিস্তানি লেখক একজন এক অনুষ্ঠানে বেশ ঘটা করে বলেছিলেন তার শ্রোতাদের যে, তারাও আসলে আমাদের পথেরই পথিক। চমকে ওঠার মতো কথা বটে। কৌতূহল প্রকাশ করায় বলেছেন আমরা উভয়েই। পূর্ব যেমন পশ্চিমও তেমনই, ইংরেজবিরোধী। একই যুদ্ধ। শুনে মনে মনে হেসেছি আমি। বেচারা! ঐক্য চায়, দুই পাকিস্তানকে এক রাখার ইচ্ছা রাখে, তাই বলেছে ওই আন্তরিক কথাটা। বুঝতে চাইছে না যে, আমাদের ভাষার লড়াইটা

ইংরেজির বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল উর্দুর বিরুদ্ধে।

তা ছিল বৈকি। নিকট লক্ষ্যে উর্দুর বিরুদ্ধেই ছিল। কিন্তু সুদূর লক্ষ্যে ইংরেজিবিরোধীও ছিল বটে, আমরা খেয়াল করি চাই না-ই করি, মানি আর না-ই মানি। গণতন্ত্রের মধ্যে যেমন সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য থাকে প্রোথিত, না থাকলে গণতন্ত্র যেমন এগোতে পারে না এবং সে গণতন্ত্রই থাকে না শেষ পর্যন্ত, আমাদের ভাষার সংগ্রামের ভেতরও তেমনি উর্দুবিরোধিতাটা পার হয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা, যার অপরিহার্য পূর্বশর্ত হলো ইংরেজিকেও হটিয়ে দেওয়া। উর্দু হটিয়ে ইংরেজির খপ্পরে পড়ব, পাঞ্জাবি পুঁজিপতিদের বিতাড়িত করে বাঙালি পুঁজিপতিতের জন্য আসন-বাসন তৈরি করে দেব, এ অভিপ্রায়ে আমরা বায়ান্ন আন্দোলনকে একাত্তরের পরিণতিতে নিয়ে আসিনি, অপরিমেয় রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে। অথচ তাই তো ঘটেছে।

আমরা চলে গেছি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়, আমরা পড়েছি সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে। আমাদের পুঁজিবাদ আর ওই সাম্রাজ্যবাদের অধীন। এ সাম্রাজ্যবাদের ভাষা বাংলা নয়, হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এর ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। সেই ভাষা আজ ওপরের তলায় চলে এসেছে। আর পুঁজিবাদী সমাজে ওপরে যা আসে তাই তো নিচে চলে যায়। সে বর্জ্য উচ্ছিষ্ট হোক, আর ভাষাই হোক।

বাংলাভাষা তাই মর্যাদা পাচ্ছে না, যথার্থ প্রতিষ্ঠা তার জন্য সুদূর পরাহত। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলন ক্রমগত পিছু হটছে এবং ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষিতরা অধিক ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে। আরও উঠবে, যতই দিন যাবে-ব্যবস্থাটা যদি অক্ষত থাকে। বাংলাভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের একেবারে প্রথম ও অপরিহার্য অঙ্গীকারই হচ্ছে সবার জীবনে বাংলার চর্চা, অর্থাৎ সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা। সেই শিক্ষার প্রতিশ্রুতি যত জোরে দেওয়া হচ্ছে ততো জোরে কাজ হচ্ছে না। হবেও না। কেননা যে জায়গাটায় গিয়ে এটি থেমে যাচ্ছে সে হচ্ছে বৈষম্য।

প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করুন আর যাই করুন হাত বাড়িয়ে যে সন্তানের জন্য গ্রহণ করবে সেই জোরটুকু আজ গরিব মানুষে নেই। আর সন্তানের শিক্ষা যে পারিবারিক জীবনে কোনো উন্নতির দ্বারোৎঘাটন করবে সেই ভরসাটুকুও নেই, ঘরই নেই তো দরজা পাবে কোথায়।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম